পুলিৎজার জিতল পার্সিভাল এভারেটের উপন্যাস ‘জেমস’

মেজবাহ উদ্দিন
প্রকাশ: ০৯ মে ২০২৫, ০৫:৪৩ পিএম

দীর্ঘশ্বাসের কালিতে লেখা হয় সেসব পাঠের অক্ষর, হৃদয়ের ক্ষরিত রক্তে আর্দ্র তার প্রতিটি পাতা। এমন সময় সাহিত্যের ভালো খবরগুলোই আমাদের দেয় মুক্তির সন্ধান। পার্সিভাল এভারেটের উপন্যাস ‘জেমস’র পুলিৎজার পুরস্কার বিজয় তেমনি একটা বিষয়। আমেরিকান সাহিত্যে এটি একটি যুগান্তকরী মুহূর্ত হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। মার্ক টোয়েনের ‘হাকলবেরি ফিন’র অদৃশ্য চরিত্র জিমকে কেন্দ্রে এনে রচিত এ উপন্যাস কেবল একটি ক্লাসিক পুনর্কথন নয়, বরং ঔপনিবেশিক ও বর্ণবাদী অতীতের সমালোচনামূলক পুনর্পাঠন।
এভারেট, যার সাহিত্যিক সত্তা বরাবরই প্রথাবিরোধী ও বিদ্রুপাত্মক, এখানে জিমের কণ্ঠকে নতুন মাত্রা দিয়েছেন-তাকে পরিণত করেছেন আখ্যানের কর্তৃত্বশীল নায়কে, যার ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা, পরিচয় এবং ভাষার রাজনীতি উন্মোচিত হয়। পার্সিভাল এভারেটের উপন্যাস ‘জেমস’ শুধু একটি সাহিত্যকর্ম নয়; এটি একটি সাংস্কৃতিক ঘোষণাপত্র, ইতিহাসের পুনর্পাঠ এবং মানবিক পরিচয়ের জটিল দ্বন্দ্বের এক আয়না। পুলিৎজার জুরিদের মতে, ‘এই উপন্যাস শেকলভাঙা ভাষার শক্তি দিয়ে আমেরিকান সাহিত্যকে আবার সংজ্ঞায়িত করেছে।’
পার্সিভাল এভারেট সমকালীন আমেরিকান সাহিত্যের এক ব্যতিক্রমী ও সাহসী লেখক হিসাবে সুপরিচিত। ‘জেমস’ উপন্যাসের মাধ্যমে এভারেট একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু প্রয়োজনীয় সাহিত্যিক চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন। ‘হাকলবেরি ফিন’ আমেরিকান সাহিত্যের অন্যতম ভিত্তিস্তম্ভ হলেও, জিম চরিত্রটির সরলীকরণ এবং বর্ণবাদী স্টেরিওটাইপের ব্যবহার নিয়ে বহু দশক ধরে সমালোচনা চলে আসছে। এভারেট এ সমালোচনার জবাব দিয়েছেন জিমকে তার নিজস্ব কণ্ঠস্বর, বুদ্ধি এবং জটিল মনস্তত্ত্ব ফিরিয়ে দিয়ে। জেমসের কাহিনি শুরু হয় মার্ক টোয়েনের মূল গল্পের পটভূমিতে-মিসিসিপি নদীর তীরে, দাসপ্রথার যুগে। কিন্তু এভারেটের নায়ক জেমস (জিম) কেবল হাক ফিনের সহযাত্রী নয়; তিনি তার নিজস্ব যাত্রার নায়ক। নদীপথে পালানোর চেষ্টা করা এ দাসের গল্পটি এখানে পুনর্কথিত হয় তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গিতে। এভারেটের জিম চরিত্রটি টোয়েনের চিত্রায়ণের চেয়ে অনেক বেশি জটিল ও বুদ্ধিদীপ্ত; যে সচেতনভাবে নিজের বুদ্ধিমত্তা গোপন রেখে সাদা সমাজের প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করেন, যা তার আত্মরক্ষার কৌশল হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এভারেটের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জিম চরিত্রটির মানবিকীকরণ এবং গভীরতা প্রদান। মূল উপন্যাসে জিমের ভাষা এবং আচরণ অনেক সময় তার বুদ্ধিমত্তাকে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেনি। কিন্তু ‘জেমস’-এ আমরা এক অন্য জিমকে দেখতে পাই-যে গোপনে পড়তে শিখেছে, যে তার চারপাশের পৃথিবীকে তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করে এবং যে তার মুক্তির জন্য সুচিন্তিত পরিকল্পনা করে।
জেমসের যাত্রা শুধু শারীরিক মুক্তির জন্য নয়, বরং ভাষা, শিক্ষা, ও আত্মপরিচয়ের সংগ্রামের জন্য। তিনি লাতিন ও দর্শন জানেন, কিন্তু সাদা সমাজের সামনে নিজেকে ‘মূর্খ’ হিসাবে উপস্থাপন করেন বেঁচে থাকার কৌশলে। এ দ্বৈত জীবন-বাহ্যিক বশ্যতা ও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ-উপন্যাসের কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্ব। এটি দেখায় যে, কীভাবে নিপীড়িত মানুষ আত্মরক্ষার জন্য বিভিন্ন মুখোশ পরিধান করতে বাধ্য হয়। এভারেট জেমসের মাধ্যমে প্রশ্ন তোলেন : ‘স্বাধীনতা কী শুধু শারীরিক, নাকি মনের জেলখানা ভাঙাও জরুরি?’
আখ্যানভাগ মূলত জিমের দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণিত হলেও, এভারেট মাঝে মাঝে অন্যান্য চরিত্র এবং ঘটনার দিকেও দৃষ্টিপাত করেছেন, যা মূল গল্পের প্রেক্ষাপটকে আরও বিস্তৃত করেছে। উপন্যাসের গতি কখনো ধীর, কখনো দ্রুত, যা জিমের পলায়নের অনিশ্চয়তা এবং উত্তেজনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এভারেটের লেখার বৈশিষ্ট্য হলো প্রতীক ও বাক্যাংশের স্তরে বহুমাত্রিকতা। জেমস-এ ভাষাই হয়ে ওঠে মুক্তির হাতিয়ার। জেমস গোপনে বই পড়েন, শব্দের শক্তি চিনে নেন এবং বুঝতে পারেন যে, সাদা সমাজের শাসন টিকে আছে ভাষার দখলদারত্বের ওপর। একটি চাঞ্চল্যকর দৃশ্যে, তিনি শেক্সপিয়ার উদ্ধৃত করে একজন দাস ব্যবসায়ীকে বিভ্রান্ত করেন, যেন দেখান যে, সাহিত্য-জ্ঞান কেবল একটি জাতির সম্পত্তি নয়।
উপন্যাসের শিরোনামেই এভারেটের বিদ্রোহ। টোয়েনের বইয়ে চরিত্রটি ‘জিম’ নামে পরিচিত, যেটা বর্ণবাদী শ্রেণিবিন্যাসকে প্রতিফলিত করে। এভারেট সচেতনভাবে ‘জেমস’ নামটি বেছে নিয়ে তাকে পূর্ণ ব্যক্তিত্ব দেন-একটি নাম যা শ্রদ্ধা ও আত্মপরিচয়ের দাবিদার। আবার জেমসের ‘মূর্খ’ অভিনয় একটি রূপক। এটি কেবল বেঁচে থাকার কৌশল নয়, বরং শ্বেতাঙ্গ সমাজের বধিরতাকে বিদ্রুপ করার হাতিয়ার। তিনি জানেন, সত্যিকারের শক্তি লুকিয়ে আছে শত্রুর প্রত্যাশাকে ফাঁকি দেওয়ার মধ্যে। এ ধারণাটি মেকিয়াভেলির দ্য প্রিন্স-এর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ-ক্ষমতা অর্জন করতে হলে কখনো কখনো ভান করতে হয়। ‘জেমস’ পড়তে গিয়ে মনে হয়-মিসিসিপি নদী এখানে শুধু পটভূমি নয়; এটি ইতিহাসের প্রবাহমানতার প্রতীক। জেমসের নৌকাযাত্রা কালের স্রোতে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা- একটি অতীতকে পুনর্লিখন, যেখানে দাসত্বের নৈতিক ব্যাধিকে চিহ্নিত করা হয়।
এভারেটের সবচেয়ে সাহসী সিদ্ধান্ত হলো জেমসের কণ্ঠস্বরকে কেন্দ্র করে গল্প বর্ণনা করা। টোয়েনের বইয়ে ‘হাকলবেরি ফিন’র কথ্য ভাষা (আঞ্চলিক উপভাষা) ব্যবহার করা হয়েছিল, কিন্তু জেমসের ভাষা এখানে দ্বিবিধ। উদাহরণস্বরূপ : ‘সাদা মানুষরা ভাবে আমরা বুঝি না কমা-সেমিকোলনের খেলা। তারা জানে না, আমরা তাদের চেয়ে ভালো জানি কীভাবে শব্দ দিয়ে ফাঁদ পাতা যায়।’ এ দ্বৈত ভাষা কেবল চরিত্রের বুদ্ধিমত্তাই প্রকাশ করে না, বরং আমেরিকান সাহিত্যের ঐতিহ্যে ‘নিগ্রো ভয়েস’-এর প্রতিনিধিত্বের সমালোচনা করে। এভারেট যেন বলছেন : যখন কালো চরিত্রদের কথা বলার অধিকার শুধু সাদা লেখকের হাতে, তখন তাদের স্বর সর্বদা অসম্পূর্ণ!
‘জেমস’ কেবল অতীতের গল্প নয়; এটি বর্তমানের সঙ্গে সংলাপ করে। জর্জ ফ্লয়েডের পরবর্তী যুগে, যখন মার্কিন সমাজ পুলিশি বর্বরতা ও কনফেডারেট স্মৃতিচিহ্নগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে, এভারেটের উপন্যাস স্মরণ করিয়ে দেয় যে-বর্ণবাদের ভূত আজও মিসিসিপির জলে ভাসে। জেমসের সংগ্রাম-শিক্ষা, মাতৃভাষা এবং আইনি স্বাধীনতা অর্জন আজকের ব্ল্যাক লাইভ্স ম্যাটার আন্দোলনের প্রতিধ্বনি। উপন্যাসের একটি শক্তিশালী মুহূর্তে, জেমস একটি গির্জায় লুকিয়ে থাকা দাসদের গ্রিক দার্শনিক এপিকটেটাসের বাণী শেখান : ‘আমরা সবাই বন্দী, কিন্তু যারা নিজের মনকে মুক্ত রাখে, তারাই সত্যিকারের মুক্ত।’
‘জেমস’ উপন্যাসের পুলিৎজার জয় বিভিন্ন কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, এটি আফ্রিকান-আমেরিকান সাহিত্য এবং অভিজ্ঞতার প্রতি মূলধারার স্বীকৃতির একটি জোরালো প্রমাণ। এ উপন্যাসটি কেবল একটি সাহিত্যকর্ম নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক ভাষ্যও। এটি পাঠককে বাধ্য করে আমেরিকান ইতিহাসের অস্বস্তিকর সত্যগুলোর মুখোমুখি হতে এবং দীর্ঘদিন ধরে চাপা পড়ে থাকা কণ্ঠস্বরগুলোর প্রতি মনোযোগ দিতে। ‘জেমস’ প্রমাণ করে যে সাহিত্য কীভাবে অতীতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বর্তমানকে আলোকিত করতে পারে এবং ভবিষ্যতের জন্য নতুন পথনির্দেশ করতে পারে। উপন্যাসটি ২০২৪ সালে ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড, কার্নেগি মেডেল ফর ফিকশন এবং কিরকাস প্রাইজ অর্জন করে। এ ছাড়া এটি বুকার প্রাইজের জন্যও মনোনীত হয়েছিল। উপন্যাসটির চলচ্চিত্র রূপান্তরের অধিকার ইউনিভার্সাল পিকচার্স অধিগ্রহণ করেছে, যেখানে স্টিভেন স্পিলবার্গ নির্বাহী প্রযোজক হিসাবে যুক্ত আছেন এবং তাইকা ওয়াইটি পরিচালকের ভূমিকায় আলোচনায় রয়েছেন।
জেমস প্রকাশের পর সমালোচকদের মধ্যে তুমুল আলোচনা সৃষ্টি করে। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস এটিকে এভারেটের সবচেয়ে ‘আবেগপূর্ণ ও উত্তেজনাপূর্ণ’ উপন্যাস হিসাবে অভিহিত করেছে। দ্য গার্ডিয়ান এটিকে ‘একটি দার্শনিক পিকারেস্ক’ হিসাবে বর্ণনা করেছে, যা পাঠকদের চিন্তাভাবনায় নতুন মাত্রা যোগ করে। কিছু সমালোচক অভিযোগ করেন যে, এভারেট ‘টোয়েনের উত্তরাধিকারকে বিকৃত’ করেছেন। সাহিত্য সমালোচক জেসমিন ওয়ার্ড তার রিভিউতে লিখেছেন : ‘এভারেট শুধু একটি চরিত্রকে পুনরুজ্জীবিত করেননি; তিনি সাহিত্যের ইতিহাসকে একটি নৈতিক জিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন : কে কার গল্প বলার অধিকার রাখে?’
পার্সিভাল এভারেটের জেমস পুলিৎজার পুরস্কার জিতেছে শুধু সাহিত্যিক নৈপুণ্যের জন্য নয়, বরং এর নৈতিক সাহসের জন্য। এটি একটি গল্প যা ইতিহাসের খণ্ডিত কণ্ঠগুলোকে জোড়া লাগায় এবং পাঠককে জোর দিয়ে মনে করিয়ে দেয় : মুক্তি কোনো এককালীন ঘটনা নয়; এটি একটি চলমান সংলাপ, যেখানে প্রতিটি প্রজন্মকে পূর্বপুরুষের স্বরকে নতুন করে উচ্চারণ করতে হয়। এ উপন্যাসের শেষ লাইনে জেমস যেমন বলেন : ‘আমার গল্প শেষ হয়নি। কারণ মুক্তির গল্প কখনো শেষ হয় না।’ পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত এ উপন্যাসটি নিঃসন্দেহে আগামী প্রজন্মের পাঠক ও সমালোচকদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে এবং আমেরিকান সাহিত্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে বিবেচিত হবে। ‘জেমস’ শুধু একটি উপন্যাসের নাম নয়, এটি একটি হারানো কণ্ঠস্বরের বিজয় এবং মানবিক মর্যাদার এক বলিষ্ঠ ঘোষণা।
সূত্র : গার্ডিয়ান ও নিউইয়র্ক টাইমস