একুশের বইমেলা আশা ও আশঙ্কার আলোছায়া
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৩:৪০:৪৭ | অনলাইন সংস্করণ
এ বছর বইমেলায় আমি একদিনই গেছি। মেলায় গিয়ে ভালো-মন্দ কয়েকটি বিষয় লক্ষ করেছি। যা আমাকে একদিকে আশাবাদী করেছে। অন্যদিকে বিষণ্ন বোধ করেছি। আশাবাদী হয়েছি এটা দেখে যে, গত কয়েক বছর মেলায় বই বিক্রির মন্দার অবসান ঘটিয়ে এ বছরের মেলা স্বাভাবিকতায় ফিরেছে। আমি চকিত জরিপে লক্ষ করেছি, মেলায় আসা মানুষের মধ্যে প্রতি দশজনে প্রায় সাতজনই বই হাতে ফিরছেন।
মেলার এ দৃশ্য আমাকে আশাবাদী করেছে। পাশাপাশি যা আমাকে বিষণ্ন করেছে তা হচ্ছে মেলার প্রবেশপথে আবর্জনার স্তূপ। যেন ভাগাড়। দেশের প্রধানমন্ত্রী যে মেলার উদ্বোধন করেন, সে মেলা এত অপরিচ্ছন্ন কেন হবে? মেলা প্রাঙ্গণের বিশৃঙ্খলার বিষয়টি বলা প্রয়োজন, বিশেষ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অংশে গত কয়েক বছরের তুলনায় অব্যবস্থা প্রকটভাবে দৃষ্টিগোচর হয়েছে। স্বচ্ছন্দে চলাচলের জন্য উদ্যান চত্বরকে যথেষ্ট সমতল করা হয়নি। মেলা প্রাঙ্গণের ধুলা নিবারণের ব্যবস্থা করা হয়নি। মেলায় আসা পাঠক ও ক্রেতাদের জন্য মেলা প্রাঙ্গণের স্টল, প্যাভিলিয়নগুলো কীভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে তার কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় দর্শনার্থীদের পছন্দের স্টল খুঁজে পেতে সময় নষ্ট হয়েছে। মেলা প্রাঙ্গণের নোংরা অপসারণের কোনো উদ্যোগ ছিল বলে মনে হয়নি। অথচ একটু উদ্যোগী হলেই এ কাজগুলো সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা যেত।
আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ, স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলছি-একটু সচেষ্ট হলেই মেলার স্টল বিন্যাসের দিকনির্দেশনা দিয়ে মেলার প্রবেশপথে ডিজিটাল বোর্ড রাখার পাশাপাশি ফোনের অ্যাপও তৈরি করা যেত। যা দর্শনার্থীদের তথ্যকেন্দ্র থেকে বা নেট থেকে তাদের ফোনে নিয়ে নিতে পারতেন।
গত কয়েক মেলায় লক্ষ করছি, প্রচুর বই বের হচ্ছে মেলা উপলক্ষ্যে। এগুলোর বেশিরভাগই মানসম্পন্ন নয়, বই প্রকাশের এ প্রবণতা শঙ্কার কারণ হয়ে উঠছে এ কারণে যে, এতে মানসম্পন্ন বইয়ের উপস্থিতি গুরুত্ব হারাচ্ছে ভিড়ের কারণে।
মেলায় তরুণদের অনেক বই বের হোক সেটি আমাদের কাম্য। কিন্তু সেগুলো মানসম্পন্ন হতে হবে। না হলে আমাদের তরুণদের সম্পর্কে ভুল বার্তা, ভুল মূল্যায়নের আশঙ্কা দেখা দেবে-যা কোনোভাবেই গ্রহণীয় নয়। ফলে এ ব্যাপারে সবাইকেই সচেতন হতে হবে, প্রকাশকদেরও। এক্ষেত্রে কোনো শিথিলতা যেন না থাকে। অসম্পাদিত, ভুলে ভরা পাণ্ডুলিপি বই হিসাবে মেলার মাঠে উপস্থিত হলে তা পাঠকের বিভ্রান্তির কারণ হবে। আরেকটি বিষয়, মেলায় বই নিষিদ্ধ করা কোনো ভালো পদক্ষেপ নয়। এতেও ভুল বার্তা যায় সচেতন মহলে। অপ্রয়োজনীয় কিংবা অপ্রাসঙ্গিক বইয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার পাঠকদের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। বই নিষিদ্ধ করা, স্টল নিষিদ্ধ করাকে আমার কাছে সঠিক বলে মনে হয় না। সহনশীল আচরণ বলেও মনে হয় না।
পরমতসহিষ্ণুতার কোনো বিকল্প নেই। সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র তৈরি হয় মানুষের চিন্তায়। রাজনীতি হচ্ছে মানুষের লাভ, আমার ক্ষতি। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা না থাকলে, রাজনীতি উন্নত না হলে, সংস্কৃতি উন্নত হয় না; আর সংস্কৃতি উন্নত না হলে অর্থনৈতিক উন্নতিটা বৈষম্যহীন হতে পারে না। গণতান্ত্রিক সমাজের সৌন্দর্যই তো ভিন্নমত ও পথের মানুষের সহাবস্থানে। সবাই একই মত ও পথের হলে সমাজ তার সৃজনশীলতা হারাবে। অচল স্থবিরতার গ্রাসে পড়বে। আমাদের সব অগ্রগতি, অর্জন, উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়বে।
আমাদের বইমেলা প্রাঙ্গণকে যেমন পরিষ্কার রাখতে হবে, তেমনি চিন্তার ক্ষেত্রটিকেও রাখতে হবে অবশ্যই পরিষ্কার।
অনুলিখন : শুচি সৈয়দ
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
একুশের বইমেলা আশা ও আশঙ্কার আলোছায়া
এ বছর বইমেলায় আমি একদিনই গেছি। মেলায় গিয়ে ভালো-মন্দ কয়েকটি বিষয় লক্ষ করেছি। যা আমাকে একদিকে আশাবাদী করেছে। অন্যদিকে বিষণ্ন বোধ করেছি। আশাবাদী হয়েছি এটা দেখে যে, গত কয়েক বছর মেলায় বই বিক্রির মন্দার অবসান ঘটিয়ে এ বছরের মেলা স্বাভাবিকতায় ফিরেছে। আমি চকিত জরিপে লক্ষ করেছি, মেলায় আসা মানুষের মধ্যে প্রতি দশজনে প্রায় সাতজনই বই হাতে ফিরছেন।
মেলার এ দৃশ্য আমাকে আশাবাদী করেছে। পাশাপাশি যা আমাকে বিষণ্ন করেছে তা হচ্ছে মেলার প্রবেশপথে আবর্জনার স্তূপ। যেন ভাগাড়। দেশের প্রধানমন্ত্রী যে মেলার উদ্বোধন করেন, সে মেলা এত অপরিচ্ছন্ন কেন হবে? মেলা প্রাঙ্গণের বিশৃঙ্খলার বিষয়টি বলা প্রয়োজন, বিশেষ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অংশে গত কয়েক বছরের তুলনায় অব্যবস্থা প্রকটভাবে দৃষ্টিগোচর হয়েছে। স্বচ্ছন্দে চলাচলের জন্য উদ্যান চত্বরকে যথেষ্ট সমতল করা হয়নি। মেলা প্রাঙ্গণের ধুলা নিবারণের ব্যবস্থা করা হয়নি। মেলায় আসা পাঠক ও ক্রেতাদের জন্য মেলা প্রাঙ্গণের স্টল, প্যাভিলিয়নগুলো কীভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে তার কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় দর্শনার্থীদের পছন্দের স্টল খুঁজে পেতে সময় নষ্ট হয়েছে। মেলা প্রাঙ্গণের নোংরা অপসারণের কোনো উদ্যোগ ছিল বলে মনে হয়নি। অথচ একটু উদ্যোগী হলেই এ কাজগুলো সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা যেত।
আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ, স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলছি-একটু সচেষ্ট হলেই মেলার স্টল বিন্যাসের দিকনির্দেশনা দিয়ে মেলার প্রবেশপথে ডিজিটাল বোর্ড রাখার পাশাপাশি ফোনের অ্যাপও তৈরি করা যেত। যা দর্শনার্থীদের তথ্যকেন্দ্র থেকে বা নেট থেকে তাদের ফোনে নিয়ে নিতে পারতেন।
গত কয়েক মেলায় লক্ষ করছি, প্রচুর বই বের হচ্ছে মেলা উপলক্ষ্যে। এগুলোর বেশিরভাগই মানসম্পন্ন নয়, বই প্রকাশের এ প্রবণতা শঙ্কার কারণ হয়ে উঠছে এ কারণে যে, এতে মানসম্পন্ন বইয়ের উপস্থিতি গুরুত্ব হারাচ্ছে ভিড়ের কারণে।
মেলায় তরুণদের অনেক বই বের হোক সেটি আমাদের কাম্য। কিন্তু সেগুলো মানসম্পন্ন হতে হবে। না হলে আমাদের তরুণদের সম্পর্কে ভুল বার্তা, ভুল মূল্যায়নের আশঙ্কা দেখা দেবে-যা কোনোভাবেই গ্রহণীয় নয়। ফলে এ ব্যাপারে সবাইকেই সচেতন হতে হবে, প্রকাশকদেরও। এক্ষেত্রে কোনো শিথিলতা যেন না থাকে। অসম্পাদিত, ভুলে ভরা পাণ্ডুলিপি বই হিসাবে মেলার মাঠে উপস্থিত হলে তা পাঠকের বিভ্রান্তির কারণ হবে। আরেকটি বিষয়, মেলায় বই নিষিদ্ধ করা কোনো ভালো পদক্ষেপ নয়। এতেও ভুল বার্তা যায় সচেতন মহলে। অপ্রয়োজনীয় কিংবা অপ্রাসঙ্গিক বইয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার পাঠকদের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। বই নিষিদ্ধ করা, স্টল নিষিদ্ধ করাকে আমার কাছে সঠিক বলে মনে হয় না। সহনশীল আচরণ বলেও মনে হয় না।
পরমতসহিষ্ণুতার কোনো বিকল্প নেই। সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র তৈরি হয় মানুষের চিন্তায়। রাজনীতি হচ্ছে মানুষের লাভ, আমার ক্ষতি। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা না থাকলে, রাজনীতি উন্নত না হলে, সংস্কৃতি উন্নত হয় না; আর সংস্কৃতি উন্নত না হলে অর্থনৈতিক উন্নতিটা বৈষম্যহীন হতে পারে না। গণতান্ত্রিক সমাজের সৌন্দর্যই তো ভিন্নমত ও পথের মানুষের সহাবস্থানে। সবাই একই মত ও পথের হলে সমাজ তার সৃজনশীলতা হারাবে। অচল স্থবিরতার গ্রাসে পড়বে। আমাদের সব অগ্রগতি, অর্জন, উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়বে।
আমাদের বইমেলা প্রাঙ্গণকে যেমন পরিষ্কার রাখতে হবে, তেমনি চিন্তার ক্ষেত্রটিকেও রাখতে হবে অবশ্যই পরিষ্কার।
অনুলিখন : শুচি সৈয়দ