প্রকৃতিবিমুখতা অসুস্থতারই লক্ষণ: রফিকুর রশীদ
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : জুননু রাইন
প্রকাশ: ১৬ জুন ২০২২, ০৬:০০ পিএম
রফিকুর রশীদ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সত্তর দশকের শেষভাগে গল্প লেখার মধ্য দিয়েই কথাসাহিত্যিক রফিকুর রশীদের (জন্ম-১৯৫৭) আত্মপ্রকাশ। তারপর যোগ হয়েছে উপন্যাস। প্রধানত গ্রামীণ পটভূমিতেই গড়ে উঠেছে তার গল্পের পরিমণ্ডল। তার গল্পে জীবনের তলানি পর্যন্ত দেখা যায় স্ফটিক স্বচ্ছতায়। মুক্তিযুদ্ধ তার সবচেয়ে প্রিয় প্রসঙ্গ। ‘প্রস্তুতিপর্ব’, ‘দাঁড়াবার সময়’ এবং ‘ছায়ার পুতুল’-মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধোত্তর সময়ের প্রেক্ষাপটে লেখা এ তিনটি উপন্যাসে একদিকে যেমন তার ইতিহাসলগ্নতার পরিচয় মেলে, অন্যদিকে তার চরিত্রচিত্রণের দক্ষতাও স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।
রফিকুর রশীদ এরই মধ্যে কথাসাহিত্য রচনার জন্য নিজস্ব গদ্যরীতিও নির্মাণ করে নিয়েছেন এবং আঞ্চলিক বাকভঙ্গি তার গদ্যের প্রাণসম্পদ হয়ে উঠেছে।
আপনাদের শুরুর সময়ের সাহিত্যের পরিবেশ এখনকার পরিবেশে মিলালে ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনো ভিন্নতা চোখে পড়ে?
: আমার সাহিত্যচর্চার সূচনা হয় সত্তর দশকের শেষ প্রান্তে। নিভৃত মফস্বলের গ্রামীণ পরিবেশে আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং সাহিত্যবোধের জাগৃতি। সাহিত্যপাঠই ছিল আমাদের সময়ে সাহিত্যবোধ গঠনের প্রধান উপাদান, আমরা বই পড়েই নিজেদের প্রস্তুত করেছি। এখন হাতের কাছে পর্যাপ্ত বই এবং অনেক মূল্যবান বইয়ের ই-ভার্সন পাওয়া যাচ্ছে; তবু পাঠপ্রবণতা হ্রাস পাচ্ছে। এখনকার পরিবেশের নেতিবাচকতা এইখানে।
প্রযুক্তির এ পুঁজিবাদী সময়ে একজন লেখক তার লেখকসত্ত্বাকে কতটা লালন করতে পারে?
: প্রযুক্তির এ পুঁজিবাদী সময়ে করপোরেট হাউজগুলো নানাবিধ পদক-পুরস্কারের টোপ দিয়ে প্রতিভা কিনে নিয়ে বশংবদ লেখক-চক্র তৈরিতে তৎপর হচ্ছে বা হবে সেটা ঠিক, তবু প্রকৃত লেখক সেই ফাঁদে পা দেবেন না। লেখক তার লেখকসত্তা লালন করবেন নিজের মতো করেই।
লেখক হওয়ার জন্য শহরে/কেন্দ্রে চলে আসার প্রবণতাকে কীভাবে দেখেন?
: প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের এই দিনে কেন্দ্রে আর প্রান্তে বিশেষ তফাৎ থাকার কথা নয়। ফলে লেখক হওয়ার জন্য কেন্দ্রে ছুটে যেতেই হবে, এর কোনো মানে নেই। নিজের সাধনা ও একাগ্রতা দিয়ে নিজেকেই ‘কেন্দ্র’ করে তুলতে হবে। তখন তথাকথিত কেন্দ্র ঠিকই নড়েচড়ে উঠবে।
বর্তমানে সাহিত্যে কোন বিষয়গুলো প্রাধান্য পাচ্ছে। কোন বিষয়গুলো বেশি প্রাধান্য পাওয়া উচিত?
: বর্তমানে সাহিত্যে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার প্রাধান্য বেশি চোখে পড়ে। ব্যক্তিক হয়েও সাহিত্যকে সামষ্টিক হয়ে উঠতে হবে। বাঙালি সমাজের দীর্ঘকালের লালিত বন্ধনগুলো এ সময়ে অতি দ্রুত আলগা হয়ে যাচ্ছে। ভাঙনের এবং বিচ্ছিন্নতার এ ছবি যথাযথভাবে সাহিত্যে ফুটিয়ে তোলার দায় বর্তমানের সাহিত্য কর্মীর।
দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় ভালোবাসার সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন?
: মানুষে-মানুষে আস্থা এবং বিশ্বস্ততার জমিনে এখন ফাটল ধরেছে, ফলে ভালোবাসারও গভীরতা হারিয়েছে বলে আমার ধারণা।
আমাদের বর্তমান সাহিত্যে প্রকৃতি মানুষ জীবন কতটা নিজস্ব সৌন্দর্যে বহমান, কতটা বিকৃতির শিকার?
: প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক যে অবিচ্ছেদ্য, প্রবল যান্ত্রিকতার এ সময়ে সে কথা আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি। প্রকৃতির দিকে চোখ মেলে তাকাতে শিখিনি, প্রকৃতির কাছে কোনো পাঠ নিতে শিখিনি, খাঁচাবন্দি জীবন যেন প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এর পরিণতি খুবই ভয়াবহ। প্রকৃতিবিমুখতা অসুস্থতারই লক্ষণ। এখান থেকেই আসে নানা রকম বৈকল্য ও বিকৃতি।
মেহেরপুর জেলার সাহিত্যচর্চার বর্তমান অবস্থা কেমন? কোন কোন দিকে যত্ন নিলে আরও সক্রিয় হতে পারে?
: মেহেরপুর জেলার সাহিত্যচর্চার বর্তমান অবস্থা মোটেই আশাপ্রদ নয়, মানতে দ্বিধা নেই-অতীতেও তেমন ছিল না। সাতচল্লিশের দেশভাগের (এবং শিক্ষিত হিন্দু পরিবারের দেশত্যাগের) পর পূর্ব বাংলার এ সীমান্ত অঞ্চলে সত্যিকার অর্থে সাহিত্যচর্চার ধারা গড়ে ওঠেনি বললেই চলে। শিক্ষা ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ এ জেলায় যে দু-একটি সাহিত্য সংগঠন আছে, তা নানাবিধ সংকটে জর্জরিত। এখানকার সাহিত্যকর্মীরাও সাফল্যের জন্য শর্টকাট রাস্তা খোঁজে, নিবিষ্ট সাধনায় ব্রতী হতে আগ্রহী নয়।
বর্তমানে রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক কেমন? কেমন হওয়া উচিত?
: বর্তমানে রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক বড়ই শিথিল বলে মনে করি। পরিচয়ে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ বলা হলেও এ প্রজাতন্ত্রের কোনো কিছুর সঙ্গেই গণমানুষের নিবিড় সম্পর্ক নেই। বড় কিছু বুঝে অথবা না বুঝে এ দেশের মানুষ ভোটের মৌসুমে যে আনন্দময় অংশগ্রহণ করে আসছে, সাম্প্রতিক অতীতে নির্বাচনি প্রক্রিয়া বিপর্যস্ত হওয়ার পর সেখানেও হতাশা এবং উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে।
রাষ্ট্রের সব কর্মকাণ্ডে জনমতের প্রতিফলন সুষ্ঠু ঘটলেই রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক সুন্দর ও স্বাভাবিক হতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। ধন্যবাদ।
