অঙ্গদান ও মরণোত্তর অঙ্গ প্রতিস্থাপন
ডা. আ স ম তানিম আনোয়ার
প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
অঙ্গদান হলো জীবিত, বা সম্প্রতি মৃত ব্যক্তির কাছ থেকে টিস্যু বা অঙ্গগুলো সরিয়ে অন্য কোনো ব্যক্তির শরীরে ব্যবহার করার প্রক্রিয়া। প্রথমজন হলেন দাতা এবং দ্বিতীয়জন হলেন প্রাপক। সব বয়সের লোকেরা দাতা হতে পারে।
* কে একটি অঙ্গ গ্রহণ করতে পারবেন
যে রোগী কোনো অঙ্গ ব্যর্থতার শেষ পর্যায়ে আছেন এবং যা চিকিৎসার মাধ্যমে আর ভালো করা সম্ভব নয়, সেই রোগী যদি অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য চিকিৎসাগতভাবে উপযুক্ত হন তাহলে তিনি অঙ্গ গ্রহণ করতে পারবেন।
* প্রতিস্থাপনের প্রকারভেদ
▶ অ্যালোজেনিক : একই প্রজাতির বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে প্রতিস্থাপন।
▶ স্বতঃস্ফূর্ত : একই ব্যক্তির মধ্যে প্রতিস্থাপন।
▶ সিনজেনিক : জিনগতভাবে অভিন্ন দুজনের মধ্যে প্রতিস্থাপন।
▶ জেনোজেনিক : বিভিন্ন প্রজাতির পৃথক দুজনের মধ্যে প্রতিস্থাপন।
* কী কী অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা যায়
একটি কিডনি, লিভারের অর্ধেক অংশ, অগ্ন্যাশয়ের অংশ, ফুসফুসের অংশ, অন্ত্রের অংশ। সবচেয়ে বেশি প্রতিস্থাপিত অঙ্গগুলো হলো কিডনি, লিভার, অগ্ন্যাশয়, হার্ট, ফুসফুস এবং অন্ত্র। সবচেয়ে বেশি নিয়মিত প্রতিস্থাপিত টিস্যু হলো কর্নিয়া, ত্বক, অস্থিমজ্জা এবং হার্টের ভালভ বা ধমনি।
* অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চাহিদা
▶ বাংলাদেশে দাতার অভাবে প্রতিদিন ৫০ জনের মৃত্যু হয়।
▶ দেশে বর্তমানে প্রায় ২ কোটি মানুষ কোনো না কোনো কিডনি রোগে আক্রান্ত। যার মধ্যে ৮০ হাজার জনের ডায়ালাইসিস প্রয়োজন। অথচ আর্থিক অনটনের কারণে তাদের মধ্যে মাত্র ৩০ হাজার রোগী ডায়ালাইসিস করতে পারছেন।
▶ কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য বার্ষিক চাহিদা ৫০০০ বলে অনুমান করা হয়, তবে গড়ে মাত্র ১২০ জন লোক তাদের আত্মীয়দের কাছ থেকে কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য ব্যবস্থা করতে পারে।
* বাংলাদেশে বর্তমান ইএসআরডি কেয়ার বা সম্পূর্ণ কিডনি বিকল রোগীদের ব্যবস্থাপনা
প্রতি বছর কিডনি বিকল রোগীদের মোট সংখ্যা ৪০,০০০। ২০১৮ সালে, প্রায় ১০,৪২১ জন নতুন রোগী আরআরটি (রেনাল রিপ্লেসমেন্ট থেরাপী) তে ছিলেন তাদের মধ্যে- হিমোডায়ালাইসিস নিয়েছেন ১০,০০০ জন, সিএপিডি (পেটের ডায়ালাইসিস) নিয়েছেন ২৩৪ জন, ১৮৭ জনকে কিডনি প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। সুবিধার অভাবে ৮০ শতাংশের বেশি ডায়ালাইসিস বা প্রতিস্থাপনের সুযোগ পাননি। মরণোত্তর কিডনি প্রতিস্থাপন (ক্যাডাভেরিক রেনাল ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন) এ বিশাল চাহিদা পূরণের একমাত্র উপায় হতে পারে।
* বিভিন্ন দেশে ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্টেশন
এশিয়ার মোট কিডনি প্রতিস্থাপনের ১০ শতাংশ ক্যাডাভেরিক রেনাল ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। ভারতে, প্রতি বছর প্রায় ২,৫০০ থেকে ৩,০০০ কিডনি প্রতিস্থাপন হয় যার মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ মৃত দাতাদের কাছ থেকে সরবরাহ করা হয়। কোরিয়ায় এ অনুপাত পাঁচ শতাংশ। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে, মোট কিডনি প্রতিস্থাপনের ১৫ শতাংশ ক্যাডাভেরিক রেনাল ট্রান্সপ্লান্টেশন থেকে সম্পন্ন হয়। উন্নত দেশগুলোতে এ হার সর্বোচ্চ; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং স্পেনে ক্যাডাভেরিক কিডনি দানের হার যথাক্রমে ২৬.৫, ২৫, ২৩.১ এবং ৪৯.২ শতাংশ।
* বাংলাদেশে ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্টেশনের পরিস্থিতি
এশিয়ার অনেক দেশে যেখানে ক্যাডাভেরিক রেনাল ট্রান্সপ্লান্টেশন সফলভাবে করা হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে আমরা এখনো এটি সফল ভাবে শুরু করতে পারেনি। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে ২ জন মৃতদাতার অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে উভয়ই ব্যর্থ হয়।
* মৃত মানুষ থেকে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা কীভাবে উন্নত করা যায়
▶ শিক্ষাভিত্তিক গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে।
▶ চিকিৎসা পাঠ্যক্রমে অঙ্গদানের গুরুত্ব এবং ব্রেনস্টেম বা মস্তিষ্ক মৃত্যুর ধারণাটি তুলে ধরতে হবে।
▶ সাধারণ মানুষের মধ্যে অঙ্গদানের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি ও মনোভাব বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিয়মিত বিরতিতে আলোচনা, প্রচারণা, বিজ্ঞাপন ও প্রদর্শনীর আয়োজন করতে হবে।
▶ মরণোত্তর প্রতিস্থাপনের আইনি, নৈতিক এবং ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতাগুলো অতিক্রম করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। ধর্মীয় ও সামাজিক নেতাদের অঙ্গদানের সমর্থনে জনগণের কাছে এ বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে এবং বাধাগুলো অতিক্রমের জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
লেখক : ফেলোশিপ ইন কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট (কোরিয়া), সহকারী অধ্যাপক, নেফ্রোলজি বিভাগ, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল।
