Logo
Logo
×

সাহিত্য

একজন হুমায়ুন আহমেদ ও আমার যত অনুভব

ফারিহা জেসমিন ইসলাম

ফারিহা জেসমিন ইসলাম

প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২৫, ১২:১৬ পিএম

একজন হুমায়ুন আহমেদ ও আমার যত অনুভব

ছবি: সংগৃহীত

হুমায়ুন আহমেদ আমার কাছে এক ঝলক আলোর নাম। ঘুটঘুটে অন্ধকারে আলোর কিরণরশ্মি। 

আমার বয়স তখন এগারো কি বারো। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে চট্টগ্রামে  খালার বাসায় বেড়াতে এসেছি। টেবিলে রাখা অনেকগুলো বই চোখ কাড়লো। সেখান থেকে  একদিন একটি বই নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। এক পৃষ্ঠা পড়ার পর অনুভব করলাম মস্তিষ্কের ভেতর আনন্দের ঢেউ খেলে গেল। দুইদিন পড়ে সেই বইটি শেষ করলাম। এই ছিল আমার আলোকযাত্রা এবং আনন্দযাত্রার আরম্ভ, শুভ সূচনা।

তো, আমার প্রথম পড়া বইটির নাম ছিল 'পেন্সিলে আঁকা পরী'। লেখক হুমায়ুন আহমেদ। যে লাইনটি পড়ে মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল সেটি ছিল: পৃথিবীর সবচেয়ে অসুন্দর দৃশ্য হলো লোভে চকচক করা চোখ। আর পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য হলো গভীর মমতায় আর্দ্র প্রেমিকার চোখ।  

দারুণ আপ্লুত হয়েছিলাম সে সময়। এরপর যে কদিন ঐ বাসায় ছিলাম বেশ কয়েকটি বই পড়ে ফেললাম। 

এই যে বই পড়া শিখলাম, বই পড়ে আনন্দে ভাসতে শিখলাম, পুরোটাই লেখক হুমায়ুন আহমেদের জাদু। 

এরপর জীবনের অনেক পথ পাড়ি দেওয়া হলো। পড়াশোনার ফাঁকে হুমায়ুন আহমেদ পড়ে পড়ে তাবত মাস, তাবত বছর কেটে যায়।

ততোদিনে চট্টগ্রামে শিফট করেছি। পড়ি চট্টগ্রাম সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। একদিন স্কুল থেকে ফিরে শুনলাম পরের শুক্রবার বিকালে আলমাস সিনেমা হলে পরিবারের সবাই মিলে সিনেমা দেখা হবে। শ্রাবণ মেঘের দিন। নির্মাতা হুমায়ুন আহমেদ এর প্রথম চলচ্চিত্র সম্ভবত। তাঁর লিখা গান-- একটা ছিল সোনার কন্যা মেঘবরণ কেশ... এখনো গুনগুন করি মাঝে মধ্যে। অসম্ভব সুন্দর একটা মুভি দেখা হলো সেদিন। 

এরপর একে একে তাঁর যতো নাটক, চলচ্চিত্র সব দেখা হয়েছে। দুই দুয়ারি, চন্দ্রকথা, ঘেটু পুত্র কমলা। 

১৯৭২ সালে প্রকাশিত হুমায়ুন আহমেদের প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে। অনেক ছোট ছিলাম বলেই হয়তো বইটি পড়ার সুযোগ পাইনি। তবে বড় হয়ে একদিন এই উপন্যাসের ওপর নির্মিত বেলাল আহমেদের মুভিটি দেখলাম। এরপর আমি নন্দিত নরকে কিনে পড়লাম। নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে কয়েকদিন শুধু কাঁদলাম। আমার এমন আবেগের উৎস এবং আশ্রয় যার লেখা, তিনি লেখক হুমায়ুন আহমেদ। 

তাঁর কাহিনী, নির্মাণ, চরিত্রায়ন, কাস্টিং, ডায়লগ সবসময়ই ছিল অতি সাধারণ কিন্তু চমৎকার। তিনি কোন একটা বইতে লিখেছেন-- পৃথিবীর সবচেয়ে অসাধারণ কাজ হলো সাধারণ হওয়া, সবাই সাধারণ হতে পারে না। এই জীবনপ্রেমী, মানবপ্রেমী মানুষটার লেখা ছিল অনন্য সাধারণ। 

