ডায়াবেটিক রোগীর হজ পালনে করণীয়
ডা. শাহজাদা সেলিম
প্রকাশ: ১০ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ডায়াবেটিসের রোগী, বিশেষত যাদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নেই, তারা হজের সময় হরহামেশাই নানাবিধ বাড়তি স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়েন। হজের আনুষ্ঠানিকতা পালনের সময় এ রোগীদের রক্তের গ্লুকোজ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ সময় খেজুর এবং ভাজা খাবারের মতো উচ্চ-ক্যালরিযুক্ত খাবার অত্যধিক খাওয়ার কারণেও এ ধরনের জটিলতা হতে পারে। বিস্তারিত লিখেছেন ডা. শাহজাদা সেলিম
* হজের জন্য জিনিসপত্রের চেকলিস্ট
▶ রক্তের গ্লুকোজ মনিটরিং ডিভাইস।
▶ ব্যান্ড এইডস এবং গ্লুকোমিটারের জন্য অতিরিক্ত ব্যাটারি এবং সব ওষুধের পর্যাপ্ত পরিমাণ।
▶ একটি শীতল এবং শুষ্ক পরিবেশে বা ‘ঠান্ডা ওয়ালেট’-এ ইনসুলিন সংরক্ষণের উপযোগী ফ্লাস্ক।
▶ ডায়াবেটিস মেডিকেল রেকর্ডের একটি অনুলিপি, যা সর্বদা ব্যক্তির সঙ্গে বহন করা প্রয়োজন।
▶ চিনিযুক্ত খাবার এবং পানীয়।
▶ মুখোশ, ছাতা, ভালো ফিটিং জুতা, সুতির মোজা এবং নন-সেন্টেড হ্যান্ড স্যানিটাইজার।
▶ হাইপোগ্লাইসেমিয়া প্রতিরোধ খাবার।
▶ শারীরিক ক্রিয়াকলাপ এবং তাপমাত্রার পরিবর্তনের বিষয়টি লক্ষ্য রেখে হজযাত্রার আগে ডায়েটরি চার্ট তৈরি করা।
▶ রৌদ্র সুরক্ষা এবং পর্যাপ্ত হাইড্রেশন।
* হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ঝুঁকি কমানো
▶ মুখে খাবার ডায়াবেটিসের ওষুধ, যেমন সালফোনাইলুরিয়াস, হাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়ার উচ্চ ঝুঁকির সঙ্গে যুক্ত। হজযাত্রার সময় প্রয়োজন হলে রোগীর জন্য ডোজ কমানো যেতে পারে।
▶ যারা ইনসুলিন নেন তারা হাইপোগ্লাইসেমিয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে থাকেন। রোগীর গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণের মাত্রার ওপর নির্ভর করে ইনসুলিনের ডোজ হ্রাস করে হাইপোগ্লাইসেমিয়া এড়ানো সম্ভব।
▶ এনালগ ইনসুলিনের জন্য, যেমন ডিগুডেক, গারজিন এবং ডেটেমির ডোজ পরিবর্তন করতে হবে।
* পায়ের যত্নে করণীয়
▶ হাঁটার সময় পা ফাঁটা রোধ করতে রোগীকে প্রতিদিন দু’বার ব্যবহার করার জন্য একটি ভালো মানের গন্ধহীন ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা উচিত।
▶ দৈনিক পা পর্যবেক্ষণ করা আবশ্যক এবং গরম পানিতে পা ডুবিয়ে রাখা যাবে না।
▶ প্রার্থনার করতে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াতের জন্য মোটরচালিত যান বা হুইলচেয়ার ব্যবহার করা নিরাপদ।
▶ মসজিদের মধ্যে কার্যকলাপের জন্য, জুতা নিষিদ্ধ এলাকায় প্যাডেড মোজা ব্যবহার করা আবশ্যক; খালি পায়ে হাঁটা উচিত নয়।
▶ হজ যাত্রীদের ক্রিয়াকলাপের জন্য হাঁটার প্রয়োজন হয়। হালকা ওজনের, পায়ের গোড়ালি এবং বলের প্যাডিংসহ নরম প্যাডেড জুতা পছন্দ করা উচিত।
▶ রোগীদের পা শুকনো রাখা উচিত এবং ওজু করার পর সুতির তোয়ালে দিয়ে মুছে নিতে হবে।
▶ পায়ের কোথাও ফোসকা দেখা দিলে পা শুষ্ক রাখা এবং সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
▶ সংক্রমিত ফোস্কা নিরাময়ের জন্য অবিলম্বে মক্কার চিকিৎসকদের শরনাপন্ন হতে হবে।
▶ হজের সময় কার্ডিওভাসকুলার বা হৃদরোগের জটিলতা কমাতে শারীরিক পরিশ্রম কম করতে হবে।
▶ দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত রোগীদের ডিহাইড্রেশন রোধ করার জন্য বমি বমি ভাব এবং বমি হলে তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। রেনাল ফাংশনের অবনতি হ্রাস করার জন্য ডিহাইড্রেশন হলে শিরায় স্যালাইন দেওয়া যেতে পারে।
▶ মূত্রবর্ধক ওষুধের ডোজও তাপমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য করতে হবে।
▶ হজের যাত্রা শুরু করার আগে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। রক্তচাপ এবং রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা উভয়ই নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
* চোখের রোগ প্রতিরোধের জন্য
ডায়াবেটিস আছে এমন হজযাত্রীদের মধ্যে ২৪ শতাংশ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিতে আক্রান্ত। এক্ষেত্রে-
▶ সব রোগীকে অবশ্যই তাদের চোখে হাত দেওয়া এড়িয়ে চলতে হবে। বিশেষ করে বড় জমায়েত/পাবলিক জায়গায় চোখের সংক্রমণ বেশি হয়।
▶ চোখের লুব্রিকেন্ট ব্যবহার করা যায়।
* হজের পূর্বে শিক্ষামূলক ব্যবস্থা
▶ রোগীদের অবশ্যই রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা এবং প্রস্রাবে কেটোন বডি নির্ধারণের জন্য গ্লুকোমিটার এবং ডিপস্টিক ব্যবহার সম্পর্কে ধারনা থাকতে হবে।
▶ রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা জেনে ইহরামের আগে ইনসুলিনের ডোজ সামঞ্জস্য করতে হবে।
▶ হজযাত্রার সময় ইনসুলিনের ডোজ ১০-২০ শতাংশ বা সামান্য কমানো যেতে পারে। এক্ষেত্রে রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষা করে নেবেন।
* খাদ্য ব্যবস্থাপনা
▶ রোগীদের নিয়মিত খাবারের পাশাপাশি খাবারের মধ্যবর্তী স্ন্যাকস খাওয়া প্রয়োজন। রোগীরা বাদাম, ফল এবং দুগ্ধজাত দ্রব্য খেতে পারেন।
▶ এক থেকে দুটি খেজুর খাওয়া যেতে পারে। তাওয়াফের আগে প্রয়োজনে জটিল কার্বোহাইড্রেট এবং খেজুর খাওয়া যেতে পারে।
▶ হজের যাত্রার সময় খুব বেশি গ্লাইসেমিক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা উচিত নয়। কারণ এ সময় হাইপোগ্লাইসেমিয়াই গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে, যা পরবর্তীতেও মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি বয়ে আনতে পারে।
* ওষুধের সামঞ্জস্য
▶ টাইপ ১ ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে বেসাল-বোলাস ইনসুলিন (এনালগ) সবচেয়ে ভালো।
▶ রোগীদের অবশ্যই ইনজেকশনযোগ্য ইনসুলিন সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে।
* অসুস্থ হলে কী করবেন
▶ রোগীরা অবশ্যই ইনসুলিন বা অন্যান্য ওষুধ খেতে ভুলবেন না। কিছু ক্ষেত্রে শারীরিক ক্রিয়াকলাপে অনুভূত পরিবর্তনের সঙ্গে ডোজ পরিবর্তনের দরকার হতে পারে।
▶ রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা ঘনঘন পরীক্ষা করতে হবে। যদি এ মাত্রাগুলো ১৫ মিলিমোল/লিটার-এর উপরে ওঠে, তবে প্রস্রাবের কেটোনগুলোর জন্য পরীক্ষা করা দরকার, যা একটি প্রস্রাবের ডিপস্টিকের সাহায্যে করা যায়।
▶ যে কোনো ধরনের অসুস্থতা, সংক্রমণ, ডায়রিয়ার ক্ষেত্রে হাইড্রেটেড থাকা, প্রচুর পরিমাণে অ-মিষ্টি পানীয় খাওয়া এবং ছোট, ঘনঘন খাবার খাওয়া অপরিহার্য।
▶ ক্ষুধা হ্রাস কিংবা অস্বস্তির ক্ষেত্রে ঘনঘন স্ন্যাকিং এবং কার্বোহাইড্রেটযুক্ত পানীয় খেতে হবে।
▶ যদি রোগীর খাওয়া, পান বা গিলতে অসুবিধা হয়, তাহলে অবিলম্বে মেডিক্যাল সাহায্য নিতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বাংলাদশে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
