Logo
Logo
×

মধ্যপ্রাচ্য

অবশেষে ভোর হলো, শান্ত হলো আকাশ

গাজী আবদুর রশীদ

গাজী আবদুর রশীদ

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৫, ১১:১০ পিএম

অবশেষে ভোর হলো, শান্ত হলো আকাশ

রেডিও তেহরানের সিনিয়র সাংবাদিক ও উপস্থাপক গাজী আব্দুর রশীদ।

ভেবেছিলাম এই রাত বুঝি আর শেষ হবে না! নতুন একটি সকালের প্রতিশ্রুতি আর আমায় দেবে না। অবশেষে রাতের আঁধার কাটল ভোর হলো, বীভৎস সব বুক ফাটানো বিস্ফোরণের গগনবিদারী চিৎকার থামল। পার্কের বেঞ্চে কখন যে দুটো চোখ একটু বুজে এসেছিল টের পাইনি। পাখির ডাকে চোখ মেলে তাকালাম। দেখলাম নতুন সূর্যের প্রথম রশ্মি। যুদ্ধের দামামা থেমে গেছে। যুদ্ধবিরতির পথে আগ্রাসনকারী এবং রক্ষা ও প্রতিশোধগ্রহণকারী তিনটি দেশ আর সঙ্গে গোটা বিশ্ব। কে হারল আর কে জিতল সেটি মুখ্য নয়; মুখ্য হচ্ছে মানুষ বাঁচল, সম্পদ, প্রকৃতি বাঁচল আর দেখতে হলো না রক্ত ও ধ্বংসযজ্ঞ! ঘরছাড়ার তাগাদা থাকল না, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর ভয়ভীতিরও অবসান হলো।

প্রায় দুই সপ্তাহের সংঘাতের পর ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি শুরু হলো তবে সময় ও শর্ত নিয়ে বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। এখনকার মতো যুদ্ধটা থেমেছে একথা ধরেই আমরা সামনে এগোব।

সারা রাত কেটেছে পার্কের গাছতলায় বেঞ্চে বসে। ইসরাইল তেহরানের পশ্চিমের এ অঞ্চলকে হামলা করার হুঁশিয়ারি দিয়ে সবাইকে ঘর ছাড়তে বলেছিল। রাতভর বিরতিহীনভাবে ভয়াবহ হামলা হয়েছে। যত সাহসীই আমি হই না কেন আমি যে সরকারি বাসায় থাকি সেখানে যদি একটা হামলা হয় তাহলে ভবলীলা সাঙ্গ করে না ফেরার দেশে চলে যেতে হবে। সেই ভাবনা থেকে আর সাহসী না হয়ে বলা চলে খানিকটা ভয় নিয়ে একাকী বেরিয়ে পড়লাম বাসার অনতিদূরের একটি পার্কে। সেখানে অন্ধকার ঝোপঝাড় দেখে তার নিচের একটা বেঞ্চে বসে পড়লাম আর মাথার উপর এদিক-ওদিক দিয়ে ছুটে চলা ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র দেখতে পেলাম। কিছুক্ষণ পর থেমে থেমে ভয়াবহ বিস্ফোরণের শব্দ কানে আসতে থাকল। চোখ আর কান দুটোই আমাকে ভীত হতে সাহায্য করছিল। ভাবছিলাম আর যদি কারও সঙ্গে দেখা না হয়; এই রাত যদি শেষ রাত হয়! কিন্তু খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে, তিনে জানেন কি হবে - আমরা কতটুকু জানি বলুন। ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম। গতকাল সারা দিনের অফিসের চাপ তারপর ঘরে ফিরে বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন মানুষের সঙ্গে মিডিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ পরিস্থিতির শেষ অবস্থাটা নিয়ে কেটে গেল খানিকটা সময়। তারপর শূন্য হাতে এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়লাম। সেই বিভীষিকাময় রাত কেটে গেল। আবারও রক্ষা পেলাম।

সারা রাত কেটেছে পার্কের গাছতলায় বেঞ্চে বসে। ভাবছিলাম আর যদি কারও সঙ্গে দেখা না হয়; এই রাত যদি শেষ রাত হয়! কিন্তু খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে, তিনে জানেন কি হবে - আমরা কতটুকু জানি বলুন। ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম।


গতকালের হামলা আর বিস্ফোরণে তেতে উঠেছে অনুপম তেহরান। শুকনো মরুর বুকে সবুজে ঢাকা তেহরান যেন আতঙ্কের নগরী হয়ে উঠেছে। সকাল, বিকাল, সন্ধ্যা, রাত্রি বিরতি নেই যেন একটুও ইসরাইলি হামলার। কখনো মাথার উপর দিয়ে কখনো বা খানিকটা দূরের আকাশের সিঁড়ি বেয়ে ড্রোনগুলো হেঁটে হেঁটে নেমে ধ্বংস করছে বাড়িঘর, জীবন আর সবুজ। তবে এ ছবি শুধু তেহরানের নয়; তেল-আবিব কম যায় কিসে! ইরানের তৃতীয় প্রজন্মের বহনকারী ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে যেন তেল আবিবের বুকটা ফুটো হয়ে গেছে। শ্বাস নেওয়ার জন্য ইসরাইলের বুকে পেসমেকার বসানো হয়েছে।


কাঠফাটা রোদে আনমনে হেঁটে যাচ্ছিলাম মেট্রোর উদ্দেশে। গাড়ির চালক নিরাপত্তার নিমিত্তে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। তাই মেট্রোতে চড়ে অস্থায়ী অফিসে যাচ্ছিলাম। ডানে-বাঁয়ে, সামনে-পেছনে এদিক-সেদিক শুনতে পেলাম আকাশ ভারী করা সব গর্জন আর তর্জন। সেসব ছিল ইসরাইলি ড্রোন থেকে হামলা। বেলা তখন খানিকটা হয়েছে- বলা চলে ১০টা নাগাদ হামলা হলো তেহরানের কেন্দ্রীয় কারাগার ‘এভিনের মূল গেটের সামনে। এমন উদ্দেশ্য ছিল কারাবন্দিদের বের করে নিয়ে যাবে! এরপর কাছাকাছি সময়ে হামলা হলো তেহরানের একটি অতি পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ বেহেশতিতে। সময় গড়াতে থাকল আর হামলা হতে থাকল একে একে, রাজধানী তেহরানের কিছু এলাকা-সাত্তারখান, সদেকিয়ে এবং খবর এলো আমাদের টিভি ভবনে আবার হামলা হয়েছে। এভাবে হামলা আর বিস্ফোরণ মাথায় নিয়ে মেট্রোতে চড়ে বসলাম অফিসের উদ্দেশে।

এই মেট্রোতে করে কদিন ধরে যাতায়াত করছি অফিসের গাড়ি না আসায়। অথচ ১৩ জুন ভোররাতে তেহরানের ওপর ইসরাইলের আগ্রাসী হামলা চালানোর পর ইরান পালটা প্রতিশোধমূলক হামলা শুরুতে যে যুদ্ধ লেগে গেল তা উত্তোরত্তর বাড়তেই থাকল। আর তেহরান খালি হতে থাকল। চিরচেনা কোলাহলময় তেহরান যেন এক নির্জনপুরীতে পরিণত হলো। কোথাও কেউ নেই শুধু একা চলতাম ওই মেট্রোতে। আজ সেই মেট্রোতে মানুষের ভিড়ে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। হঠাৎ করে ইরানি জনগণ যারা নিরাপত্তার জন্য দূরের কোনো নিরাপদ জায়গায় ফিরে গেলেন আবার ফিরে এলেন যুদ্ধ যখন ফুঁসে উঠেছে দাউ দাউ করে জ্বলবার জন্যে। কেন এমন ফিরে আসা! ভিন্ন ভিন্ন বয়সের নারী এবং পুরুষ বেশ কজন ইরানির কাছে জানতে চাইলাম — কি কারণ তারা ভরা টগবগে যৌবনবতী যুদ্ধের মাঝে আবার রাজধানীতে নিরাপত্তাহীনতার মাঝে ফিরে এলেন। তাদের বেশিরভাগের উত্তর ছিল — আমার ইরান আক্রান্ত, আমার ভূমিতে শত্রুর হামলা। তাদের অন্তর জ্বলছে! আমার সংহতির জন্য রাজধানীতে ফেরা। আরও একটি বিষয় খুবই নতুন দেখলাম, মেট্রো এবং বিআরটির ভাড়া ফ্রি করে দেওয়া হয়েছে। কোনো টিকিট কিংবা কার্ড পাঞ্চ করতে হলো না। সাবওয়ে থেকে বেরিয়ে দেখলাম তেহরান আবার অনেকটা জমজমাট হয়ে উঠেছে। নগরবাসী ফিরে এসেছে। এসব দেখতে দেখতে ধীর পায়ে আমাদের অস্থায়ী অফিসে পৌঁছলাম। স্টুডিওতে ঢুকলাম আমি আর আমার সহকর্মী। তিনি তার পরিবারসহ তেহরান ছেড়েছেন যুদ্ধের তৃতীয় কিংবা চতুর্থ দিনে। সেই দূরস্থান থেকে রেকর্ডিংয়ের জন্য তাকে আসতে হয়েছে। আমরা তখন একটা টকশোর রেকর্ডিংয়ে — তখনও শুনতে পেলাম ইসরাইলি হামলার শব্দ। কোথায় গিয়ে পড়েছে কে জানে। রেকর্ডিং শেষে হামলা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে শুনতে ঘরে ফিরলাম।

কেন এমন ফিরে আসা! ভিন্ন ভিন্ন বয়সের নারী এবং পুরুষ বেশ কজন ইরানির কাছে জানতে চাইলাম — কি কারণ তারা ভরা টগবগে যৌবনবতী যুদ্ধের মাঝে আবার রাজধানীতে নিরাপত্তাহীনতার মাঝে ফিরে এলেন।

মাত্র একদিন আগে ২২ জুন সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ইরানের অভ্যন্তরে তার বি-বোমারু বিমান পাঠিয়ে তিনটি পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালিয়ে দম্ভভরে ফিরে গেছে ওয়াশিংটনে। আর আরও বেশি দম্ভোক্তি করে মি. ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যাকউন্টে লিখলেন এবং বিবৃত্তি দিলেন এই বলে যে, ইরানের তিনটি পরমাণু কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছি — এখন যুদ্ধ শেষ, এখন শান্তির সময়! তার এ বক্তব্য বিশ্ববাসী পড়েছে এবং শুনেছে। আচ্ছা বলুনতো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এমন কাজ আর এমন কথা কি বলতে পারেন! মার্কিন জাতিকে আজ শিক্ষিত, মার্জিত, গণতান্ত্রিক, মানবিক জাতি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তো সেই মার্কিন জাতির ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট কীভাবে একটি স্বাধীন দেশের মধ্যে এবং একটি স্বচ্ছ ইস্যুকে রঙিন করে দেশটির ওপর এভাবে বিমান হামলা চালাতে পারেন! এবং তারপর দম্ভ ভরে তা বিশ্বের কাছে প্রকাশও করতে পারেন! তার মানে তিনি অন্যায়ভাবে একটি আগ্রাসন চালিয়ে নির্লজ্জভাবে সেটির দায়ভারও ফলাও করে জাহির করলেন। অথচ মাত্র কদিন আগে ১৩ জুন যখন ইসরাইল নিজেকে রক্ষার একটি খোঁড়া অজুহাত খাড়া করে ভোররাতে ইরানে হামলা চালিয়ে সারি সারি লাশ ফেলে দিল তখন এই মি. প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, তিনি কিছুই জানেন না ইসরাইলের হামলা চালানোর ব্যাপারে! আর তার ১০ দিনের মাথায় তিনিই সেই আগ্রাসী দেশটির পক্ষ নিয়ে ইরানের শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচির স্থাপনাগুলোতে হামলা চালিয়ে গেলেন! তাহলে মনে হয় তিনি মিথ্যাবাদী, আগ্রাসী, মাস্তান একথা প্রমাণ হয় না!

তারপর, বিশ্বে নিন্দা, উদ্বেগ কতকিছুই ঘটল বেশকিছু ঘণ্টা ধরে। বিশ্লেষণ পর্যালোচনা, পক্ষ-বিপক্ষ কত কিছুই না হয়ে গেল। তবে যেটি বোঝা গেল না সেটি হচ্ছে মার্কিন আগ্রাসী হামলার পর ইরান এবার কি করবে!

ইরান কোনোদিন আগে থেকে কাউকে আক্রমণ করেনি, কারও ওপর হামলা চালায়নি। ইরানের নীতি কেউ যদি অন্যায়ভাবে তার ওপর হামলা চালায় তখন সে পালটা আঘাত হানে। আঘাতের জবাবে আঘাত করে। সেটার জন্য ২৪ ঘণ্টাও অপেক্ষা করতে হয়নি। ইরান কাতারের মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাল। বিশ্ব দেখল তা। যে কথাটা বুঝতে বাকি ছিল তা সবাই বুঝে গেল, ইরান শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও শত্রুর মোকাবিলা করতে পিছপা হবে না। ইরানের যোগ্য প্রতিশোধমূলক হামলা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যখন সবে শুরু হলো মাত্র একটি স্থাপনায় তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানালেন বিনয়ের সঙ্গে। কিন্তু জনাব প্রেসিডেন্ট ইরানের মাটিতে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে তার তিনটি পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালানোর সময় আপনার মধ্যে কোনো বোধোদয় হয়নি — আমি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আমার জন্য এমন আগ্রাসী এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সাজে না। বিশ্ব খুব ভালো করে দেখেছে, ইসরাইল এবং সবশেষে জনাব ডোনাল্ড ট্রাম্প আইন ভেঙে, আন্তর্জাতিক রীতি লঙ্ঘন করে অন্যায়ভাবে ইরানে হামলা চালিয়ে অনেক বড় ক্ষতি করেছেন। বহু উচ্চ সামরিক কর্মকর্তাসহ বেসামরিক মানুষ হত্যা ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস করেছেন। এটি বিশ্ব পরিবারের জন্য কাক্সিক্ষত নয়। সেই কাজটি তারা করলেন এবং অবশেষে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিলেন। তাহলে সেই গানের কথাই বলব — আমাকে কতটুকু হারিয়েছেন — আপনি কি একটুও হারেননি!


বিশ্বে সাম্য প্রতিষ্ঠা বড় জরুরি মানবিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈষম্য দূর করে সমতাপূর্ণ বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলার সময় এসেছে। সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব এবং মাতব্বরিপূর্ণ আচরণ সমভাবাপন্ন বিশ্বে থাকা উচিত নয়। প্রতিটি মানুষ স্বাধীন, প্রতিটি রাষ্ট্র স্বাধীন কারও ওপর অন্যের আগ্রাসন গ্রহণযোগ্য তো নয়ই সমর্থনযোগ্যও নয়। বিশ্বের দেশগুলো আমরা ঐসব কাজকে কেউ কেউ সমর্থন করছি আবার কেউ কেউ সহযোগিতা করছি। এই বিশ্ব ব্যবস্থার পরিবর্তন করে মানবিক সমভাবাপন্ন বিশ্ব ব্যবস্থার প্রত্যাশা করি। যুদ্ধ নয় শান্তি চাই।

ঘটনাপ্রবাহ: ইরান-ইসরাইল সংঘাত


আরও পড়ুন

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম