Logo
Logo
×

জাতীয়

প্রতারণার ফাঁদে পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ বহু সরকারি চাকুরে

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২৫, ০১:২৭ পিএম

প্রতারণার ফাঁদে পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ বহু সরকারি চাকুরে

এক যুবকের প্রতারণার ফাঁদে ফেঁসে গেছেন পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তাসহ বহু সরকারি চাকুরে। প্রতারকের নাম মোতাল্লেছ হোসেন। তিনি কখনো নিজেকে বড় গার্মেন্ট ব্যবসায়ী, কখনো বড় রাজনৈতিক দলের লিয়াজোঁ অফিসার পরিচয় দেন। তার প্রতারণার শিকার হয়ে অনেকে বোকা বনে গেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও মুখ খুলতে পারছেন না, সম্মানহানির ভয়ে। প্রতারণা করেই মোতাল্লেস সরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় ২৬ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও যুগান্তরের অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর এ তথ্য উঠে এসেছে। 

মোতাল্লেছ হোসেনের প্রতারণার ফাঁদে পুলিশের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ধরাশায়ী হয়েছেন। যদিও তিনি চাকরি রক্ষার স্বার্থে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে চলছেন। তবে প্রতারক মোতাল্লেছ হোসেনের ব্যাংক হিসাবে নমিনি হিসাবে স্বাক্ষর করে একরকম ফেঁসে গেছেন। বিএফআইইউ অবশ্য তাকে বেশ সন্দেহের চোখে দেখছে। যে কারণে বিএফআইইউর এসংক্রান্ত পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোতাল্লেছ ও তার ভাই সম্মিলিতভাবে একটি সংঘবদ্ধ চক্র গড়ে তুলে চাঁদাবাজি ও প্রতারণা করেছেন। এভাবে অর্থ উপার্জন করে অবৈধ অর্থ জায়েজ করতে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বৈধ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এক্ষেত্রে তিনি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ব্যবহার করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়। প্রকৃতপক্ষে মোতাল্লেছের ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক লেনদেনের একটি অংশের সুবিধাভোগী হতে পারেন পুলিশের ওই কর্মকর্তা।

বিএফআইইউর প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মোতাল্লেছ গত বছরের ৫ নভেম্বর সিটি ব্যাংকের গুলশান শাখায় একটি ব্যাংক হিসাব খোলেন। হিসাবটিতে ৩ মাসে ৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা জমা হয়। এই অ্যাকাউন্ট থেকে ১২ লাখ টাকা এফডিআর করা হয়। পাশাপাশি প্রিমিয়ার ব্যাংকের যশোর শাখায় মানহা জেম ইন্টারন্যাশনালের হিসাবে ৩ কোটি ২৫ লাখ, এমএল ট্রেডিংয়ের নামে পল্লবীর শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে আড়াই কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়। এছাড়া তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এমএল ট্রেডিং ও মানহা জেম ইন্টারন্যাশনালে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। এত বিপুল লেনদেন করলেও আয়কর নথিতে কিছুই দেখাননি। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আয়কর রিটার্নে মোট আয় সাড়ে ৪ লাখ টাকা এবং নিট সম্পদ ৩৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেখিয়েছেন তিনি। 

মোতাল্লেছের ভাই মোদাচ্ছের হোসেনের মালিকানাধীন এমএল এন্টারপ্রাইজের ব্যাংক হিসাব খোলা হয় ২০১৪ সালে। সেই থেকে ২০২৪ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত ১০ বছরে ৮ লাখ ৯০ হাজার টাকা জমা হয়। কিন্তু ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত ৬ মাসে ২ কোটি ৬৬ লাখ টাকা জমা হয় এবং সমপরিমাণ অর্থ উত্তোলনও করা হয়।

বিএফআইইউর প্রতিবেদনের তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধানে নামে যুগান্তর। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, জাল ঠিকানা ব্যবহার করে মোতাল্লেছ তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এমএল ট্রেডিংয়ের ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছেন। ওই ঠিকানায় (১১/এ, মেইন রোড-৩, প্লট-১০, মিরপুর) এই নামের প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেখানে কাচ দিয়ে ঘেরা সেমিপাকা দোকান বানানো হয়েছে। ওই দোকানগুলোতে বেবি শপ, বেসরকারি ব্যাংকের বুথ ও মোটরসাইকেল বিক্রির শোরুম ভাড়া দেওয়া হয়েছে।


মোতাল্লেছ হোসেনের বাসায় (বাড়ি- ৯/৫, ৬ষ্ঠ তলা, পল্লবী, মিরপুর) গিয়ে জানা যায়, ওই ভবনের ৭ তলায় তিনি একাই ভাড়া থাকতেন। গত ২ মাস আগে রাতের আঁধারে মালপত্র রেখে বাসা থেকে পালিয়ে যান। ওই বিল্ডিংয়ের ৫ তলার ভাড়াটিয়া ফারুক নামে এক ব্যক্তি বলেন, মোতাল্লেছ একজন প্রতারক ও ভণ্ড প্রকৃতির লোক। তিনি নিয়মিত হ্যারিয়ার গাড়িতে চলাফেরা করতেন। গত ২ মাস আগে তার খোঁজে ডিবির লোকজন এই বাড়িতে আসেন। তবে প্রতারককে না পেয়ে বাড়ির সব ভাড়াটিয়াকে ডেকে ডিবির লোকজন মোতাল্লেছ সম্পর্কে জানতে চান। পরে ডিবির এক অফিসার হোয়াটসঅ্যাপে কল দিলে মোতাল্লেছ জানান, তিনি থাইল্যান্ডে আছেন।

অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে জানতে চাইলে মোতাল্লেছ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, এ ঘটনায় সিআইডি তদন্ত করছে। তদন্ত সংস্থাটি ১৫-২০ দিন আগে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা এবং রাষ্ট্রের একজন আইন কর্মকর্তা প্রতিহিংসাবশত এই কাজটি করেছে। বিএফআইইউর প্রতিবেদনটি ভুয়া। পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজির সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক-এই প্রশ্নের জবাবে মোতাল্লেছ বলেন, উনি আমার ক্রেডিট কার্ডের নমিনি ছিলেন। তাও ক্রেডিট কার্ডটা এফডিআরের বিপরীতে নেওয়া হয়েছে।

এদিকে এ বিষয়ে বড় সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে মোতাল্লেছ হোসেনের বড় ভাই মোদাচ্ছের হোসেনের এক মন্তব্যে। তিনি যুগান্তরের কাছে দাবি করেন, মূলত প্রতিহিংসাবশত মোতাল্লেছের বিরুদ্ধে ভুল তথ্য ছড়িয়ে তাকে ফাঁসানো হয়েছে। সিআইডি যে মোতাল্লেছের অপকর্ম খুঁজছে, এই মোতাল্লেছ সেই মোতাল্লেছ নয়। নামের মিল থাকায় তাকে হেনস্তা করা হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, মোতাল্লেছ নিয়মিত আয়কর রিটার্ন জমা দেয়নি, এটি তার অপরাধ হতে পারে। এর বাইরে চাঁদাবাজি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ সঠিক নয়। মোতাল্লেছের অ্যাকাউন্ট থেকে নিজের অ্যাকাউন্টে মোটা অঙ্কের টাকা স্থানান্তরের বিষয়ে তিনি জানান, ব্যবসায়িক কাজে তার অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো হয়েছে।

অপরদিকে সন্দেহের তালিকায় থাকা পুলিশের ওই অতিরিক্ত ডিআইজি যুগান্তরকে বলেন, ‘তারা দুই ভাই আমার আত্মীয়স্বজন নয়। ওদের গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহ। আমার গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ী জেলায়। কিন্তু মোতাল্লেছের ব্যাংক হিসাবের নমিনি হলাম কীভাবে, তাও আমার জানা নেই।’ তিনি আরও বলেন, অফিশিয়াল কাজের সূত্রে মোতাল্লেছ দুই-একবার আমার অফিসে এসেছিল। এর বাইরে তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই, জানাশোনাও নেই।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম