বাংলাদেশে সম্পত্তি বিলিবণ্টনের যেসব নিয়ম রয়েছে
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ১০:৩৩ পিএম
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে যত মামলা রয়েছে তার ৬০ শতাংশই জমিজমা সংক্রান্ত। এর একটা কারণ বাংলাদেশের মানুষ জীবিত অবস্থায় সম্পত্তি বিলিবণ্টন করতে চান না। কারণ তার কয়েকটি পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়।
এসব পদ্ধতিগুলোর নিয়মে কিছু জটিলতা ও শর্ত রয়েছে। অনেকে বিষয়গুলো জানেন না। সেসব কারণে অনেকেই আবার মৃত্যুর আগে সম্পত্তি বিলিবণ্টন করেন না। তবে প্রায়ই দেখা যায়, মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ তৈরি হয়। বিবিসির এক খবরে এসব সমস্যা ও সমাধানের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
দানপত্র
পশ্চিমা বিশ্বে মৃত্যুর আগেই সম্পত্তি উইল করে যাওয়ার প্রচলন রয়েছে। কোনো ব্যক্তি যে কাউকে যতটুকু ইচ্ছা সম্পত্তি দানপত্র করে দিয়ে যেতে পারেন। তবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে সম্পত্তি বিলিবণ্টনের ক্ষেত্রে সাধারণত ধর্মীয় আইন অনুসরণ করা হয়।
এ বিষয়ে ঢাকার জজ কোর্টের আইনজীবী আবুল হাছানাত ইমরুল কাউছার বিবিসিকে বলেছেন, মুসলিমদের মধ্যে উইল করার যে নিয়মটি রয়েছে সেটি প্রচলিত ভাষায় 'অছিয়ত' বলে পরিচিত। কিন্তু বাংলাদেশে পুরো সম্পত্তি উইল করা যায় না।
তিনি বলেন, একজন মুসলিম ব্যক্তি তার মোট সম্পত্তির তিনভাগের একভাগ পর্যন্ত যে কাউকে উইল করে দিয়ে যেতে পারবেন। ওই ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার বাদবাকি সম্পত্তি অন্য ওয়ারিশদের মধ্যে বিলিবণ্টন হবে, যেভাবে ধর্মীয় আইন অনুযায়ী বলা আছে সেভাবে। এক্ষেত্রে যার বা যাদের নামে এক তৃতীয়াংশ দানপত্র করা আছে, তিনি যদি ওয়ারিশ হন তাহলে তিনিও ওই বাকি অংশের ভাগ পাবেন।
দানপত্র করার জন্য দুইজন সাক্ষী রাখতে হবে। এই দানপত্র চাইলে পরে পরিবর্তন বা বাতিল করা সম্ভব। দানপত্রটি রেজিস্ট্রি করে নিলে পরবর্তীতে জটিলতা কম হয়। দানপত্র কার্যকর হয় মৃত্যুর পর। যিনি দানপত্র করেছেন তার মৃত্যুর পর সম্পত্তি নিজের নামে নেওয়ার জন্য উইলটি নিয়ে আদালতে আবেদন করতে হয়। আদালতের আদেশ পাওয়ার পর সেটি নামজারি করা সম্ভব হয়।
বাংলাদেশে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সম্পত্তি আইন মোটামুটি একই রকম, তবে তাতে এক তৃতীয়াংশের কোনো বিষয় নেই।
হেবা
মৃত্যুর আগে সম্পত্তি হস্তান্তরের একটি অন্যতম পদ্ধতি হচ্ছে তা দান করে যাওয়া, যা বাংলাদেশের মুসলিমদের মধ্যে 'হেবা' হিসেবে পরিচিত।
এ বিষয়ে আইনজীবী কাউছার বলেন, হেবা করলে সম্পত্তি সঙ্গে সঙ্গে হস্তান্তর করতে হয় এবং যাকে দেওয়া হয় তিনি ওই সম্পদ সঙ্গে সঙ্গে ভোগ করতে পারেন।
তিনি বলেন, একজন সুস্থ ব্যক্তি চাইলে তার পুরো সম্পত্তি একজনকে দান করতে পারে। যেমন ধরেন ছেলেমেয়েদের মধ্যে একজনকে। আবার একের অধিক ব্যক্তিকেও দান করতে পারে। কোনো প্রতিষ্ঠানকে দান করতে পারে।
এক্ষেত্রে দুইজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে রেজিস্ট্রি করে সম্পদ দান করতে হয় এবং সম্পত্তির দখল হস্তান্তর করে দিতে হয়।
যে কোনো ধর্মের ব্যক্তি সম্পদ দান করতে পারেন। কাগজে কলমে আনুষ্ঠানিকভাবে একবার দান সম্পন্ন হলে সেটি বদলানোর আর কোনো উপায় নেই। তবে সম্পত্তি গ্রহণ করার আগে যিনি সম্পত্তি দিবেন তার মৃত্যু হলে এই দান বাতিল হয়ে যাবে।
জটিলতা
বাংলাদেশে প্রায়শই জমিজমা নিয়ে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বিবাদ হয়ে থাকে।
এ বিষয়ে ইমরুল কাউছার বলেন, প্রায়ই দেখা যায়, উত্তরাধিকারীদের কেউ একজন এই বলে মামলা করে বসলো যে বাবার সই নকল করা হয়েছে অথবা সম্পত্তি দান করার সময় তিনি শারীরিক, মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন তাই স্বেচ্ছায় এটা করেননি।
উত্তরাধিকারীদের সম্মতি থাকলে কোনো সমস্যা হয় না; কিন্তু তাদের কেউ চ্যালেঞ্জ করে বসলে তখন মামলা করতে হয়। আদালত সবকিছু দেখে শুনে যদি যার নামে উইল করা হয়েছে তার পক্ষে রায় দেয় তাহলে তখন সে সম্পত্তি পায়।
তিনি বলেন, এমন বিষয় প্রায়ই দেখা যায় যে, এসব মামলা বছরের পর বছর ধরে চলে।
এছাড়া সম্পদ দান করার সময় ব্যক্তিকে অবশ্যই সুস্থ মস্তিষ্কের হতে হবে এমন নিয়ম আছে। বাংলাদেশে প্রায়শই অনেকে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এটি করার সিদ্ধান্ত নেন।
বাংলাদেশে অনেকে জমি রেজিস্ট্রি, দান অথবা উইল করতে অস্বস্তি বোধ করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাবেক সরকারি কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, আমি বেশ কিছুদিন ধরে ভাবছি যে আমার অবর্তমানে আমার মেয়েরা আদৌ সম্পত্তি ভোগ করতে পারবে কিনা। আমার ছেলেদের মধ্যে কিছু আচরণ দেখার পর এমনটা মনে হয়েছে; কিন্তু আমি তারপরও সাহস করি না যে হেবা করে দিয়ে যাব। কারণ ছেলেমেয়েদের সম্পত্তি হেবা করে দিয়ে দিলাম আর তারপর আমাকেই যদি বাড়ি থেকে বের করে দেয়? তখন আমার কী হবে?
ইমরুল কাউছার বলছেন, ওই ব্যক্তি যদি মৃত্যুর আগপর্যন্ত, দান করা সম্পত্তির পাওয়ার অব অ্যাটর্নির ক্ষমতা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন তাহলে কিছুটা সমাধান হবে। তবে সেক্ষেত্রে যাকে দান করা হলো তার সম্মতি অবশ্যই দরকার হবে এবং দান পরিবর্তন হবে না।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য কাজল দেবনাথ বলেন, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে মূল জটিলতা তৈরি হয় কোনো ছেলেসন্তান না থাকলে।
হিন্দু ধর্মে বাবার সম্পত্তিতে মেয়েদের কোনো অধিকার নেই এবং হিন্দু নারীর যদি ছেলে সন্তান না থাকে তাহলে স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি স্বামীর সম্পত্তি ভোগ করতে পারলেও উত্তরাধিকারী হবেন না।
তবে প্রচলিত নিয়মে রেজিস্ট্রি করে যে কাউকে সম্পত্তি লিখে দেওয়া যায়।
কাজল দেবনাথ বলেন, একই কারণে সেটি করার ব্যাপারে বেশিরভাগ মানুষই দ্বিধা বোধ করেন। এছাড়া বাংলাদেশে জমিজমা বিষয়ক যেকোনো কাজ খুব সময়সাপেক্ষ এবং জটিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার এক বাসিন্দা বলছেন, আমরা চার বোন, কোনো ভাই নেই। আব্বা ২০১৯ সালে সিদ্ধান্ত নিলো যে সব সম্পত্তি আমাদের নামে দিয়ে যাবে। তার মনের মধ্যে ভয় কাজ করছিল যে সে যদি সেটা না করে তাহলে তার অবর্তমানে তার ভাইয়ের ছেলেরা সম্পত্তি দখল করে নেবে। হেবা করতে গিয়ে যে পরিমাণ দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। ভূমি অফিস, রেজিস্ট্রি অফিস, ফি দেওয়ার জন্য ব্যাংক, বিষয়টি খুবই সময় সাপেক্ষ। তারপর বয়স্ক মানুষ এবং অসুস্থ। তার জন্য পুরো বিষয়টা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল।