তাঁর লেখা পড়ে মনে হয়েছে তিনি মানুষকে সুন্দর অবয়বে ভাবতে পছন্দ করতেন। বিশেষ করে তাঁর গল্প-উপন্যাসের নায়িকারা অসম্ভব রূপবতী হতো। শাড়ী পরা, চোখে কাজল, কপালে টিপ পরা অপূর্ব সুন্দর তরুণীরা হুমায়ুন আহমেদের লেখায় যেন স্বর্গের অপ্সরী হয়ে উঠতো। 

তাঁর গান শুনে মনে হয়, চাঁদ ও চাঁদের আলো খুব ভালোবাসতেন তিনি। গানে গানে চাঁদনী রাতে অনন্তলোকে যাত্রার ইচ্ছের কথা ব্যক্ত করেছেন। লিখেছেন -- ও কারিগর, দয়ার সাগর, ওগো দয়াময়,  চান্নি-পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়। 

আমিও চাঁদের আলো খুব পছন্দ করি। আকাশ ভেঙে যখন রুপোর থালার মতো চাঁদ উঠে, চাঁদের সাদা আলোয় সবকিছু ফর্সা দেখায় তখন আমিও গেয়ে উঠি- ও কারিগর, দয়ার সাগর, ওগো দয়াময়.....।

হুমায়ুন আহমেদের লেখা অসম্ভব জীবন- ঘনিষ্ঠ। সহজেই তিনি মানুষের আবেগের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। জীবনের ছোট ছোট অনুসঙ্গগুলো ফুটিয়ে তুলতে এতটাই চমৎকারিত্ব দেখিয়েছেন যা অতুলনীয়। তাঁর লেখায় খাবারের মেন্যু হিসেবে টকে যাওয়া ডালকে আমরা দেখতে পাই খুব স্বাভাবিক হিসেবে। বরং এই টকে যাওয়া ডাল কিভাবে কারো খাওয়াকে অমৃতের পর্যায়ে নিয়ে যেতে  পারে তা যেন তাঁর বর্ণনায় অপ্রতীম, তুলনার হিত। 

হুমায়ুন আহমেদের রসবোধ, সেটিও ছিল অনন্য। বড়লোকের বাসায় ঠান্ডা পানি দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন কিংবা চায়ের কাপে পিঁপড়া ভেসে থাকার ব্যাপারটিও তাঁর লিখায়  ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি  নিপুণ মুনশিআনায়।

১৯শে জুলাই, ২০১২ সাল। মোহাম্মদপুর, ঢাকা।  

আমি টিভির সামনে বসা। ব্রেকিং নিউজ হচ্ছে সমস্ত টেলিভিশন চ্যানেলে: জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ মারা গেছেন। আমি তখন ইউল্যাবে পড়াই। মাত্র বাসায় ফিরেছি। আমার ভেতরের জগতটাকে যিনি আলো দেখিয়েছেন সেই  প্রদীপটা অন্য এক আলোর ভূবনে পাড়ি জমিয়েছেন। তিনি আর কলম হাতে আমাদের কাছে ফিরবেন না। আমি অঝোরে কাঁদলাম সারাটাক্ষণ। মনে মনে বললাম--- বিদায় ম্যাজিশিয়ান। 

আজ হুমায়ুন আহমেদের তেরোতম মৃত্যুবার্ষিকী। এখন অনেক রাত। শ্রাবণের এই ঘোর বারিষায় এ লিখা লিখছি। দুচোখ ভরা ঘোর বরষা। 

এমন একজন লেখক, যিনি সৃষ্টির অবাক কারিগর, আমরা তাঁকে হারিয়ে ফেলেছি মাত্র ৬৩ বছর বয়সে। অন্তরজুড়ে এ দহন আমৃত্যু আমাকে পোড়াবে। একজন অমর কথাসাহিত্যিক, একজন গুণী নির্মাতা, প্রবল সম্মোহনী শক্তির অধিকারী একজন চমৎকার ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় একাধিক গানের শক্তিমান গীতিকার, আমাদের সবার প্রিয়, আমার প্রিয় হুমায়ুন আহমেদ স্যারকে স্মরণ করছি বিনম্র শ্রদ্ধায়। 

‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো, তুমি চলে এসো এক বরষায়’।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম