Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

ভোট সামনে রেখে টার্গেট কিলিং

আতঙ্কে সম্ভাব্য প্রার্থী ও রাজনীতিকরা

কাজী জেবেল কাজী জেবেল

নূরে আলম জিকু নূরে আলম জিকু

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আতঙ্কে সম্ভাব্য প্রার্থী ও রাজনীতিকরা

জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সম্ভাব্য প্রার্থী ও রাজনীতিকদের লক্ষ্য করে ‘টার্গেট কিলিং’য়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এমন ঘটনা আরও ঘটতে পারে বলে কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন। বিশেষ করে নির্বাচনি প্রচার শুরু হলে গণজমায়েতের সুযোগে পরিস্থিতি কী দাঁড়ায় তা নিয়ে তৈরি হয়েছে শঙ্কা। দেশের এমন পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিসহ নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী রাজনৈতিক দলগুলো। এদিকে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এমএম নাসির উদ্দিন, চার নির্বাচন কমিশনার ও কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের সিনিয়র সচিবের বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা করতে পুলিশকে চিঠি দিয়েছে ইসি। একই সঙ্গে সারা দেশে ইসির মাঠপর্যায়ের কার্যালয়গুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। শনিবার আলাদা চিঠিতে পুলিশকে এই নির্দেশনা দেয় ইসি।

এদিকে, সরকার জানিয়েছে প্রার্থীরা তাদের নিরাপত্তার জন্য আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তা দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। অপরদিকে দেশের সার্বিক নিরাপত্তা জোরদারে শনিবার সরকারকে চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

এদিকে শুক্রবার মধ্যরাতে লক্ষ্মীপুর জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা। প্রায় একই সময়ে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ে আগুন দেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়। এমন পরিস্থিতিতে সাপ্তাহিক বন্ধের দিন শনিবার সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত কোর কমিটির জরুরি বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। অপরদিকে আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তাদের সঙ্গে পৃথক জরুরি নিরাপত্তা বৈঠক করেন নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব। ওই বৈঠকে মাঠ কর্মকর্তা ও কার্যালয়ের নিরাপত্তা জোরদার করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। নির্বাচন অফিসগুলোর নিরাপত্তায় আনসার মোতায়েনে জটিলতা দূর করতে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানানো হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে ইসি। মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ২৯ ডিসেম্বর। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি একই দিনে গণভোট ও সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।

জানা গেছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করেছিল সরকার ও নির্বাচন কমিশন। তফসিল ঘোষণার ২৪ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই দুর্বৃত্তদের গুলিতে গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী জুলাইযোদ্ধা শরিফ ওসমান হাদি। পাশাপাশি নির্বাচন অফিসে অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনায় নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ইসি। নির্বাচন বানচাল করতে অথবা আতঙ্ক ছড়িয়ে ভোটকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে বলে মনে করছে কমিশন। আরও জানা গেছে, শনিবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে যোগাযোগ করেন ইসির কর্মকর্তারা। তাদের সারা দেশের এসব ঘটনার তথ্য সংগ্রহ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

এদিকে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে শনিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত কোর কমিটির জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন তারা যদি হাতিয়ার (অস্ত্র) চান, তাদেরও হাতিয়ারের লাইসেন্স আমরা দেব। যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন, তাদের হাতিয়ার যদি আমাদের কাছে জমা থাকে, সেগুলোও আমরা ফেরত দেব।

অপরদিকে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, একজন সম্ভাব্য প্রার্থীকে যেভাবে গুলি করা হয়েছে, তা সবার জন্য ‘আই ওপেনিং’ ঘটনা। এটা নিন্দনীয়। নির্বাচনের পরিবেশ বজায় রাখতে ইসির পক্ষ থেকে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। নির্বাচন অফিসগুলোর নিরাপত্তায় কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে সরকার ও ইসি নানা পদক্ষেপ নিলেও নিরাপত্তা শঙ্কা নিয়ে উদ্বিগ্ন রাজনীতিকরা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অন্তত ২০ জন সম্ভাব্য প্রার্থীর সঙ্গে আলাপ করলে তারা বলেন, প্রকাশ্য দিবালোকে ওসমান হাদিকে ফিল্মি স্টাইলে গুলি করা হয়েছে। এ ঘটনা সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। নির্বাচনি প্রচারে প্রার্থীরা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে গণসংযোগ করে থাকেন। এ সময় সাধারণ মানুষের বেশে দুর্বৃত্তরা ঘটনা ঘটালে আগাম জানা কঠিন হবে। গত ৫ নভেম্বর নির্বাচনি জনসংযোগকালে গুলিবিদ্ধ হন চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ। ওই ঘটনায় একজন নিহত হয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় নানা ধরনের নির্বাচনি সহিংস ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বে প্রকাশ্যে গুলি করে খুনের ঘটনা বেড়েছে। তারা আরও বলেন, আগামী ২১ জানুয়ারি থেকে যখন নির্বাচনি প্রচার শুরু হবে, তখন এমন ঘটনার সংখ্যা বাড়তে পারে বলে শঙ্কায় আছেন তারা। বিশেষ করে, প্রচার-প্রচারণায় প্রার্থীদের নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। অনেক প্রার্থী রয়েছেন, যাদের গাড়ি কিংবা বডিগার্ড রাখার সামর্থ্য নেই।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু যুগান্তরকে বলেন, সরকার দুষ্কৃতকারীদের এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি, অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি। চট্টগ্রামের ঘটনার (বিএনপি মনোনীত প্রার্থীকে গুলি) পর থেকে সরকারের তৎপর হওয়া উচিত ছিল। নতুন করে হাদির ওপর ঘটনা ঘটেছে, যা সরকারের ব্যর্থতা। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে বাইরে যেসব অস্ত্র পড়ে আছে, সেগুলো উদ্ধার করতে হবে। আর যাতে নতুন করে কোনো ঘটনা না ঘটে, সে বিষয়ে তৎপর হতে হবে।

সাম্প্রতিক ঘটনায় শুধু সম্ভাব্য প্রার্থী নয়, সাধারণ মানুষও শঙ্কিত বলে মন্তব্য করেছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি যুগান্তরকে বলেন, শুধু প্রার্থী নয়, জনগণও শঙ্কিত। তাদের নিরাপত্তার প্রশ্ন এখানে। ওসমান হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে, সমাজের চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের হাতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র রয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের পাকড়াও করা নির্বাচন কমিশনের প্রধানতম দায়িত্ব। যদি এই কাজে কোনো ধরনের শিথিলতা প্রদর্শিত হয়, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচনের বুলি একেবারেই ফাঁকা বলে প্রমাণিত হবে। জনগণের জীবন, নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা যে কোনো মূল্যে নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচন কমিশন এ ধরনের পদক্ষেপ নিলে জনগণ তাদের পাশে দাঁড়াবে।

প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেছেন এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, শুধু প্রার্থীরা নয়, সাধারণ জনগণ যারা আছেন, তারা সবাই এখন একটা অনিরাপত্তা পরিস্থিতির মধ্যে আছেন। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করে শাস্তির আওতায় না নিয়ে আসার কারণে তারা এখনো নানা ধরনের অপরাধ করার মতো সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে তাদের গোপন মিটিং, সেখানে সন্ত্রাসের পরিকল্পনা এবং সেগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের কাছে উপস্থাপিত হচ্ছে। কিন্তু গোয়েন্দা বাহিনী ও পুলিশ প্রশাসন এবং বর্তমানে সেনাবাহিনীও মাঠে আছে। তারা অপরাধীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে কার্যত ব্যর্থ হচ্ছে। প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করা, এটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে নাজুক অবস্থা, সেটাকেই নির্দেশ করছে।

পতিত আওয়ামী লীগের অনুসারীরা পরিস্থিতি ঘোলাটে করে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করতে এসব ঘটাচ্ছে বলে মনে করেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তিনি যুগান্তরকে বলেন, প্রত্যেক প্রার্থীর নিরাপত্তা নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে ফেলেছে। কারা এটা করছে, সেটার সহজেই একটা অনুমান তো আছেই। যেহেতু পতিত ফ্যাসিস্টরা এবং বিভিন্নভাবে নানান স্বার্থশক্তি নানাভাবে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা, তাদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনা এবং প্রত্যেক প্রার্থীর নিরাপত্তার জায়গা নিশ্চিত না করতে পারলে একটা শঙ্কা থেকেই যাবে। এর প্রভাব নির্বাচনে পড়বে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই বলে মনে করেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গত দেড় বছরে পুরোটা সময় বারবার বলে আসছি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেভাবে নিয়ন্ত্রণে আসার দরকার, সে অবস্থায় নেই। সরকারও অনেক ক্ষেত্রে শক্ত অবস্থান নিতে পারছে না। সরকারের কর্মকাণ্ডেই বোঝা যাচ্ছে, কোনো নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে নেই। যে কারণে আমরা বারবার বলছি নির্বাচন একটা চ্যালেঞ্জিং। অবশ্যই এই হামলা প্রার্থী যারা বা আমরা যারা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছি, আমাদের তো ভাবিয়ে তুলেছে। সবার তো ব্যক্তিগত গাড়ি নেই, বডিগার্ড নেই। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যদি উন্নতি না হয়, সরকার ও প্রশাসন যদি একটা ভালো অবস্থান নিতে না পারে, তাহলে তো একটা বড় ধরনের বিপদ আমাদের।

নিরাপত্তা দিতে পুলিশকে চিঠি : ইসির পক্ষ থেকে সিইসিসহ চার নির্বাচন কমিশনার ও ইসি সচিবালয়ের সিনিয়র সচিবের বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পুলিশকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সারা দেশে ইসির মাঠপর্যায়ের কার্যালয়গুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সূচি জারি করা হয়েছে। এ সূত্রে সিইসি, চার নির্বাচন কমিশনার এবং ইসি সচিবের বিশেষ নিরাপত্তা বিধান প্রয়োজন। সিইসির নিরাপত্তার জন্য ইতোমধ্যে গাড়িসহ পুলিশি নিরাপত্তা রয়েছে। সিইসির জন্য নির্বাচনকালীন অতিরিক্ত আরও একটি গাড়িসহ পুলিশি নিরাপত্তা দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া চার নির্বাচন কমিশনার ও ইসি সচিবের বাসভবন, অফিস যাতায়াতসহ সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার জন্য গাড়িসহ পুলিশি নিরাপত্তা দিতে বলা হয়েছে।

পুলিশের আইজিকে দেওয়া আরেক চিঠিতে সারা দেশে মাঠপর্যায়ের ইসির কার্যালয়গুলোর সার্বিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সূচি জারি করা হয়েছে। সময়সূচি জারির পর দুর্বৃত্তরা লক্ষ্মীপুর জেলা নির্বাচন অফিস এবং পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলা নির্বাচন অফিসে অগ্নিসংযোগ করেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশে মাঠপর্যায়ের ইসির কার্যালয়গুলোতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশ ফোর্স মোতায়েন জরুরি।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম