Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আজ

এখনো ‘অসম্পূর্ণ’ শহীদদের তালিকা নেই উদ্যোগও

স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে হয়নি কোনো তদন্ত

হাসিবুল হাসান

হাসিবুল হাসান

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এখনো ‘অসম্পূর্ণ’ শহীদদের তালিকা নেই উদ্যোগও

রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ

এখনো ‘অসম্পূর্ণ’ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের এই তালিকা পূর্ণাঙ্গ হবে কি না, এ নিয়েও এখন সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত চার ধাপে ৫৬০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নামের তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করেছিল। এরপর আর নতুন করে তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নের কাজও বর্তমানে স্থবির হয়ে রয়েছে। এ বিষয়ে নতুন কোনো উদ্যোগ নেই। সরকারি উদ্যোগে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে হয়নি বিস্তারিত তদন্তও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় শহীদ বুদ্ধিজীবীর যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দিয়েছে সেটাকে মানদণ্ড ধরলে শহীদ বুদ্ধিজীবীর প্রকৃত সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যাবে। 

এমন প্রেক্ষাপটে আবার ফিরে এসেছে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারানোর সেই বেদনাবিধুর দিন-শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে (১৪ ডিসেম্বর) দখলদার পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। পরাজয় অনিবার্য জেনে পরিকল্পিতভাবে জাতিকে মেধাহীন ও পঙ্গু করতে বরেণ্য শিক্ষাবিদ, গবেষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিকদের রাতের আঁধারে চোখ বেঁধে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের একদিন পর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। দিনটিতে গোটা জাতি বিনয় এবং শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের। 

দিবসটি উপলক্ষ্যে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এছাড়া বাণী দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেছেন, সব অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অবিচল সাহস ও দৃঢ় অবস্থান দেশের ইতিহাসে অনন্য ও চিরস্মরণীয়। দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে শোকাবহ দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ও তাদের দোসররা নির্মমভাবে হত্যা করে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের।’

প্রধান উপদেষ্টা তার বাণীতে বলেছেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে সম্মুখসারির যোদ্ধা। বুদ্ধিজীবীরা তাদের মেধা ও প্রজ্ঞার প্রয়োগ, সাংস্কৃতিকচর্চা ও ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তারেক রহমান তার বাণীতে বলেছেন, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে নিহত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। তাদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। শহীদ বুদ্ধিজীবীরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশবাসীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। বাণীতে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ আমাদের জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। জাতির ইতিহাসে দিবসটি আত্মত্যাগ, সংগ্রাম ও গৌরবের চিরন্তন স্মারক। যারা নিজেদের অমূল্য জীবন উৎসর্গ করেছেন-সেসব শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অবদান আমরা গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি। 

ইতিহাসে জঘন্যতম এই বর্বর ঘটনা বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষকে স্তম্ভিত করেছিল। পাকিস্তানি বাহিনী পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের পর ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের লাশ ফেলে রেখে যায়। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরপরই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিকট-আত্মীয়রা মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তাদের গলিত ও ক্ষতবিক্ষত লাশ খুঁজে পায়। বুদ্ধিজীবীদের লাশে ছিল আঘাতের চিহ্ন। চোখ, হাত-পা ছিল বাঁধা। কারও কারও শরীরে ছিল একাধিক গুলি। অনেককে হত্যা করা হয়েছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে। লাশের ক্ষতচিহ্নের কারণে অনেকেই প্রিয়জনের লাশ শনাক্ত করতে পারেননি। 

মুক্তিযুদ্ধ গবেষকরা বলছেন, ২৫ মার্চের পর থেকেই আসলে বাংলাদেশজুড়ে বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের গ্রেফতার আর হত্যা শুরু হয়েছিল। কিন্তু নভেম্বর মাস থেকে সেই কর্মকাণ্ড আরও জোরদার করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা। মূলত পরাজয় নিশ্চিত জেনেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের এ দেশীয় সহযোগীদের মাধ্যমে আলবদর বাহিনী করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে।

এদিকে মুক্তিযুদ্ধের পর গত পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা নিয়ে যেসব তথ্য-উপাত্ত বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই তার ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। এছাড়া এ ঘটনা নিয়ে এখন পর্যন্ত সরকারি পর্যায় থেকে বিস্তারিত তদন্তও হয়নি। জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, বীরপ্রতীক যুগান্তরকে বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা আগে যেটুকু ছিল, ওইটুকুই আছে। আর নতুন করে কোনো উদ্যোগ নেই। ৪ দফায় ৫৬০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নামের তালিকার যে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছিল, সেটাই তাহলে চূড়ান্ত তালিকা কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটার তো একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা ছিল। কিন্তু এরপর আর কোথাও থেকে নতুন করে কোনো তালিকা আসেনি। 

জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আওলাদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, এই কাজ (শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়ন) যে একদম হয়নি তা নয়। তবে জাতীয় পর্যায় থেকে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে সে রকম বড় কাজ হয়নি। যার কারণে সুনির্দিষ্ট করে আমরা এখনো বলতে পারছি না আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবী আসলে কতজন। পাশাপাশি বাংলাদেশে নির্মোহভাবে সঠিক ইতিহাস উঠে আসার ক্ষেত্রেও পক্ষপাতিত্ব দেখা গেছে। ফলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যারা আমাদের নেতৃত্ব দেবে তাদের কাছে বিষয়গুলো পরিষ্কার নয়। বিগত সরকার এটাকে আরও বেশি ম্যানুপুলেটেড করে ফেলেছে। তিনি বলেন, এখন একটা পরিবর্তিত পরিস্থিতি চলছে। সামনে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সামনের নির্বাচিত সরকার যদি এ বিষয়ে মনোযোগী হয়, তারা যদি এটাকে গুরুত্ব দিয়ে গবেষণার আলোকে প্রকৃত তথ্যগুলোকে বের করে আনে, তাহলে একটা সুন্দর তালিকা পেতে পারি। আমরা সেই প্রত্যাশাই করি। 

আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা গেছে, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা এক হাজার ৭০ জন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে একাত্তরের ২৯ ডিসেম্বর গঠিত বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাও ফরমান আলী ২০ হাজার বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু এই পরিকল্পনামতো হত্যাযজ্ঞ চালানো সম্ভব হয়নি। কারণ ফরমান আলীর টার্গেট ছিল শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের গভর্নর হাউজে নিমন্ত্রণ করে মেরে ফেলা। বাংলাপিডিয়ার হিসাব বলছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ১ হাজার ১১১ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল ঢাকায়, ১৪৯ জন। তবে ইতিহাসবিদরা বলছেন, সংখ্যার দিক থেকে বিবেচনা না করে যদি জনসংখ্যা আর মৃত্যুর হার হিসাব করা হয় তাহলে ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে আরও বেশিসংখ্যক বুদ্ধিজীবী মারা গেছেন কিন্তু তাদের আসলে সেভাবে স্মরণ করা হয় না।

এদিকে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নে ২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর গবেষক, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে ১১ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। এরপর দুটি উপকমিটি করা হয়। একটি কমিটির কাজ ছিল ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী’র সংজ্ঞা নির্ধারণ করা। সেই সংজ্ঞা অনুসারে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম সংগ্রহ ও তা যাচাই-বাছাই করা অন্য কমিটির কাজ। প্রথম কমিটির কাজ শেষে ২০২১ সালের ২১ মার্চ শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হয়। এরপর চার দফায় মোট ৫৬০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। এর মধ্যে প্রথম দফায় ২০২১ সালের ৭ এপ্রিল ১৯১ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম গেজেট আকারে প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এরপর ২০২২ সালের ২৯ মে দ্বিতীয় তালিকায় ১৪৩ জন, তৃতীয় দফায় ২০২৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ১০৮ জন এবং চতুর্থ দফায় একই বছরের ২৪ মার্চ ১১৮ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নামের গেজেট প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। চতুর্থ দফার তালিকা প্রকাশের সময় জানানো হয়েছিল ওই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করার। 

দিবসের কর্মসূচি : শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষ্যে আজ সকাল ৭টা ৫ মিনিটে রাষ্ট্রপতি মো. শাহাবুদ্দিন এবং সকাল ৭টা ৬ মিনিটে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বেসরকারি টিভি চ্যানেল সরাসরি সম্প্রচার করবে। এরপর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টার নেতৃত্বে শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যরা এবং যুদ্ধাহত ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা সকালে মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ এবং রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সর্বস্তরের মানুষের জন্য তা উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। এদিন বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, আলোচনা সভা, গান, আবৃত্তি, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী, স্বেচ্ছায় রক্তদান, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। 

বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে এ দিন বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করবে। সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করবে বিশেষ ক্রোড়পত্র। জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। এছাড়াও সব মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ও অন্যান্য উপাসনালয়ে বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনা করা হবে। এদিন দেশের সর্বত্র জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। ওড়ানো হবে শোকের প্রতীক কালো পতাকা।


Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম