৪ থেকে ৮ আগস্টের অজানা রুদ্ধশ্বাস কাহিনি
মোবায়েদুর রহমান
প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
এখন চলছে জুলাই মাস। অগ্নিঝরা জুলাই। তারপর আসবে আগস্ট। বেগবান রক্ত স্রোতের আগস্ট। দেড় হাজার মায়ের বুক খালি করার, ২৬ হাজার ছাত্র-জনতার বুলেটে আহত হওয়া, অঙ্গহানি হওয়া অথবা দৃষ্টিশক্তি হারানোর জুলাই আগস্টের বিপ্লব। এতবড় একটি বিপ্লবের নজির ইতিহাসে বিরল। মাত্র ২১ দিনে দেড় হাজার মানুষকে হত্যা করা এবং ২৬ হাজার মানুষকে আহত করা, এমন ইতিহাস একমাত্র দুটি দেশের যুদ্ধ ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় না।
শেখ হাসিনার মতো খুনি স্বৈরশাসক এবং তার দল ও দেড় লাখ মানুষসহ পালিয়ে প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নেওয়ার নজিরও খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু তারপর কী হলো? এ বিষয়টি আজ জ্বলন্ত জিজ্ঞাসা হয়ে দেশের কোটি কোটি মানুষের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এতবড় একটি বিপ্লবের পর ৩ মাসও অতিক্রান্ত হলো না, বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী শক্তিগুলো তাসের ঘর ভেঙে পড়ার মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার যে ঐক্য ছিল শিলা অটল পর্বতের মতো, সেটি আজ বহুধাবিভক্ত। এ সম্পর্কে আমার সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দেওয়ার আগে এ আন্দোলনের শেষ কয়েকটি দিনের কিছু উক্ত ও কিছু অনুক্ত ঘটনা বর্ণনা করা প্রয়োজন।
প্রথম প্রশ্ন হলো, মার্চ টু ঢাকা ৬ আগস্টের পরিবর্তে ৫ আগস্ট করা হলো কেন? জুলাই বিপ্লব নিয়ে ইতোমধ্যেই বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু যারা আন্দোলনের একেবারে পুরোভাগে ছিলেন, তাদের কথা আমরা এর আগে লিখিতভাবে পাইনি। এখন কিছু কিছু কথা বেরিয়ে আসছে। উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার ‘জুলাই মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’ পুস্তকসহ বিভিন্ন মুদ্রিত লেখা এবং ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করা ভিডিওর সাহায্য নিয়েছি এ কলামটি লেখার জন্য। এসব রচনার নির্যাস নিচে দিচ্ছি।
গত বছরের ৪ আগস্ট রাত ৮/৯টার আগে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকে এ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়নি। ৪ আগস্ট রাতে এ আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু, ‘বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে পরিষ্কার কোনো বার্তা পাওয়া যাচ্ছিল না। ২৭ বা ২৮ জুলাই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, আমাদের নেতাকর্মীরা তো কোটা আন্দোলনে নেই, তাদের কেন ধরা হচ্ছে? এ ধরনের বক্তব্যের একটা প্রভাব তো থেকেই যায়। এ কারণে রাজনৈতিক দলগুলোকে উন্মুক্ত আহ্বান জানানোর ব্যাপারে দ্বিধা কাজ করছিল।’ (জুলাই মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু পৃষ্ঠা : ১০২)।
৪ আগস্ট ৬০ জনেরও বেশি আন্দোলনকারী শহীদ হন। এরপর ৬ আগস্ট পর্যন্ত দেরি করলে আরও বিপুল প্রাণহানি হবে এবং পরিণতিতে আর্মি টেকওভারও হতে পারে। এ ছাড়া ৪ আগস্ট লাখ লাখ মানুষ রাজপথে নেমে আসেন এবং স্বেচ্ছায় শেখ হাসিনার জুলুমের শিকার হন। তখন আন্দোলনের অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই ৪ আগস্ট রাত ১১টার পরে পরদিন ৫ আগস্ট মার্চ টু ঢাকার আহ্বান জানানো হয়।
এর আগে সিদ্ধান্ত হয়েছিল পরদিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মূল সমাবেশ হবে। কিন্তু পরদিন বিপুল জনস্রোত দেখে সমাবেশের ভেন্যু শহীদ মিনার থেকে শাহবাগে নিয়ে আসা হয়। শাহবাগে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শীর্ষ নেতারা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন, ‘আমরা কোনো সামরিক শাসন মানবো না। দেশের ভবিষ্যৎ ক্যান্টনমেন্ট থেকে নয়, অভ্যুত্থানের মঞ্চ শাহবাগ থেকে নির্ধারিত হবে। সামরিক শাসনের ঘোষণা এলে শাহবাগ থেকে বিকল্প ঘোষণা দেওয়া হবে।’
আরেকটি প্রশ্ন, আন্দোলন করল ছাত্র-জনতা, কিন্তু সরকারের রূপরেখা ক্যান্টনমেন্টে নির্ধারিত হলো কেন? এ ব্যাপারে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবরের কাছ থেকে। জেনারেল ফজলে আকবর বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা। একটি দৈনিক পত্রিকার ভিডিও ইন্টারভিউয়ে তিনি বলেন, ৪ আগস্ট রাত ১২:২০ মিনিটে যখন আমি বিছানায় শুয়ে পড়েছি, হঠাৎ করে আমার একটা টেলিফোন এলো। টেলিফোনে মেসেজ হচ্ছে, আপনাকে আগামীকাল ১০:০০টার সময় সেনাপ্রধানের সঙ্গে তার বাসায় দেখা করতে হবে। নেক্সট ডে আমি তার বাসায় গেলাম একদম ফিক্সড টাইমে। তিনি অলরেডি ইউনিফরম পরেছিলেন। তিনি আমাকে তিনটা কথা বললেন। আমি বললাম, স্যার আই ডোন্ট ওয়ান্ট এনি ব্লাড।
জেনারেল ওয়াকার জেনারেল আকবরকে বলেন, আপনার একটি পলিটিক্যাল কানেকশন আছে। আমি আপনাকে ডেকেছি আপনাকে একটা দায়িত্ব দিতে চাই।
সেই দায়িত্বটা হচ্ছে আপনি মেজর পলিটিক্যাল পার্টি লিডারদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা মেসেজ দেন যে, আমি তাদের সঙ্গে আলাপ করে এই যে বর্তমান যে ঘটনা, এটার আমরা ইতি টানতে চাই। পলিটিক্যাল লিডাররা যেখানেই বসতে চাইবেন, আমি (জেনারেল ওয়াকার) সেখানেই যাব। আমি ঠিক ১০টায় গিয়েছিলাম। সেনাপ্রধান বলেন, ঠিক ১০টা ৩০ মিনিটে ভারতের সেনাপ্রধান আমাকে ফোন করবে। এর মধ্যেই আমাদের কথা শেষ করতে হবে।
ঠিক সাড়ে ১০টায় ভারতের সেনাপ্রধান কিন্তু রিং করেছিলেন। আমি বেরিয়ে এসে প্রথমে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামকে ফোন করি। এরপর জামায়াতে ইসলামীকে ফোন করি। অতঃপর নাগরিক ঐক্যের প্রধান মাহমুদুর রহমান মান্নাকে ফোন করি। মান্না আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলেন। তাই তার সহকারী ফোনটা ধরেন।
এখানে একটি বড় প্রশ্ন। ৫ আগস্ট হাসিনা বিকাল ৪টায় পালিয়ে গেলেন। আর ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকারকে ফোন করেন সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে। তাদের মধ্যে কী কথা হয়, সেটি বাংলাদেশের তরফ থেকে আজও প্রকাশ করা হয়নি। কিন্তু ‘ক্যালকাটা ডায়ালগ’ নামে কলকাতার যে ইউটিউব চ্যানেল আছে, সেখানে বলা হয়, ভারতীয় জেনারেল ত্রিবেদি বলেন, ভারত চায় শেখ হাসিনা শারীরিকভাবে যেন কোনো অবস্থাতেই ক্ষতিগ্রস্ত না হন। ক্যালকাটা ডায়ালগ, দি ওয়ালের অমল সরকার প্রমুখ বলেন, জেনারেল ত্রিবেদির ফোনের কারণেই শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিমানে করে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
৫ আগস্ট সকাল ১১টার দিকে নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম এবং সজীব ভূঁইয়া বঙ্গভবন অভিমুখে রওয়ানা দেন। পথিমধ্যে তারা খবর পান, সেনাবাহিনী রাজনৈতিক এবং ছাত্রনেতাদের সঙ্গে বসতে চায়। নাহিদ এবং সজীব ভূঁইয়া উত্তর দেন, ‘আমরা ক্যান্টনমেন্টে যাব না। দেশের ভাগ্য ক্যান্টনমেন্ট থেকে নয়, নির্ধারিত হবে জনতার মঞ্চ থেকে।’
বেলা সাড়ে ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে বিএনপির মির্জা ফখরুল এবং জামায়াতের আমীর ড. শফিকুর রহমানসহ পলিটিক্যাল লিডাররা ক্যান্টনমেন্টে যান।
এখানে একটি প্রশ্ন : শেখ হাসিনা বেলা ৪টায় সামরিক বাহিনীর বিমানে ভারতের উদ্দেশে রওয়ানা হন। কিন্তু পরবর্তী সরকার গঠনের রূপরেখা আলোচনার জন্য আগের রাতে অর্থাৎ ৪ আগস্ট জেনারেল আকবরকে পরদিন দেখা করার জন্য বলা হয়। এখান থেকে ধারণা করা যায়, আগের দিন অর্থাৎ ৪ তারিখেই সেনাপ্রধান জানতেন, পরদিন অর্থাৎ ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা গদি ছাড়বেন।
৫ তারিখেই চ্যানেল ২৪-এর কার্যালয় থেকে নাহিদ এবং সজীব ভূঁইয়া ফ্রান্সে অবস্থানরত ড. ইউনূসের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন এবং তাকে দেশের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেন। এ ফোনালাপের সময় মাহফুজ আলম এবং নাসীরউদ্দীন পাটওয়ারী উপস্থিত ছিলেন।
ড. ইউনূসের সঙ্গে কথা বলার পর ছাত্রনেতারা লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। এ সময় তারা বলেন, তারা একটা জাতীয় সরকার গঠন করতে চান। সেই সরকারে বিএনপিকে যোগদানের অনুরোধও তারা করেন। তারা আরও বলেন যে, জাতীয় সরকার কিছু সংস্কার করবে। উত্তরে তারেক রহমান বলেন, ‘এত বেশি দায়িত্ব নেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। আপনারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে একটা নির্বাচন দিয়ে দিতে পারেন।’ একই প্রস্তাব নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ করলে বিএনপি জাতীয় সরকারে আসবে না বলে তারাও তাদের অপারগতা প্রকাশ করেন।
৫ আগস্ট সন্ধ্যা এবং রাতে দুই দফা ড. ইউনূসের সঙ্গে নাহিদ এবং সজীব ভূঁইয়ার ফোনে কথা হয়। ড. ইউনূস এই শর্তে রাজি হন, সরকার তার মতো করেই চলতে হবে। অন্য কেউ সরকার চালালে তিনি থাকবেন না। অধ্যাপক ইউনূসকে জানানো হলো, এটা আমাদেরও মত। সেনা সমর্থিত সরকার হলে আমরাও মানব না। অধ্যাপক ইউনূস ব্যাপারটা নিয়ে আগেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে কথা বলে নিতে বললেন।
ড. ইউনূস ঢাকায় ল্যান্ড করেন ৮ আগস্ট বেলা ২টা ৩০ মিনিটে। কিন্তু জাতীয় সংসদ বাতিল করা হয় ৬ আগস্ট। ছাত্রনেতারা ক্যান্টনমেন্টে না গিয়ে ৬ আগস্ট সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে জেনারেল ওয়াকারের সঙ্গে বৈঠক করতে যান। কথা ছিল ওই বৈঠকে ৩ বাহিনী প্রধান থাকবেন। এখনো ছাত্রনেতারা মনে করেন, হাসিনা দেশ ছাড়ার ৫ ঘণ্টা আগে পলিটিক্যাল লিডারদের ক্যান্টনমেন্টে যাওয়া ভুল ছিল। এর ফলে রাজপথে যে সরকারের পতন হলো, সেই সরকার গঠিত হলো ক্যান্টনমেন্টে এবং সেটাও প্রধান উপদেষ্টা দেশে ফেরার ৪৮ ঘণ্টা আগে।
আমরা জেনে এসেছি, সুপ্রিমকোর্টে রেফারেন্সের উত্তরে সুপ্রিমকোর্ট ইন্টারিম সরকারকে সংবিধানের ১০৬ ধারা মোতাবেক বৈধতা দেয়। ঠিক এভাবে একটি বিপ্লব ছাত্রজনতার অজান্তে সংবিধানের মধ্যে ঢুকে পড়ে, যে সংবিধানকে ছাত্র-জনতা মুজিববাদী সংবিধান বলে বাতিল করতে চান। ৬ আগস্ট জাতীয় সংসদ বাতিল হয়। আর সুপ্রিমকোর্টের মতামত চাওয়া হয় ৮ আগস্ট। তাহলে এ মধ্যবর্তী ৪৮ ঘণ্টার সাংবিধানিক স্ট্যাটাস কী হবে? ৮ আগস্ট অ্যাটর্নি জেনারেল হিসাবে মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ৮ আগস্টেই প্রেসিডেন্সিয়াল রেফারেন্সের শুনানি হয় এবং ৮ আগস্টেই সুপ্রিমকোর্ট তাদের ইতিবাচক ওপিনিয়ন দেন। আর ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের উপদেষ্টা পরিষদ শপথ গ্রহণ করে।
সুপ্রিমকোর্ট তাদের ওপিনিয়নে নাকি বলে যে, যেহেতু বিপ্লব হলো সর্বোচ্চ আইন, কারণ বিপ্লবের মাধ্যমে প্রকাশ পায় The awful majesty of the people, তাই বিপ্লবের মাধ্যমে গঠিত সরকার রাষ্ট্রের মালিক জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতিনিধি। তাই বৈধতার ওপরেও বৈধতা রয়েছে এ সরকারের।
বিপ্লব, গণ-অভ্যুত্থান এবং সাংবিধানিকতার মধ্যে যে চিরন্তন অন্তর্নিহিত বিরোধ, সেটিই ফুটে উঠেছে বিগত ১১ মাসে। এগুলো নিয়ে আরও অনেক কথা বলার আছে। বারান্তরে দৈনিক যুগান্তরের সম্মানিত পাঠকদের খেদমতে সেগুলো নিবেদন করার ইচ্ছা রইল।
