Logo
Logo
×

জাতীয়

মৃত্যুর আগে হাসিনাকে নিয়ে জবানবন্দিতে যা বলে গেছেন বদরুদ্দীন উমর

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৩:৩৩ পিএম

মৃত্যুর আগে হাসিনাকে নিয়ে জবানবন্দিতে যা বলে গেছেন বদরুদ্দীন উমর

সংগৃহীত ছবি

সদ্যপ্রয়াত লেখক, গবেষক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক ও জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। এ বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি তিনি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে ৬ পৃষ্ঠার জবানবন্দি দেন এবং ভিডিও জবানবন্দিও রেকর্ড করা হয়। 

রোববার (৭ সেপ্টেম্বর) উমর মারা যাওয়ার পর ওই জবানবন্দি প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। উমরের সাক্ষ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনার শাসনামলে নির্বাচনের কারচুপিসহ প্রশাসন, পুলিশ ও বিচারব্যবস্থার ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক দমন ও দুর্নীতির নজির দেখা গেছে।

জবানবন্দিতে বদরুদ্দীন উমর বলেছিলেন, ‘আমি বদরুদ্দীন উমর। পিতা মরহুম আবুল হাশিম। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। ভারত বা পাকিস্তানে এমন জনতার শক্তি ও ব্যাপকতার গণঅভ্যুত্থান কখনো দেখা যায়নি। বাংলাদেশ নিজেই একটি ‘গণঅভ্যুত্থানের দেশ’—১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৯০ সালের ঘটনাগুলো তার উদাহরণ। তবে এসব অভ্যুত্থানের মধ্যে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান ছিল সবচেয়ে বিস্ফোরক, সবচেয়ে রূপান্তরমূলক। ভাষা আন্দোলনের (১৯৫২) মধ্য দিয়ে ভাষার স্বীকৃতি এসেছিল, ১৯৬৯-এ আইয়ুব খানের পতন হয়েছিল, ১৯৯০-এ এরশাদের পতনের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু এসব আন্দোলনে এমন সর্বগ্রাসী ভাঙন, এমন পলায়নপর সরকার বা দল দেখা যায়নি।’

‘২০২৪ সালের অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। শুধু তিনিই নন—তার মন্ত্রিসভা, দলের কেন্দ্রীয় নেতারা, এমনকি তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও দেশ ছেড়ে পালায়। এই রকম ব্যাপক দলীয় পতন, আতঙ্ক ও আত্মগোপন বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনো ঘটেনি। সিরিয়া বা অন্য কোনো দেশে, স্বৈরাচার পতনের পরও এত সংগঠিত দলীয় পলায়ন দেখা যায়নি। এই অভ্যুত্থানের গভীরতা বোঝাতে একটি প্রতীকী চিত্র যথাযথ শেখ হাসিনার পালানোর পরদিন থেকেই সারা দেশে শেখ মুজিবের মূর্তি ও ম্যুরাল সাধারণ মানুষ নিজেরা ভেঙে ফেলে। কেউ কোনো নির্দেশ দেয়নি, তবুও এটি ঘটেছে। এটি এক ধরনের প্রকৃতির প্রতিশোধ—যার বহিঃপ্রকাশ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়ায় হয়েছে। বহু বছর ধরে নির্যাতিত, অবদমিত জনগণের ক্রোধ এই অভ্যুত্থানে বিস্ফোরিত হয়েছে।’

‘শেখ মুজিব নিজেই একসময় পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, সিরাজ শিকদার কোথায়?—যেটা ছিল একটি অমানবিক ব্যঙ্গ। কিন্তু ইতিহাসের প্রতিশোধ হয়েছিল ওই বছরেরই আগস্টে, যখন মানুষ বলেছিল—শেখ মুজিব কোথায়? এভাবে ইতিহাসে অনেক সময় ঘটনাগুলো পুনরাবৃত্তি হয় প্রতিশোধের রূপে।’

‘এই অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগ শুধু ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়নি, তারা জনগণের বিশ্বাস থেকেও বিতাড়িত হয়েছে। মুসলিম লীগের পতনের মতোই—এবারের গণঅভ্যুত্থান আওয়ামী লীগের জন্য একটি চূড়ান্ত রাজনৈতিক পরিণতি তৈরি করেছে। ভারতের সহায়তায় তারা হয়তো কিছু অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালাতে পারে, কিন্তু জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের পুনরুত্থান অসম্ভব বলেই মনে হয়।’

‘এছাড়া এই অভ্যুত্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ছাত্রদের ভূমিকা। তারাই এই আন্দোলনের প্রধান চালিকা শক্তি ছিল। ইতিহাসে ছাত্ররা বারবার নেতৃত্ব দিয়েছে, কিন্তু এবারের আন্দোলনে তারা যে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা, সাহস ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছে, তা বিরল।’ 

আওয়ামী লীগের শাসনামল নিয়ে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের শাসনামলে শেখ হাসিনা বড় বড় ধরনের সব অপরাধ করেছে। আর শেখ হাসিনাকে এই সময়ে ভারত সমর্থন দিয়ে গেছে। সে দীর্ঘদিন ভারতে থাকার সময়ে সেখানে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করেছে। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র-এর সঙ্গে তার যে গভীর সম্পর্ক ছিল, এটা কোনও নতুন ব্যাপার ছিল না। এই সম্পর্কের ভিত্তি ছিল যে, ভারতই একমাত্র রাষ্ট্র যেটা তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। ফলে পতনের পরে সে ভারতে পালিয়েছে। সে ওখানেই থাকবে। ওখানে থাকাটাই এক ধরনের শাস্তি সেখানে সে জ্বলে-পুড়ে মরবে। আরেকটা শাস্তি হতে পারে যেটা আমি মনে করি—ভারত সরকার তাকে মেরে ফেলবে, নিজেদের বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে। তারা যতদিন তাকে রাখবে, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো হবে না। আর সেই সম্পর্ক ভালো করতে গেলে তার ব্যাপারে একটা ফয়সালা করতে হবে। তাকে ওখানে রাখা যায় কি যায় না—সে প্রশ্ন না। তবে যদি মেরে ফেলে নরেন্দ্র মোদি, আশ্চর্য হবেন না। তারা এমনভাবে বিষয়টা সাজাবে যে মনে হবে বাংলাদেশি কেউ তাকে মেরেছে। এরকম একটি সংগঠিত প্রচার চালাবে।’

‘শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ক্ষমতায় ছিল নির্বাচনগুলো নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচন—এগুলো প্রতিটা সে ম্যানিপুলেট করেছে। এগুলো সম্ভব হয়েছে কারণ রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ওপর, নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে পুলিশ এবং আমলাতন্ত্র—সব কিছুর ওপর সে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল।’

প্রসঙ্গত, গত ২২ জুলাই শ্বাসকষ্ট ও নিম্ন রক্তচাপ নিয়ে বদরুদ্দীন উমর হাসপাতালে ভর্তি হন। দীর্ঘ ১০ দিন চিকিৎসা শেষে তিনি বাসায় ফেরেন গত সপ্তাহে। রোববার (৭ সেপ্টেম্বর) সকালে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে রাজধানীর শ্যামলীতে স্পেশালাইজড হাসপাতালে নেওয়া। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০টা ৫ মিনিটে তিনি মারা যান।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম