সত্যিকারের লেখক লেখায়ই নিমগ্ন থাকে: আবদুল হামিদ মাহবুব
জন্ম ১৪ ডিসেম্বর ১৯৬৩। লেখালেখি শুরু আশির দশকে। গল্প কবিতা প্রবন্ধ ছড়াসহ সাহিত্যের সব শাখায়ই তার বিচরণ। পেশায় সাংবাদিক। পেশাগত কারণে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নিয়মিত কাজ করছেন। ছোট বয়সে শিশু কিশোর সংগঠন চাঁদের হাটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সমাজকর্ম শুরু করেন। নিজের এলাকায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত। ইতোমধ্যে একাধিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৮৮ সালে তিনি সাপ্তাহিক একতার সারা দেশের ‘শ্রেষ্ঠ সাংবাদিক’ হিসাবে পুরস্কৃত হয়েছেন।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : জুননু রাইন
০৩ জুন ২০২২, ০০:০০:০০ | অনলাইন সংস্করণ
আপনাদের শুরুর সময়ের সাহিত্যের পরিবেশ কেমন ছিল?
: প্রবীণরা আমাদের লেখক হয়ে ওঠার ব্যাপারে আমাদের সেই কাঁচা লেখাগুলো নিয়ে যে ধরনের আলোচনা-সমালোচনা করা প্রয়োজন সেটা করতেন। আমাদের শহরে অনেক সাহিত্য সংগঠন ছিল। প্রায় নিয়মিতই সাহিত্যসভা হতো। সেসব সভায় অংশ নিতাম। লেখা পড়তাম। কোনো কোনো সময় লেখা নিয়ে এমন আলোচনা হয়েছে যে, রাগে ক্ষোভে টপ টপ করে অশ্রু ঝরিয়েছি। এখন সে রকম সাহিত্য সভাও হয় না। এখন অনেককেই দেখি কম্পিউটারে লেখে, প্রকাশক ঠিক করে, টাকা দেয়, সুন্দর প্রচ্ছদে বই প্রকাশ হয়ে যায়। আমাদের সময়ের মতো পত্রপত্রিকা কিংবা সংকলনগুলোতে লিখে লেখক হওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে, সেটা মনে করে না। তবে ব্যতিক্রম এক-দুজন তো আছেই।
প্রযুক্তির এ পুঁজিবাদী সময়ে একজন লেখক তার লেখকসত্ত্বাকে কতটা লালন করতে পারে?
: যে সত্যিকারের লেখক, তিনি লেখায়ই নিমগ্ন থাকেন। আমাদের অনেক খ্যাতিমান লেখক এখনো হাতেই লিখে পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন। তবে এটা ঠিক, প্রযুক্তির উৎকর্ষ লেখকের প্রকাশনাকে উজ্জ্বল করেছে। আর অর্থের ঝনঝনানি আমাকে টানে না। এ পুঁজিবাদী সময়েও (অন্যদের কথা জানি না) আমি আমার লেখকসত্ত্বাকে কেবল লালন নয়, পালনও করছি।
লেখক হওয়ার জন্য শহরে/কেন্দ্রে চলে আসার প্রবণতাকে কীভাবে দেখেন?
: আমি তো সারা জীবন মফস্বলে থেকেই লেখালেখি করলাম। আমার লেখক পরিচিতি না থাকলে আপনি কি সাক্ষাৎকার নিতেন? আমাদের বন্ধু গল্পকার আকমল হোসেন নিপু গ্রামের ছেলে বলেই পরিচয় দেন। লেখক হওয়ার জন্য তার তো কেন্দ্রে যেতে হয়নি। লেখক হওয়ার জন্য লেখার শক্তিই প্রধান।
বর্তমানে সাহিত্যে কোন বিষয়গুলো প্রাধান্য পাচ্ছে। কোন বিষয়গুলো বেশি প্রাধান্য পাওয়া উচিত?
: ইতিহাস ঐতিহ্যাশ্রিত সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে কম। পরিশ্রমী লেখা খুব কম হচ্ছে। মানিক, বিভূতি, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহিদুল জহীর কিংবা আহমদ ছফার মতো লেখক এখন তৈরি হচ্ছে না
দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় ভালোবাসার সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন?
: ভালোবাসা আমার কাছে মমত্ব। মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ব আছে বলেই এখনো সভ্যতা টিকে আছে। মানুষ কেবল মানুষকেই ভালোবাসে না; সে প্রকৃতিকেও ভালোবাসে। আমার জেলায় আছে লাউয়াছড়া বন। আমি দেখি একটি সাপ, একটি পাখি, একটি বিলুপ্তপ্রায় ব্যাঙকে বাঁচানোর জন্য মানুষের সে কি চেষ্টা। সব মানুষের ভেতরের মমত্ব জাগ্রত হলে এ পৃথিবী মানুষেরই হবে। যুদ্ধবাজ পুতিন-বাইডেনরা নিপাত যাবে।
আমাদের বর্তমান সাহিত্যে প্রকৃতি মানুষ জীবন কতটা নিজস্ব সৌন্দর্যে বহমান, কতটা বিকৃতির শিকার?
: মানুষের অবস্থান ছাড়া সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে আমার জানা নেই। মানুষ থাকলে তার জীবনের কথা সেই সঙ্গে প্রকৃতিও থাকতেই হবে। এ সবের মিশেলে সৃষ্ট সাহিত্য সৌন্দর্যে ভরপুর। আমরা স্মরণ করতে পারি ‘পথের পাঁচালী’র কথা। যাদের লেখায় কেবল কোনো এক মানুষ কিংবা একটি দলের স্তুতি লেখা হয়েছে, আমার বিবেচনায় তাদের পুরো সাহিত্য কর্মই বিকৃতির শিকার।
প্রযুক্তির ব্যবহার সাহিত্যের জন্য কতটা ভালো কতটা মন্দ?
: ভালো মন্দ দুটিই আছে। যারা যেভাবে ব্যবহার করে তা ওপর সেটা নির্ভর করে। আমি কম্পিউটারে লিখলে, আমার জন্য সম্পাদনা সহজ হয়। আর ফেসবুকের কথা বললে আমি বলব; বিরক্ত, বিরক্ত বিরক্ত।
মৌলভীবাজার জেলার সাহিত্যচর্চার বর্তমান অবস্থা কেমন? কোন কোন দিকে যত্ন নিলে আরও সক্রিয় হতে পারে?
: ভালো, বেশ ভালো। গত নব্বইয়ের দশকে সাপ্তাহিক মনুবার্তা প্রকাশ হওয়ার পর প্রতি সাপ্তাহে ৪ পৃষ্ঠা সাহিত্য পাতা ছাপা হতো। প্রায় দুই দশক মনুবার্তা মৌলভীবাজার জেলার সাহিত্যাঙ্গনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ওই সময় অনেক তরুণ মনুবার্তাতে লেখালেখি করে বেশ সুনাম কুড়িয়েছিল। তাদের অনেকেই এখন সারা দেশের সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত। মনুবার্তার মালিকানা পরিবর্তন হয়ে এখন অনিয়মিতভাবে প্রকাশ হচ্ছে। তবে সাহিত্যপাতা আর প্রকাশ হয় না। সেই মনুবার্তার মতো স্থানীয় কোনো পত্রিকা ভালো একজন সাহিত্য সম্পাদক রেখে নিয়মিত সাহিত্য পাতা করলে মৌলভীবাজারের সাহিত্যাঙ্গন আবারও উজ্জীবিত হবে।
বর্তমানে রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত?
: রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের জনগণের চোখের ভাষা, মনের ভাষা বোঝার জন্য ভেতরের মমত্ব জাগ্রত করতে হবে।
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
সত্যিকারের লেখক লেখায়ই নিমগ্ন থাকে: আবদুল হামিদ মাহবুব
জন্ম ১৪ ডিসেম্বর ১৯৬৩। লেখালেখি শুরু আশির দশকে। গল্প কবিতা প্রবন্ধ ছড়াসহ সাহিত্যের সব শাখায়ই তার বিচরণ। পেশায় সাংবাদিক। পেশাগত কারণে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নিয়মিত কাজ করছেন। ছোট বয়সে শিশু কিশোর সংগঠন চাঁদের হাটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সমাজকর্ম শুরু করেন। নিজের এলাকায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত। ইতোমধ্যে একাধিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৮৮ সালে তিনি সাপ্তাহিক একতার সারা দেশের ‘শ্রেষ্ঠ সাংবাদিক’ হিসাবে পুরস্কৃত হয়েছেন।
আপনাদের শুরুর সময়ের সাহিত্যের পরিবেশ কেমন ছিল?
: প্রবীণরা আমাদের লেখক হয়ে ওঠার ব্যাপারে আমাদের সেই কাঁচা লেখাগুলো নিয়ে যে ধরনের আলোচনা-সমালোচনা করা প্রয়োজন সেটা করতেন। আমাদের শহরে অনেক সাহিত্য সংগঠন ছিল। প্রায় নিয়মিতই সাহিত্যসভা হতো। সেসব সভায় অংশ নিতাম। লেখা পড়তাম। কোনো কোনো সময় লেখা নিয়ে এমন আলোচনা হয়েছে যে, রাগে ক্ষোভে টপ টপ করে অশ্রু ঝরিয়েছি। এখন সে রকম সাহিত্য সভাও হয় না। এখন অনেককেই দেখি কম্পিউটারে লেখে, প্রকাশক ঠিক করে, টাকা দেয়, সুন্দর প্রচ্ছদে বই প্রকাশ হয়ে যায়। আমাদের সময়ের মতো পত্রপত্রিকা কিংবা সংকলনগুলোতে লিখে লেখক হওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে, সেটা মনে করে না। তবে ব্যতিক্রম এক-দুজন তো আছেই।
প্রযুক্তির এ পুঁজিবাদী সময়ে একজন লেখক তার লেখকসত্ত্বাকে কতটা লালন করতে পারে?
: যে সত্যিকারের লেখক, তিনি লেখায়ই নিমগ্ন থাকেন। আমাদের অনেক খ্যাতিমান লেখক এখনো হাতেই লিখে পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন। তবে এটা ঠিক, প্রযুক্তির উৎকর্ষ লেখকের প্রকাশনাকে উজ্জ্বল করেছে। আর অর্থের ঝনঝনানি আমাকে টানে না। এ পুঁজিবাদী সময়েও (অন্যদের কথা জানি না) আমি আমার লেখকসত্ত্বাকে কেবল লালন নয়, পালনও করছি।
লেখক হওয়ার জন্য শহরে/কেন্দ্রে চলে আসার প্রবণতাকে কীভাবে দেখেন?
: আমি তো সারা জীবন মফস্বলে থেকেই লেখালেখি করলাম। আমার লেখক পরিচিতি না থাকলে আপনি কি সাক্ষাৎকার নিতেন? আমাদের বন্ধু গল্পকার আকমল হোসেন নিপু গ্রামের ছেলে বলেই পরিচয় দেন। লেখক হওয়ার জন্য তার তো কেন্দ্রে যেতে হয়নি। লেখক হওয়ার জন্য লেখার শক্তিই প্রধান।
বর্তমানে সাহিত্যে কোন বিষয়গুলো প্রাধান্য পাচ্ছে। কোন বিষয়গুলো বেশি প্রাধান্য পাওয়া উচিত?
: ইতিহাস ঐতিহ্যাশ্রিত সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে কম। পরিশ্রমী লেখা খুব কম হচ্ছে। মানিক, বিভূতি, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহিদুল জহীর কিংবা আহমদ ছফার মতো লেখক এখন তৈরি হচ্ছে না
দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় ভালোবাসার সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন?
: ভালোবাসা আমার কাছে মমত্ব। মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ব আছে বলেই এখনো সভ্যতা টিকে আছে। মানুষ কেবল মানুষকেই ভালোবাসে না; সে প্রকৃতিকেও ভালোবাসে। আমার জেলায় আছে লাউয়াছড়া বন। আমি দেখি একটি সাপ, একটি পাখি, একটি বিলুপ্তপ্রায় ব্যাঙকে বাঁচানোর জন্য মানুষের সে কি চেষ্টা। সব মানুষের ভেতরের মমত্ব জাগ্রত হলে এ পৃথিবী মানুষেরই হবে। যুদ্ধবাজ পুতিন-বাইডেনরা নিপাত যাবে।
আমাদের বর্তমান সাহিত্যে প্রকৃতি মানুষ জীবন কতটা নিজস্ব সৌন্দর্যে বহমান, কতটা বিকৃতির শিকার?
: মানুষের অবস্থান ছাড়া সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে আমার জানা নেই। মানুষ থাকলে তার জীবনের কথা সেই সঙ্গে প্রকৃতিও থাকতেই হবে। এ সবের মিশেলে সৃষ্ট সাহিত্য সৌন্দর্যে ভরপুর। আমরা স্মরণ করতে পারি ‘পথের পাঁচালী’র কথা। যাদের লেখায় কেবল কোনো এক মানুষ কিংবা একটি দলের স্তুতি লেখা হয়েছে, আমার বিবেচনায় তাদের পুরো সাহিত্য কর্মই বিকৃতির শিকার।
প্রযুক্তির ব্যবহার সাহিত্যের জন্য কতটা ভালো কতটা মন্দ?
: ভালো মন্দ দুটিই আছে। যারা যেভাবে ব্যবহার করে তা ওপর সেটা নির্ভর করে। আমি কম্পিউটারে লিখলে, আমার জন্য সম্পাদনা সহজ হয়। আর ফেসবুকের কথা বললে আমি বলব; বিরক্ত, বিরক্ত বিরক্ত।
মৌলভীবাজার জেলার সাহিত্যচর্চার বর্তমান অবস্থা কেমন? কোন কোন দিকে যত্ন নিলে আরও সক্রিয় হতে পারে?
: ভালো, বেশ ভালো। গত নব্বইয়ের দশকে সাপ্তাহিক মনুবার্তা প্রকাশ হওয়ার পর প্রতি সাপ্তাহে ৪ পৃষ্ঠা সাহিত্য পাতা ছাপা হতো। প্রায় দুই দশক মনুবার্তা মৌলভীবাজার জেলার সাহিত্যাঙ্গনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ওই সময় অনেক তরুণ মনুবার্তাতে লেখালেখি করে বেশ সুনাম কুড়িয়েছিল। তাদের অনেকেই এখন সারা দেশের সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত। মনুবার্তার মালিকানা পরিবর্তন হয়ে এখন অনিয়মিতভাবে প্রকাশ হচ্ছে। তবে সাহিত্যপাতা আর প্রকাশ হয় না। সেই মনুবার্তার মতো স্থানীয় কোনো পত্রিকা ভালো একজন সাহিত্য সম্পাদক রেখে নিয়মিত সাহিত্য পাতা করলে মৌলভীবাজারের সাহিত্যাঙ্গন আবারও উজ্জীবিত হবে।
বর্তমানে রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত?
: রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের জনগণের চোখের ভাষা, মনের ভাষা বোঝার জন্য ভেতরের মমত্ব জাগ্রত করতে হবে।