Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

কেন ক্ষমতাবানরা জনগণ থেকে দূরে সরে যান

Icon

অপূর্ব চৌধুরী

প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কেন ক্ষমতাবানরা জনগণ থেকে দূরে সরে যান

জবাবদিহিতার অভাবে জন্ম নেয় মোহ, আর মোহেই হারিয়ে যায় মানবতা।

ক্ষমতা একটি আয়না। তবে এ আয়না বাস্তবকে প্রতিফলিত করে না। ক্ষমতা বিকৃত করে বাস্তবতা। এটি ব্যক্তি থেকে সরিয়ে নেয় সংবেদনশীলতা, গড়ে তোলে এক কল্পিত আত্মপরিচয়। ক্ষমতায় মানুষ নিজেকে দেখে ভিন্ন এক শ্রেণিতে-ঊর্ধ্বতন, অস্পৃশ্য, অলঙ্ঘনীয়।

দেখা গেছে যে-কেউ যদি দীর্ঘদিন এ আয়নায় নিজেকে দেখে, একসময় সে নিজেকে ঈশ্বর ভাবতে শেখে। ক্ষমতা তখন আর দায়িত্ব নয়, হয়ে ওঠে এক অহংকারের মঞ্চ জয়। ক্ষমতার আয়নায় যে ব্যক্তি নিজেকে এমন বর্বর দেখে, সে ক্রমশ ভুলে যেতে থাকে নিজের প্রাথমিক চেহারাটি। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয়, ভাষার স্বর বদলে যায়, সংবেদনশীলতার সীমারেখা ঘোলাটে হয়ে পড়ে। ক্ষমতা এক রহস্যময় নেশা-যার স্পর্শে মানুষ হয়ে ওঠে এক আলাদা সত্তা।

একজন সাধারণ মানুষ যখন ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছায়, তখন যেন চারপাশে অদৃশ্য দেওয়াল গড়ে ওঠে। এ দেওয়াল তাকে বিচ্ছিন্ন করে-ভাষা থেকে, কান্না থেকে, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যথা থেকে, তার চারপাশ থেকে। সে আর রাস্তায় হাঁটে না, বাজারে দাঁড়ায় না, কারও চোখে চোখ রাখে না। হৃদয়ের মানচিত্র থেকে একে একে মুছে যায় সহানুভূতি, দায়িত্ব আর জবাবদিহিতার আয়না।

আব্রাহাম লিংকন তাই বলেছিলেন-‘Nearly all men can stand adversity, but if you want to test a man's character, give him power.’

এ বিচ্ছিন্নতার পেছন বুঝতে গিয়ে মনোবিজ্ঞানের আছে কিছু গবেষণা। সামাজিক মনোবিজ্ঞানী ড্যাচার কেল্টনার তার গবেষণায় দেখিয়েছেন,

ক্ষমতা মানুষের মস্তিষ্ককে বদলে দেয়। ক্ষমতার স্থায়িত্ব মানুষের মস্তিষ্কের নিউরোসার্কিটকেই পালটে দেয়। সহানুভূতির জন্য দায়ী নিউরাল নেটওয়ার্ক দুর্বল হয়ে পড়ে। ক্ষমতার আসনে বসে থাকা ব্যক্তি ধীরে ধীরে সংবেদনশীলতা হারান। ক্ষমতায় এমপ্যাথি স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে। ক্ষমতাবান মস্তিষ্ক সামাজিক সংকেত বুঝতে ব্যর্থ হয়। চারপাশের মানুষগুলোর চোখের জল, মুখের ভাঁজ, নিঃশব্দ আর্তি আর পৌঁছায় না তার মনে।

সে বিশ্বাস করতে শেখে-আমি আলাদা, আমি বিশেষ, আমি শ্রেষ্ঠ। এ বিশ্বাসই এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক বিভ্রম। নিজেকে নিয়ে এমন বিশ্বাসের কেন্দ্রে থাকে নিজেকে ঈশ্বর ভাবার আত্মপ্রবঞ্চনা।

ক্ষমতা তখন নিজের চারপাশে গড়ে তোলে এক অদৃশ্য প্রাচীর। সেই প্রাচীর মানুষকে আলাদা করে জনসাধারণের কষ্ট, ঘাম, ক্লান্তি, প্রশ্ন এবং স্বপ্ন থেকে। ফলে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ-যার চারদিকে রয়েছে বশ্যতা, আনুগত্য ও চাটুকারিতা।

লর্ড একনের ভাষায়-‘Power tends to corrupt, and absolute power corrupts absolutely.’

তবু প্রশ্ন থেকে যায়-লোকে কেন ক্ষমতাবানদের ভালোবাসে? কেন সেই নেতার ছবি কাঁধে নিয়ে হাঁটেন, যিনি আর ফিরে তাকান না তার দিকে, তারপরও মানুষগুলো তার দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকেন। কারণ, সমাজ শিখিয়েছে-ক্ষমতা মানে পবিত্রতা। ছোটবেলা থেকেই আমরা শুনি-বড়দের প্রশ্ন করো না, শাসকদের মানো, ধর্মীয় নেতাদের শ্রদ্ধা করো, রাষ্ট্রকে উপাসনা করো। এ মানসিক কাঠামো আমাদের করে তোলে নেতা-পূজারি, যুক্তিহীন অনুসরণকারী।

নেতারা উদ্ধার কর্তা, বিপদে উদ্ধার করবেন, এ বিশ্বাসই জন্ম দেয় ‘উদ্ধারকের মিথ’। তখন সেখানে হয়ে ওঠে একজন মানুষই জাতির একমাত্র ভরসা। তাদের চারপাশের ভরসা। লোকে ভাবে, তার হাতেই সব সমাধান। অথচ ইতিহাস বলে, কোনো একক নেতা জাতিকে বদলায় না। আলেকজান্ডার, নেপোলিয়ন, লিংকন-সবাই হাজারও মানুষের সংগ্রামের ফল।

তবুও আধুনিক রাজনীতি এ সত্য আড়াল করে, কারণ একক নেতার ভাবমূর্তি তৈরির মধ্যেই লুকিয়ে থাকে ক্ষমতার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার-জনগণের আবেগ। আমরা ভুলে যাই বুদ্ধের সেই কথা, ‘No one saves us but ourselves. No one can and no one may. We ourselves must walk the path.’

বাস্তবে অধিকাংশ নেতা ক্ষমতায় পৌঁছে বদলে যান। তারা আর মানুষ থাকেন না, হয়ে ওঠেন প্রোটোকল। তাদের দরজা থাকে বন্ধ, তারা কথা বলেন স্ক্রিপ্ট পড়ে, তাদের কানে আর পৌঁছায় না নিচের মানুষের আর্তি। এ বিচ্ছিন্নতা অনেক সময় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতও হয়। কারণ, প্রশ্নবিহীন শ্রদ্ধা মানুষকে করে তোলে সুবিধাজনক। নেতা তখন নিজেকে ভাবেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি, সত্যের একমাত্র ধারক। ফলাফল নেতৃত্ব হয়ে যায় ছায়া, যার পেছনে দেখা যায় না মানুষের মুখ, শোনা যায় না মানুষের অভিমান।

ক্ষমতা শুধু মোহ তৈরি করে না, এটি সৃষ্টি করে এক চরম বিভ্রম-আমি এখানে এসেছি, কারণ আমি সেরা। এ বিভ্রমই রচনা করে ‘নির্বাচিত’ হওয়ার গর্ব। এ গর্বই মানুষকে দূরে সরিয়ে দেয়,

জনগণের দুঃখ তখন আর শাসকের হৃদয়ে নড়ে না। তাদের চোখে মানুষ হয়ে ওঠে সংখ্যা-ভোটের হিসাব, নীতির ডেটা।

তবে আমরা জনগণও এ ব্যবস্থার অংশীদার।

আমরা প্রশ্ন করি না, কারণ আমরা আশাবাদী-আমরাও একদিন সেখানে পৌঁছাব। আমরা স্বপ্ন দেখি, আমরাও ওদের মতো একদিন নেতা হবো, ক্ষমতা পাবো। এ আশার ফাঁদেই আমরা ক্ষমতার তোষামোদ করি। সঙ্গে ভাবি যে-পরিশ্রম করলেই সিঁড়ি শেষ হবে একদিন।

কিন্তু বাস্তবে সেই সিঁড়ি বহুজনের জন্যই অপূর্ণ, অদৃশ্য। সে খবর বেশিরভাগ রাখে না। ক্ষমতা তখন হয়ে ওঠে এক স্বপ্ন-যা সবাই ছুঁতে চায়, কিন্তু খুব কম জন পায়। এবং এই না পাওয়ার গল্পগুলো সমাজে চেপে যায়। সিঁড়ির শীর্ষটা তখন অনেকের কাছেই হয়ে পড়ে অদৃশ্য, অথচ আমরা তবু চেষ্টা থামাই না, প্রশ্ন করি না, কারণ আশা তো সবচেয়ে মধুর বিভ্রম।

ক্ষমতার মোহ বাড়ে সংকটকালে। সমাজ যখন টালমাটাল, মানুষ তখন খোঁজে এক শক্তিশালী রক্ষক। নেপোলিয়ন এসেছিলেন বিশৃঙ্খলার মাঝে, হিটলার এসেছিলেন অর্থনৈতিক দুর্দশায়।

আজও রাজনীতি চলে সেই পুরোনো কৌশলে-প্রতিশ্রুতির মোড়কে, নিরাপত্তার নামে, মুক্তির নামে। আধুনিক রাজনীতি এ আবেগকে কাজে লাগায়। প্রতিশ্রুতি, সংকট, ধর্ম, ইতিহাস, সবকিছু মিলে তৈরি হয় এক রাজনৈতিক উপাখ্যান, যেখানে জনগণ হয়ে পড়ে শ্রোতা, নয় সহনির্মাতা। আর এ শ্রোতার ভূমিকা পালন করতে করতে তারা হারায় তাদের একান্ত নাগরিক স্বর।

তবে সব বিভ্রম ভাঙে না। তবু কিছু কিছু সময়, কিছু কিছু প্রশ্ন, কিছু কিছু মানুষ বদলায়। মানুষ যখন প্রশ্ন করতে শেখে, তখন মোহ ফেটে পড়ে। সচেতনতা জন্ম দেয় সাহস, আর সাহস জন্ম দেয় জবাবদিহিতা। ক্ষমতাকে যদি প্রশ্নের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়, তবে ক্ষমতা আর পূজার বস্তু নয়, হয়ে ওঠে সেবার হাতিয়ার। ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা মানে বিদ্রোহ নয়, সেটি বরং সচেতনতার সূচনা। গণতন্ত্রের মূলে রয়েছে প্রশ্ন করার অধিকার। আর সেই অধিকার হারিয়ে গেলে, গণতন্ত্র পরিণত হয় এক অলিখিত রাজতন্ত্রে। আমাদের মনে থাকে না জর্জ অরওয়েলের সেই কথা, ‘A healthy democracy requires a habit of skepticism.’

ক্ষমতাকে শ্রদ্ধা করার প্রয়োজন নেই। তবে তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। কারণ শ্রদ্ধা জন্ম দেয় ভক্তি, ভক্তি জন্ম দেয় নিরঙ্কুশতা, আর নিরঙ্কুশতা জন্ম দেয় স্বেচ্ছাচারিতা। যে মুহূর্তে জনগণ কথা বলা বন্ধ করে, সে মুহূর্তেই ক্ষমতা হয়ে ওঠে ভয়ংকর।

গণতন্ত্র মানে প্রশ্ন করার অধিকার। নেতা মানে একক ব্যক্তিত্ব নয়। নেতা একটি প্রতিনিধিত্ব-যেখানে জনগণের কথা, কষ্ট, ভবিষ্যৎ শোনা হয়, বোঝা হয়, পালিত হয়।

একটি সভ্যতা তখনই পরিণত হয়, যখন তার নেতৃত্ব জন্ম নেয় জনগণের ভেতর থেকে। জনগণের অভিজ্ঞতায়, কষ্টে, ক্ষোভে, ভালোবাসায়। নেতা তখন আর ‘ঈশ্বর’ নয়, তারচেয়ে হয়ে ওঠেন এক সহযাত্রী-যিনি শোনেন, বোঝেন, পাশে থাকেন।

ক্ষমতা যেন বন্দি না থাকে দেওয়ালের ভেতরে, বরং ছড়িয়ে পড়ে মানুষের হৃদয়ের ভেতর। তবেই একদিন-নেতা আর জনগণের মাঝে থাকবে না দেওয়াল। থাকবে সংলাপ। থাকবে না শাসন, থাকবে কেবল সহানুভূতি।

কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কি প্রশ্নবান্ধব? আমরা কি আমাদের সন্তানদের শেখাচ্ছি নেতৃত্বের মূল্য নয়, সেবার মনোভাব? মিডিয়া কি নেতা তৈরির কারখানা, নাকি জনগণের চোখ? আমরা কি একেকজন নাগরিক সচেতনভাবে চিন্তা করি, নাকি নেতানির্ভর শ্রোতা?

ক্ষমতা এক দ্বিমুখী পথ। একদিকে সে পারে সেবা দিতে, অন্যদিকে সে পারে ধ্বংস ঘটাতে। এই পথ যেন অন্ধবিশ্বাসে না চলে, চলে সচেতনতার আলোয়। আমরা যদি সাহস করে প্রশ্ন করতে পারি, দায়িত্ব দাবি করতে পারি, তবে একদিন সত্যিই নেতৃত্ব জন্ম নেবে জনগণের ভেতর থেকে-নয় আরোপিত কোনো ছায়া থেকে। তখন আর নেতা হবেন না ঈশ্বর, হবেন একজন পথচলা মানুষ, আমাদের মধ্য থেকে উঠে আসা একজন সহযাত্রী।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম