Logo
Logo
×

সুস্থ থাকুন

ওজন কমানোর পরও বেড়ে যায় কেন

Icon

ডা. এম এ হালিম খান

প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ওজন কমানোর পরও বেড়ে যায় কেন

ছবি: সংগৃহীত।

দীর্ঘদিন চেষ্টা করে ওজন কমিয়ে যখন কেউ মনে করেন বিজয় অর্জন করেছেন, তখন অনেক সময় দেখা যায়, কিছুদিন বেশি খাওয়া বা জীবনযাপনে একটু ঢিলেঢালা আচরণ করলেই আবার ওজন দ্রুত বেড়ে যায়। এতে অনেকেই হতাশ হয়ে যায় এবং ভাবে, ‘তাহলে এত কষ্ট করলাম কেন’? এর পেছনে রয়েছে শরীরের নিজস্ব জীববৈজ্ঞানিক একটি গোপন রহস্য, এডিপোজ টিস্যুর বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

*এডিপোজ টিস্যু কী

এডিপোজ টিস্যু বা ফ্যাট হলো শরীরের এক বিশেষ ধরনের সংযোগকারী টিস্যু, যার মূল কাজ হলো শক্তি সঞ্চয়, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং হরমোন নিঃসরণ। শরীরের বাড়তি শক্তি যখন প্রয়োজন হয় না, তখন সেটি ট্রাইগ্লিসারাইড আকারে এডিপোসাইট নামক ফ্যাট কোষে জমা হয়।

*ওজন কমানোর সময় কী ঘটে

যখন আমরা দীর্ঘদিন ক্যালোরি কমিয়ে খাই বা বেশি ব্যায়াম করি, তখন এডিপোসাইটের ভেতরে জমে থাকা ট্রাইগ্লিসারাইড ভেঙে শক্তি হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ফলে কোষের ভেতরের চর্বি কমে যায় এবং কোষ ছোট হতে শুরু করে। কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো কোষের সংখ্যা কমে না, শুধু আকার ছোট হয়।

*খাওয়াদাওয়া বেড়ে গেলে কী ঘটে

একটু সময়ের জন্য ডায়েট বা ব্যায়ামে বিরতি দিয়ে খাওয়া বেড়ে গেলে শরীর আবার অতিরিক্ত ক্যালোরি জমা করতে শুরু করে। তখন সেই ছোট হয়ে যাওয়া কোষগুলো দ্রুত নতুন চর্বি শোষণ করে বড় হতে থাকে।

এ কারণেই ওজন আবার দ্রুত বেড়ে যায়।

*কেন এমন হয়

▶ এডিপোসাইট সংখ্যা স্থায়ী : আমাদের বয়স যখন প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় পৌঁছে, তখন শরীরের এডিপোসাইট সংখ্যায় তেমন পরিবর্তন হয় না। ওজন কমালে কোষগুলো খালি হয়, কিন্তু তারা শরীরে থেকেই যায়। খাওয়া বেড়ে গেলে সেই ‘খালি ভান্ডার’ আবার ভরে যায়।

▶ উচ্চমাত্রার চর্বি সংরক্ষণ ক্ষমতা : প্রতিটি ফ্যাট কোষ বেশি পরিমাণে চর্বি সঞ্চয় করতে পারে। ছোট হয়ে যাওয়া কোষগুলো আবার দ্রুত ভরতে পারে, যা ‘ইয়ো-ইয়ো এফেক্ট’ বা ওজন ওঠানামার মূল কারণ।

▶ মেটাবলিক এডাপটেশন ও সেট পয়েন্ট থিউরি ওজন কমালে শরীর মেটাবলিজম ধীরে ধীরে কমিয়ে দেয়। ফলে শরীর শক্তি খরচে মিতব্যয়ী হয়ে ওঠে। একবার বেশি খাওয়া শুরু করলে শক্তি ব্যয় কম থাকায় অতিরিক্ত ক্যালোরি জমা হয়ে যায়।

▶ হরমোন নিয়ন্ত্রণ (লেপটিন, গ্রেলিন, ইনসুলিন) লেপটিন কমে যায় ক্ষুধা বেড়ে যায়। গ্রেলিন বেড়ে যায়, বেশি খাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। ইনসুলিন সেনসিটিভিটি পরিবর্তিত হয়ে কার্বোহাইড্রেট দ্রুত চর্বিতে রূপান্তরিত হয়।

*কেন এটি জানা জরুরি

ওজন কমানো শুধু ‘খাওয়া কমানো’ বা ‘ব্যায়াম করার’ বিষয় নয়। এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী জীবনযাপনের পরিবর্তন। যতক্ষণ না কেউ খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম, ঘুম ও মানসিক ভারসাম্যকে অভ্যাসে পরিণত করতে পারছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ওজন কমলেও সেটি ধরে রাখা কঠিন।

*করণীয়

▶ ধীরে ধীরে ওজন কমানো।

▶ দ্রুত ওজন কমানোর চেষ্টা করলে শরীর প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

▶ সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা।

▶ অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট ও চর্বি এড়িয়ে চলা।

▶ শাকসবজি, আঁশযুক্ত খাবার, লীন প্রোটিন বেশি খাওয়া।

▶ নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম।

▶ সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি মানের ব্যায়াম (হাঁটা, দৌড়, সাইক্লিং ইত্যাদি)।

▶ স্ট্রেংথ ট্রেনিং যোগ করলে ফ্যাট কমে এবং মাংসপেশি বাড়ে ফলে মেটাবলিজম বাড়ে।

▶ পর্যাপ্ত ঘুম ও মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ।

▶ ঘুম কম হলে গ্রেলিন বাড়ে, ক্ষুধা বেড়ে যায়।

▶ মেডিটেশন, যোগব্যায়াম, শ্বাসপ্রশ্বাস ব্যায়াম সহায়ক।

*চিকিৎসা

▶ ডায়েটারি থেরাপি : ক্যালোরি ডেফিসিট বজায় রাখা। মাঝে মাঝে ‘মেইনটেনেন্স ডায়েট’ রাখা যাতে শরীর নতুন ওজনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে।

▶ বিহেভিয়ারাল থেরাপি : খাবারের রেকর্ড রাখা। ওজন নিয়মিত মাপা। খাওয়ার অভ্যাস ধীরে ধীরে পরিবর্তন করা।

▶ ওষুধ (Drug therapy) (ডাক্তারের পরামর্শে) : কিছু ক্ষেত্রে Anti-obesity drugs (যেমন- Orlistat, GLP-1 agonist ইত্যাদি) ব্যবহার করা যায়। এগুলো ক্ষুধা কমায়, ফ্যাট শোষণ কমায় বা ইনসুলিন সেনসিটিভিটি বাড়ায়।

▶ সার্জারি (বেরিয়াটিক সার্জারি) : BMI খুব বেশি হলে (৪০ বা ৩৫ সঙ্গে জটিলতা থাকলে) সার্জারি করা হয়, যেমন- Gastric bypass, Sleeve gastrectomy এগুলো ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ ও ওজন কমাতে সহায়ক।

*প্রতিরোধ

▶ জীবনযাপনের স্থায়ী পরিবর্তন।

▶ ওজন কমানোকে ‘প্রজেক্ট’ হিসাবে না দেখে ‘লাইফস্টাইল’ হিসাবে গ্রহণ করতে হবে।

▶ সচেতন খাওয়া (Mindful eating)

▶ ধীরে ধীরে খাওয়া, ক্ষুধা ও তৃপ্তির সিগন্যাল বোঝা।

▶ অপ্রয়োজনীয় স্ন্যাকস বা ইমোশনাল ইটিং এড়িয়ে চলা।

▶ শারীরিক সক্রিয়তা দৈনন্দিন জীবনে যোগ করা।

▶ লিফটের বদলে সিঁড়ি ব্যবহার, হাঁটা বাড়ানো, অফিসে দীর্ঘসময় বসে না থাকা।

▶ সামাজিক ও পারিবারিক সমর্থন।

▶ পরিবার, বন্ধুবান্ধবের সহযোগিতা থাকলে নতুন অভ্যাস ধরে রাখা সহজ হয়।

*উপসংহার

ওজন কমানো একটি বিজ্ঞানভিত্তিক প্রক্রিয়া এবং এটি শুধু ‘চর্বি পোড়ানো’ নয়, বরং শরীরের এডিপোজ টিস্যুর আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা। এডিপোসাইট সংখ্যার স্থায়িত্ব, তাদের অসীম ফ্যাট সঞ্চয় ক্ষমতা, এবং শরীরের হরমোন ও মেটাবলিক অভিযোজনের কারণে ওজন কমানোর পর আবার দ্রুত বাড়তে পারে। তাই স্থায়ীভাবে ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে হলে অস্থায়ী ডায়েট নয়, বরং জীবনযাপনের স্থায়ী পরিবর্তন প্রয়োজন।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ডায়াবেটিস, থাইরয়েড ও হরমোন রোগ বিভাগ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম