
জায়োনিস্টরা ফিলিস্তিনের ঘর নিয়ে নিয়েছে, জন্মস্থানের স্বর্ণের মাটি দখল করেছে, ফসলের বিস্তৃত খেত, শিশুদের খেলার উঠোন সব কেড়ে নিয়েছে; এমনকি কবরের দাবিদারও এখন তারা। বাবুললুতের প্রতিটি অলিগলি, যেখানে কোনো না কোনো শহিদের নাম লেখা ছিল মাটির ওপর, সেখানে আজ তারা বসিয়েছে নতুন নামফলক। কিন্তু তারা কখনোই ইতিহাস কেড়ে নিতে পারবে না-কারণ ইতিহাসের নাম রুশদিয়া। ওর অন্তরের বাড়ি, ওর জন্মবাড়ি, ওর চোখে নোনা জলোচ্ছ্বাস সবই বাবুললুত। আর বাবুললুতের অধিবাসীরা তাদের বুকের ভেতরে রেখে দিয়েছে রুশদিয়াকে।
বাবুললুত ফিলিস্তিনের প্রাচীনতম শহরগুলোর একটি, যেখান দিয়ে একদিন হজরত ইবরাহিম (আ.) হিজরত করেছিলেন, যার বুকে একদিন হজরত ঈসা (আ.)-এর পদচিহ্ন পড়েছিল। এই শহর একদিন ছিল জ্ঞান, প্রেম আর প্রজ্ঞায় বিকশিত। ছিল আকাশপানে তাকানো মানুষের আশ্রয়, সে আশ্রয় সূর্য উদয়ের অপূর্বর মতো সুন্দর যেন! কিন্তু সময়ের নীল বিষাক্ত কুয়াশা যখন গায়ে রক্ত ঢেলে দেয়, তখন ইতিহাস রূপ নেয় কান্নায়। ঐতিহ্য প্রত্নতত্ত্ব লুট হয়ে যায় বুটের তলায়। ফিলিস্তিনের প্রতীক ও প্রতিরোধের প্রতিচ্ছবি হাজার বছরের পুরোনো জলপাই গাছ, হেবরন অঞ্চলের আঙুর, গাজা উপত্যকার ডেট পাম, আখরোট, থাইম-সবই আজ অধিগত।
ফিলিস্তিনের মধ্যভাগে অবস্থিত এ শহরটি আজ যেন মৃতপ্রায়। আজ সেখানে শুধু বুটের আওয়াজ, কাদা ধুলোয় ভেসে যাওয়া নামহীন কবর, আর পুড়ে যাওয়া মাইলের পর মাইল দুঃখ-পৃষ্ঠা। ইসরাইলি দখলদারত্ব, অনবরত সামরিক অভিযান, বাড়িঘর ধ্বংস এবং নাগরিক অধিকার হরণ-এসবই আজ বাবুললুতবাসীর নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবু এর মাঝেই কিছু শিশু, কিছু মা, কিছু বৃদ্ধ এখনো মাটি আঁকড়ে বেঁচে আছেন। তারা চলে না সময়ের নিয়মে, তারা চলে প্রতিরোধের নিয়তিতে। তাদেরই একজন রুশদিয়া।
রুশদিয়া জানে-ওর জন্মঘর আর নেই। যেখানে মা মসজিদের মিহিন আজানের রেশম কণ্ঠের ধ্বনিতে ইফতারের ডাক দিতেন, দীদা খেজুরের রসের রুটি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন সবার জন্য পরম ভালোবাসায়। আর সে সময় যেখানে বড় ভাই ইয়াহিয়ার হাঁচি শুনে রুশদিয়া খিলখিল করে হাসত! যে উঠোনে বসে ওরা ইফতারে আখরোটের শরবত খেত মধু মিশিয়ে মায়ের হাতে, সে উঠোন আজ কাঁটাতারের নিচে ঢাকা পড়েছে। আর সে উঠোনঘেঁষা ঘরের বাগানটি এখন একটি সেনা ক্যাম্প। বন্দুকের নল উঁচিয়ে দখল করে নিয়েছে। রুশদিয়ারা প্রাণের ভয়ে আশ্রয় নিয়েছে গাজা উপত্যকায়। কিন্তু সেখানের অবস্থা আরও ভয়াবহ।
বর্তমানে ফিলিস্তিন, বিশেষ করে গাজা উপত্যকায়, মানবিক সংকট চরমে পৌঁছেছে। ইসরাইলের সামরিক অভিযান, বিমান হামলা এবং অবরোধের ফলে লক্ষাধিক মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত গাজায় প্রায় ৫ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এ ছাড়া গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ইসরাইলের হামলায় প্রায় ৫০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১ লাখ ১৫ হাজারের অধিক আহত হয়েছে, যার অধিকাংশই নারী ও শিশু। রুশদিয়া তাদেরই একজন, গৃহহীন, অন্ন, বস্ত্রহীন এক ফুটফুটে শিশু।
এ শহর রুশদিয়ার-একটি আট বছর বয়সি শিশু, যার চোখে ছিল পাথরের মতো স্থিরতা, কণ্ঠে ছিল কুরআনের আয়াত, আর হাতে ছিল একটি ভাঙা খাতা যেখানে সে আঁকত-‘একদিন ফিরবে ফিলিস্তিন।’ আর পাশে শুয়ে থাকা ইয়াহিয়ার মৃত্যু ছিল এক প্রলয়ের মতো-যেখানে পুরো বাবুললুত যেন থেমে গিয়েছিল এক নিঃশব্দ আহাজারিতে।
তখন ভোর, আজানের ধ্বনি শহরের ঘুম ভাঙাচ্ছিল। রুশদিয়া দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল, হাতে জায়তার আর জলপাইয়ের ঝাঁপি-ইয়াহিয়ার প্রিয় খাবার। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এলো গোলাগুলির শব্দ। রুশদিয়া ছুটে যেতে চাইল, কিন্তু তার মা আঁকড়ে ধরেছিল তাকে-যেন আঁধার ছেঁড়ার আগে আলোকে একটু ধরে রাখতে চায়। রুশদিয়ার শার্ট টেনে ধরে মা : ‘আমি আর নিঃস্ব হতে চাই না কোনোভাবেই।’
ষোলো বছরের ইয়াহিয়া তখন ছিল শহরের প্রান্তে, একটি পুরোনো জলপাই বাগানে-যেখানে তারা দুই ভাই রুশদিয়া এবং ইয়াহিয়া খেলত। সেদিন ইয়াহিয়া গিয়েছিল কয়েকজন প্রতিবেশীকে নিরাপদে অন্যপাশে পৌঁছে দিতে। কিন্তু এক ইহুদি সেনা হঠাৎ তাকে থামিয়ে দেয়। প্রবল অত্যাচারে চিৎকার করে ইয়াহিয়া বলেছিল, ‘আমি কোনো দোষ করিনি। মহান আল্লাহ জানেন। ওরা অসহায় নারী-শিশু, আমি শুধু পথ দেখাচ্ছি!’
কিন্তু তার বুকেই বসানো হলো তীব্র যন্ত্রণা দিয়ে গুলি-তিনবার। সেনার নির্দয় আঘাত-প্রথমটি নিঃশব্দে নিল কিশোর ইয়াহিয়ার শ্বাস, দ্বিতীয়টি ঝরিয়ে দিল তার হাঁসফাঁস করা জীবনের সব প্রার্থনা, আর তৃতীয়টি যেন আকাশে লিখে দিল রক্তের অক্ষরে : ‘এই জন্মভূমি আমার ছিল, আছে, থাকবে চিরকাল, শুধু আমি ছাড়া।’
রুশদিয়া যখন পৌঁছাল, তখন ইয়াহিয়ার শরীর কেবল মাটি ছুঁয়ে নেই-মাটি তাকে গ্রহণ করেছে। পাশে ছিল একটি ছিন্ন জায়নামাজ, আর একটি ছোট্ট পপি ফুল-তাদের দুজনের মাঝে রেখে যাওয়া নীরব সাক্ষী। সেই দিন থেকেই রুশদিয়া আর কিছুতেই হাসে না। বাবুললুতের বাতাসে, গাজা উপত্যকায়, আজও ইয়াহিয়ার রক্তের ঘ্রাণ ভেসে বেড়ায়-প্রতিটি জলপাই পাতার ফাঁকে ফাঁকে। রুশদিয়ার বুকে সে রক্ত সূর্যের রোদের মতো জ্বলে আছে, কখনো নিভে না। রুশদিয়ার প্রতিটি মুহূর্ত স্মরণ করে বলে : ‘ওঠো ভাই, সুবহে সাদিকে একসঙ্গে নামাজ আদায় করব।’
তাদের মা, জাহরা, ছিলেন এক আলোকিত প্রতিচ্ছবি-যেন ফিলিস্তিনের মাটি থেকে উঠে আসা কোনো জ্যোতির্বিন্দু। তার মুখে ছিল বেদনার রেখা, অথচ চোখে এক ধরনের অবিনাশী দীপ্তি। জাহরার জীবন যেন ছিল পুরো ফিলিস্তিনের ইতিহাসের এক নির্মম প্রতিচ্ছবি। তার দাদি ১৯৪৮ সালের আল-নাকবা-‘বিপর্যয়ের দিন’-এ নিজের ঘর, জমি, এমনকি স্বামীকেও হারিয়ে সন্তান কোলে করে আশ্রয় নিয়েছিলেন বাবুললুতের এক ধ্বংসস্তূপে। তারা তখন কাফেলা হয়ে হাঁটছিলেন, চোখে জল, পায়ে রক্ত-তবুও বুকে আগলে রেখেছিলেন পূর্বপুরুষের চাবির গোছা, যে চাবি আর কখনো দরজা খোলেনি।
জাহরার নিজের শৈশব কেটেছিল যুদ্ধের ছায়ায়। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধ তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর অধ্যায়-যে যুদ্ধে তিনি এক দিনে হারিয়েছিলেন তার তিন ভাইকে। এক ভাই ছিলেন মক্তবের হাফেজ শিক্ষক, অন্যজন ছাত্র, আর ছোট ভাই তখন মাত্র পনেরো। ইসরাইলি বোমার আঘাতে যখন তাদের বাড়ির অর্ধেক ধসে পড়ে, জাহরা মায়ের বুক থেকে আলাদা হয়ে পড়ে যান, কিন্তু আশ্চর্যভাবে বেঁচে যান। সেই থেকে তার ভেতরে জন্ম নেয় এক অনন্ত সাহস আর সংযম-যা তিনি পরবর্তী সময়ে রুশদিয়া ও ইয়াহিয়ার হৃদয়ে গেঁথে দিয়েছিলেন।
জাহরা কখনো কাঁদতেন না সামনে, কিন্তু প্রতি রাতে জায়নামাজে বসে তার কান্না মিশে যেত সিজদার ভেজা মাটিতে। তিনি বলতেন, ‘আমরা ঘর হারাই, মানুষ হারাই, কিন্তু আল্লাহকে আর ইতিহাসকে হারাব না কখনো।’
তিনি ছিলেন রুশদিয়া, ইয়াহিয়ার আত্মার ভিত-যার স্মৃতি ও বিসর্জনের ইতিহাস আজও বয়ে চলে বাবুললুতের প্রতিটি অলিগলিতে, প্রতিটি জলপাই পাতার কাঁপুনিতে। ইয়াহিয়াকে হারিয়ে কষ্টের ভারে জাহরা বলত : ‘রুশদিয়া, তোমার দেহ ছোট, কিন্তু তোমার শরীরে প্রবাহিত হচ্ছে প্রজন্মের রক্ত। তুমি শুধু আমার পুত্র না, তুমি ফিলিস্তিনের উত্তরাধিকার। তোমাকে সবকিছুই মনে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে তোমার আব্বুকে, তোমার ভাই ইয়াহিয়াকে।’
এক দিন রুশদিয়া স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখে এক ইসরাইলি সেনা একজন বৃদ্ধকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। বৃদ্ধের চোখে পানির নহর বইছে, পায়ে কঠিন শেকল, শরীর ফেড়ে রক্ত পড়ছে গলগল করে। কিন্তু বৃদ্ধের ঠোঁট থেকে ঝরছে ঝরনার মতো পবিত্র আয়াত : ‘অয়া লা তাহিনু...-’ ‘তোমরা দুর্বল হয়ে পড়ো না।’
রুশদিয়ার ভেতরে কেঁপে ওঠে। চার পাশের বন্দুকের আওয়াজ, ড্রোনের গর্জন আর ধুলোয় ঢেকে যাওয়া আকাশ হঠাৎ যেন স্তব্ধ হয়ে যায় তার ভেতর। সে ধীরে ধীরে খাতার ভেতর রাখা ছোট্ট একটি পাথর হাতে নেয়-একটি ধূসর পাথর, যার ওজন খুব সামান্য হলেও তার হৃদয়ের গভীরে সেটার ভার অসীম। সেই পাথরটি ছিল তার বাবার রেখে যাওয়া একটি স্মৃতি, একজন ইন্তিফাদার যোদ্ধা-যিনি স্বাধীনতার চিৎকার গলায় ঝুলিয়ে পাঁচ বছর আগে শহিদ হন।
ইন্তিফাদা মানে কাঁপিয়ে দেওয়া-একটা গণবিস্ফোরণ। ফিলিস্তিনিদের প্রতিবাদের এক অগ্নিসংগ্রাম। রুশদিয়ার বাবা অংশ নিয়েছিলেন প্রথম ইন্তিফাদায়-১৯৮৭ সালে, যখন ফিলিস্তিনের মানুষ আর মুখ বুজে সহ্য করেনি ইসরাইলি দখলদারত্ব, বরং রাস্তায় নেমেছিল পাথর হাতে, আত্মমর্যাদা রক্ষার দীপ্ত চোখে। পাথর ছুড়ে ছুড়ে তারা বলেছিল-‘আমরা অস্ত্রহীন, কিন্তু নতমুখী নই।’
সেই পাথর, যেটা রুশদিয়ার বাবা একদিন হাতে নিয়েছিলেন, যে পাথরে কর্ষিত হয়েছে অনেক অনেক ইতিহাস তা স্বযত্নে তুলে রেখেছিল রুশদিয়া খাতার ভেতর। দখলদার সেনাদের ট্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে, আজ রুশদিয়ার খাতার ভেতরের পাথরটি রুশদিয়াকে আলোড়িত করছে বারবার। সময় পালটেছে, কিন্তু সেই পাথরের ভাষা পালটায়নি। সেটা যেন প্রতিদিন তাকে মনে করিয়ে দেয়-‘তোমার শিরা-উপশিরায় বইছে প্রতিরোধ, বিশ্বাস, আর রক্তের স্মৃতি।’
পাথরটা শুধু পাথর নয়-সেটা তার বাবার কণ্ঠ, তার দেশের অস্তিত্ব, তার নিজস্ব ইন্তিফাদা। রুশদিয়া চিৎকার করে সেনাটিকে বলে : ‘এই শহর তোমাদের না! এই শহর আমার দাদার, আমার বাবার, আমার রক্তের, আমার ফিলিস্তিনের। তোমরা ছেড়ে দাও উনাকে।’
সেনা থামে না। আরও দ্বিগুণ উৎসাহে বৃদ্ধকে কষ্ট দিতে থাকে। বুটের তলায় নিষ্পেষিত করতে থাকে বৃদ্ধের রক্তাক্ত মুখ। রুশদিয়া এবার প্রবল আক্রোশে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে পাথর ছুড়ে মারে। কিন্তু সে জানে না এর পরিণতি কী, তার ছোট্ট হাত গাজা উপত্যকায়, বাবুললুতের অধিবাসীদের হৃদয়ে কোনো ইতিহাস জাগিয়ে তুলছে! তবুও শক্ত হয়ে ওঠে ছোট্ট রুশদিয়ার চোয়াল, হাতের মুঠি, চোখ দিয়ে যেন আগুনের তপ্ত শিখা জ্বলছে। কিন্তু ছোট রুশদিয়া জানে না এখানে আজ আর কোনো বিচার নেই, কোনো আদালত নেই।
তখনই রুশদিয়াকে ধরে নিয়ে যায় দখলদার বাহিনী। জাহরা যখন জানতে পারে, তখন সে ছুটে যায় রেড ক্রিসেন্ট, জাতিসংঘ অফিস, এমনকি মসজিদের মিম্বারে দাঁড়িয়ে কান্না করে : ‘আমি এক শিশুর মা, যার হাতের মুঠিতে পাথরের দাগ লেগে আছে। আমার ছেলে কি পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর অপরাধ করেছে?’ মহান আল্লাহর কাছে প্রাণান্ত জিজ্ঞাসা জাহরার।
এর সাত দিন পর, এক কফিন আসে। কফিন নয়, যেন পুরো গাজায় সমুদ্র তটভূমি বয়ে আনা এক কাফন-যেখানে পূর্ব দিকে ইসরাইল, দক্ষিণ-পশ্চিমে মিশর (সিনাই উপদ্বীপ), আর পশ্চিম দিকে বিশাল ভূমধ্যসাগর কফিনটিতে কথা বলছে। আর এ ছোট্ট কফিনে শুয়ে আছে রুশদিয়া, মুখে এক প্রশান্তির রেখা, দুই ঠোঁটের ফাঁকে জমে থাকা রক্তে লেখা-‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)’।
রুশদিয়ার জানাজায় আসে হাজারো মানুষ। হাফেজ শিশুরা তার প্রিয় সূরা ‘আল-বালাদ’ পড়ে। শহরের মেয়েরা অলক্ষ্যে কান্না করে, আর বৃদ্ধেরা বলে : ‘এই পবিত্র শহরে একজন নবি জন্মায়নি, কিন্তু আজ শহিদ হয়েছে এক নবীর উত্তরাধিকারী।’
সেদিন রাতে, যখন বাবুললুতের প্রাচীরের ওপর চাঁদের আলো পড়ছিল, তখন এক অজ্ঞাত ব্যক্তি নিঃশব্দে রক্ত দিয়ে লিখে দেয় পবিত্র শব্দমালা। তার কলম ছিল রক্ত, আর তার লেখায় ছিল এক অমর বার্তা-যে বার্তা শহরটির প্রাণবন্ত ইতিহাসের কথা বলে : ‘এই শহর পাথর হারিয়েছে, কিন্তু ফিরে পেয়েছে এক পবিত্র আত্মা। আর সে আত্মার নাম রুশদিয়া।’
শহরের প্রতিটি পাথর যেন সেই রাতের আগের দিনগুলোরও সাক্ষী ছিল, যখন ইসরাইলি বুলডোজার তাদের মাটির শরীরকে ধ্বংস করে ফেলেছিল। পাথরগুলো হারিয়েছিল তাদের অস্তিত্ব, কিন্তু শহরটি হারায়নি তার আত্মাকে। রুশদিয়া, ইয়াহিয়া এবং শহরের অন্যান্য সন্তানের আত্মত্যাগ, শহিদদের রক্ত-এসব কিছু মিলিয়ে ফের ফিরে এসেছিল বাবুললুতের আত্মা। এটি ছিল ইতিহাসের অবিচলিত চিহ্ন-যেটি কখনো মুছে যায় না, বরং প্রতিটি প্রজন্মের সঙ্গে জড়িয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
আজ রুশদিয়ার ছবি টাঙানো হয় প্রতিটি গলিতে, স্কুলে, মসজিদের পাশে। সে যেন ইন্তিফাদার প্রতীক, সে যেন ছোট পাথরের ভেতর থেকে গজিয়ে ওঠা সেই পবিত্র মিষ্টি কুরআন-কুরআনের মহৎ আয়াত, যা কখনো পোড়ানো যায় না।
বাবুললুত, গাজা-এখনো আগুনে দগ্ধ,-এখনো পুড়ছে, কিন্তু তার হৃদয়ে এক শিশু ঘুমিয়ে আছে, যার স্বপ্নের ছায়ায় ফিলিস্তিন আবারও ওঠে দাঁড়াবে। আবারও হাতের মুঠোয় পাথর ভরে প্রতিবাদ করে উঠবে রুশদিয়ার মতো। রুশদিয়া প্রাণশক্তি হয়ে বেঁচে আছে সবার মাঝে। কারণ রুশদিয়ারা মরে না, রুশদিয়া সে যে বাবুললুতের ফিলিস্তিন। এ ফিলিস্তিন আবার হাঁটবে, আবার উঠবে পতাকা, আর প্রতিটি মায়ের দোয়ায় ভূমধ্যসাগরও জেগে উঠবে, উচ্চারিত হবে সেই নাম-রুশদিয়া। কারণ সে নিছক কোনো সাধারণ শিশু নয়, সে নিজেই এক জীবন্ত ফিলিস্তিন।