|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর এক অবিস্মরণীয় ও বাঁকবদলের দিন। পঁচাত্তরপরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতির রূপরেখা কেমন হবে, তা অনেকটাই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল এ দিনে। রক্ষীবাহিনী, বাকশাল গঠন ও নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ধীরে ধীরে অজনপ্রিয় ও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ১৫ আগস্ট এক সামরিক অভ্যুত্থানে তার পতনের পর বাংলাদেশের রাজনীতি অনেকটাই গোলোকধাঁধার আবর্তে পড়ে যায়। ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সেনা অভ্যুত্থান ঘটে। জিয়াউর রহমানকে চিফ অব আর্মি স্টাফের পদ থেকে সরিয়ে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। নীতি, আদর্শ, সততা ও ব্যক্তিত্বের জন্য জনতা ও সিপাহিদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য জিয়াউর রহমানকে সিপাহি-জনতা পালটা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মুক্ত করে নিয়ে আসে। রাজনীতিশূন্য ও দিকভ্রান্ত জাতির সামনে জিয়া তখন রীতিমতো ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠা, দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি, সার্ক গঠন ও আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা ও তৎপরতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেন জিয়াউর রহমান। বস্তুত দিশাহীন বাংলাদেশকে স্বনির্ভর ও আত্মমর্যাশীল জাতি হিসাবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড় করানোর ভিত্তিভূমি নির্মাণ করে দেন জিয়াউর রহমান। কবি ও সম্পাদক আবদুল হাই শিকদার সম্পাদিত ‘অবিস্মরণীয় ৭ নভেম্বর’ গ্রন্থে ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ ৭ নভেম্বরের নানা দিক চমৎকারভাবে উঠে এসেছে। গ্রন্থের ভূমিকায় বলা হয়েছে, ‘আমাদের জীবনে এ ধরনের ঘটনা ১১৮ বছর আগে আরেকবার ঘটেছিল ১৮৫৭ সালে। যাকে সাদা চামড়ার ঐতিহাসিকগণ ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ নামে অভিহিত করেছেন। আসলে ওটা ছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী উপমহাদেশের প্রথম সর্বাত্মক যুদ্ধ। তবে ৭ নভেম্বরের সঙ্গে একটা পার্থক্যও আছে ওই ঘটনাটির। যদিও দুটি ঘটনার কেন্দ্রেই ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি, তবুও আগেরটি ছিল স্বাধীনতা উদ্ধারের যুদ্ধ। আর পরেরটি স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম। মিল হলো, দুটিই আগ্রাসন, আধিপত্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ, সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে হয়েছিল পরিচালিত। একটির প্রতীক বৃদ্ধ মুঘল সম্রাট কবি বাহাদুর শাহ জাফর, অন্যটির প্রাণ স্বাধীনতার ঘোষক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, তারুণ্যে উদ্বেল জিয়াউর রহমান- দুক্ষেত্রেই সংগঠক ও চালক সাধারণ সৈনিক-জনতা।’ ৫৯২ পৃষ্ঠার বিশাল এ গ্রন্থটিতে গুরুত্বপূর্ণ লেখক ও গবেষকদের শতাধিক প্রবন্ধ এবং তৎকালীন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয় ও প্রতিবেদন স্থান পেয়েছে। প্রবন্ধ যারা লিখেছেন তাদের মধ্যে আছেন বাংলা ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও লেখক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, বিশিষ্ট কবি ও চিন্তাবিদ সৈয়দ আলী আহসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এমাজউদ্দীন আহমদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও শিক্ষাবিদ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিঞা, কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম, বিচারপতি সুলতান হোসেন খান, কর্নেল (অব.) আকবর হোসেন বীরপ্রতীক, ড. সাঈদ-উর-রহমান, ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী, ড. তারেক শামসুর রেহমান, কবি আবদুল হাই শিকদার প্রমুখ। এসব প্রবন্ধে লেখকগণ ৭ নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহ, তাৎপর্য ও অন্তর্নিহিত মাহাত্ম্য তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। ‘বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ প্রবন্ধে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বলেন, ‘এ বিদ্রোহী সিপাহিদের আস্থাভাজন নেতা এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতা ঘোষণাকারী জিয়ার নেতৃত্বে এ দেশবাসীর জীবনে যেসব মঙ্গল সাধিত হয়েছে তার মধ্যে সর্বপ্রধান হচ্ছে, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি দৃঢ় করা, দেশকে স্বনির্ভর করার সব রকমের চেষ্টা করা, সার্ক গঠন করে প্রতিবেশী ও অপরাপর দেশের সঙ্গে সার্বভৌমত্বভিত্তিক মৈত্রী প্রতিষ্ঠা করা, ধর্মকে রক্ষা করে সমাজজীবনের নৈতিক উন্নতি সাধন প্রভৃতি কার্যাবলি।’ সংহতি দিবসের তাৎপর্য’ প্রবন্ধে এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, প্রায় তেরো কোটি জনসমষ্টি অধ্যুষিত বাংলাদেশের রয়েছে এক ঐতিহাসিক গন্তব্য। এ গন্তব্যে পৌঁছাতে হলে বাংলাদেশকে তার অধ্যাত্ম সত্তার ওপর নির্ভর করেই পথ চলতে হবে, কারও নির্দেশে নয়, কারও ইঙ্গিতে নয়। এসব বিবেচনা করলে ৭ নভেম্বরের অন্তর্নিহিত সত্যের কোনো বিকল্প নেই। ‘অবিস্মরণীয় ৭ নভেম্বর : আবার তোরা মানুষ হ’ প্রবন্ধে কবি আবদুল হাই শিকদার ‘আধিপত্যবাদ, আগ্রাসন, সকল প্রকার অশুভ ও অকল্যাণের বিরুদ্ধে ৭ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশকে বাংলাদেশের কাছে ফিরিয়ে আনার বিপ্লব’ বলে অভিহিত করেন।
তৎকালীন সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় অংশে দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদকীয়গুলো স্থান পেয়েছে। যেগুলোর শিরোনাম ছিল, নব উত্থান, নবযাত্রা শুরু, ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। ইত্তেফাকের ‘নব উত্থান’ নামের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, গতকাল ৭ নভেম্বর যে প্রভাতের সূচনা হইয়াছে তাহা ছিল দেশের বীর সিপাহি ও সাধারণ জনতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণঢালা আনন্দোচ্ছ্বাসে মুখর।
‘ইতিহাস কথা কয় : সংবাদপত্রের প্রতিবেদন’ অংশে দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ ও দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত প্রতিবেদন স্থান পেয়েছে। দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিবেদনের শিরোনামগুলো ছিল, ‘উল্লাসমুখর দেশ, উদ্বেল নগরী’, ‘প্রাণবন্যায় উচ্ছ্বল নগরী’; দৈনিক সংবাদের শিরোনাম ছিল, রাজধানীর পথে পথে লাখো জনতার আনন্দ মিছিল, দৈনিক বাংলার শিরোনাম, উল্লাসে উদ্বেল ঢাকা নগরী। দৈনিক বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, আনন্দ উদ্বেল মানুষের এক অভূতপূর্ব জোয়ার নেমেছিল গতকালের ঢাকায়। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সিপাহি-জনতার সফল বিপ্লবে এবং বেতারে জিয়ার কণ্ঠস্বর শুনে হাজার হাজার মানুষ নেমে এসেছিল পথে। বৃহস্পতিবার গভীর রাত থেকে যে সিপাহি বিপ্লবের শুরু তার সার্থক পরিণতি সর্বস্তরের জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে।
গ্রন্থটির বিভিন্ন প্রবন্ধ ও তৎকালীন প্রতিনিধিত্বশীল সংবাদপত্রগুলোর প্রতিবেদন থেকে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর এবং তৎকালীন রাজনীতি ও গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার দিকটি চমৎকারভাবে অনুভবগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। জিয়াউর রহমানের আকাশস্পর্শী জনপ্রিয়তার প্রেক্ষাপটও পাঠক গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। সময়ের প্রয়োজনে জাতির ভাগ্যাকাশে জিয়ার সদর্প আবির্ভাব ও দায়িত্ব পালনে সাফল্যের সীমাহীন স্বর্ণপালকখচিত মুহূর্ত মূর্তমান হয়ে উঠেছে গ্রন্থটির পরতে পরতে। নির্মোহ মনোভঙ্গি, সততা, স্বদেশপ্রেম, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা ও অকৃপণ কর্মতৎপরতায় জিয়াউর রহমান একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত ও বিভ্রান্ত জাতিকে দিয়েছিলেন সঠিক পথের দিশা।
কবি আবদুল হাই শিকদারের বুদ্ধিদীপ্ত সম্পাদনায় গ্রন্থটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। সম্পাদক জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব প্রতিবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থানকে ৭ নভেম্বর বিপ্লবেরই সম্প্রসারিত উত্থান হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। সম্পাদকের ভাষায়-‘একই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে পরিচালিত হয়েছে দুটি ঘটনাই। যারা ৭ নভেম্বরের চেতনাকে ধারণ করেন তারাই অনুভব করতে পারবেন জুলাই বিপ্লব ২০২৪-এর মর্মার্থ।’
