Logo
Logo
×

জাতীয়

যুগান্তরকে একান্ত সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ রফিকুল আলম

সেদিন আমি বঙ্গবন্ধুর পা ছুঁয়ে সালাম করেছিলাম

Icon

যোবায়ের আহসান জাবের

প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২০, ০৪:০১ এএম

সেদিন আমি বঙ্গবন্ধুর পা ছুঁয়ে সালাম করেছিলাম

অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ রফিকুল আলম। ছবি: যুগান্তর

দেশের প্রখ্যাত কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ রফিকুল আলম। বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) প্রোভিসি (প্রশাসন) পদে দায়িত্ব পালন করছেন। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় বোর্ডে মেধা তালিকায় স্থান অর্জনকারী চট্টগ্রামের এ কৃতি সন্তান স্কুলে পড়ার সময় বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেন। 

বসন্তের এক বিকালে যুগান্তরকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন তার নানা স্মৃতিময় কথা। এছাড়াও বলেছেন বাংলাদেশে কিডনি রোগ ও এর চিকিৎসা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা।  সাক্ষাৎকার নিয়েছেন যোবায়ের আহসান জাবের

যুগান্তর: আপনার শৈশব, কৈশোর ও বেড়ে ওঠার গল্প শুনতে চাই।

অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ রফিকুল আলম: আমাদের শৈশব-কৈশোরটা খুব সুন্দর ছিল। আমরা সাত ভাইবোনের এক পরিবার।

আমাদের স্কুল জীবন, আমাদের পারিবারিক জীবন খুবই সুন্দর ছিল। আমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরাসরি দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হই। এটা ছিল ফটিকছড়ি থানায় আজিমপুর প্রাইমারি স্কুল। পরে আমার বাবা সরকারি চাকরিজীবী হওয়ায় তাঁর বদলিজনিত কারণে বিভিন্ন জায়গায় আমাদের চলে যেতে হতো। যার ফলে পরবর্তীতে আমি পটিয়া স্কুলে ভর্তি হই।পটিয়ায় তখন দুটো ভালো স্কুল ছিল। একটি ছিল রাহাত আলী স্কুল, আরেকটি ছিল পটিয়া মডেল স্কুল।

রাহাত আলী স্কুল ছিল মুসলিম প্রধান ।আর পটিয়া মডেল স্কুল ছিল হিন্দু প্রধান। আমার বাবা ভালো স্কুলে পড়ানোর জন্য সবসময় আমাদের তার সঙ্গেই রাখতেন।

ওই সময় পটিয়া মডেল স্কুলের খুব সুনাম ছিল, এজন্য আমার বাবা আমাকে ওই স্কুলে ভর্তি করান।  প্রধান শিক্ষক বাবু রমেশ চন্দ্র রায় একজন বিখ্যাত শিক্ষক ছিলেন। শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে দুইবার পুরস্কারপ্রাপ্ত। তার সহকর্মীরাও সবাই হিন্দু শিক্ষক ছিলেন। ধর্মীয় শিক্ষক যিনি আরবি পড়াতেন তিনিই কেবল মুসলিম ছিলেন।

ওই স্কুলে আমার সহপাঠী ছিল হানিফ সংকেত (বর্তমানে বিটিভির জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ইত্যাদির উপস্থাপক)। আমি প্রতিবারই ক্লাসে প্রথম হতাম। হানিফ কখনও দ্বিতীয় হতো,| সে তখন থেকেই খুবই মেধাবী ও সংস্কৃতিবান ছিল।

ছোটবেলায় আমরা নাটকেও অভিনয় করেছি। বিশেষ করে হানিফের উৎসাহে আমি নাটকে অভিনয় করি। আমি প্রথম নাটকে মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করি (হেসে)। খুব মনে পড়ে। ছোটবেলায় আমরা দেয়াল পত্রিকায় লিখতাম। হানিফ সংকেত ছোটকালেই গান শিখত স্বর্গীয় রানী প্রভা চৌধুরীর কাছে।

চট্টগ্রাম কলেজ থেকে পাস করার পরে চিটগাং মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই। ১৯৭৩ সালে এসএসসি ও ১৯৭৫ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দিই। ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেলে ভর্তি হই।

আমার আরবি শিক্ষক ছিলেন মৌলভী ইউনুস সাহেব। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, তোমার ধর্ম পরীক্ষার উত্তরপত্র আমি সংরক্ষণ করেছি।

তিনি আমাকে ১০০ তে ৯৮ নাম্বার দিয়েছিলেন, এবং সেগুলো তিনি সংরক্ষণ করেছিলেন। তখন আমি আরবি লিখতে পারতাম।

পরে একদিন দেখা হওয়ার পর তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি তোমার খাতা এখনও রেখে দিয়েছি। আমি বিভিন্ন সময় সেগুলো ক্লাসে দেখাই।

চট্টগ্রাম মেডিকেলে আমি ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা যখন প্রবাস থেকে দেশে ফেরেন সেবছর আমি  চট্রগ্রাম মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলাম।

আমরা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের বিজ্ঞান মেলার আয়োজন করেছি। ছাত্রদের বিভিন্ন ধরণের আঞ্চলিক আন্দোলনে আমি যুক্ত থাকতাম। বিভিন্ন সময় পত্রিকা বের করেছি।

যুগান্তর: মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আপনি কোন ক্লাসে পড়তেন? আপনি স্কুলে পড়াকালীন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আপনার বিশেষ স্মৃতিকথা শুনেছি। সে প্রসঙ্গে কিছু বলুন।

অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ রফিকুল আলম: আমার এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার আগেই মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় আমরা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। ১৯৭০ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার একটা দুর্লভ সৌভাগ্য হয়। জাতির পিতাকে খুব কাছ থেকে দেখার। আমি তার পা ছুঁয়ে সালাম করেছিলাম, আমার মনে আছে। সত্তরের নির্বাচনের আগে তিনি কক্সবাজার থেকে পথসভা করে পটিয়াতে আসছিলেন।

সেদিন পটিয়ায় এসে পৌঁছাতে রাত ১১টা বেজে যায়। পটিয়া কলেজের মাঠে  তাকে রিসিভ করার জন্য আমরা স্কুলের ছেলেমেয়েরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিলাম। বিশেষ করে যারা অফিসারের ছেলেরা ছিল তাদেরকে বেছে রাখা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ফুল দিয়ে বরণ করার জন্য। আমিও সে গ্রুপে ছিলাম। আমরা সেসময় বঙ্গবন্ধুকে পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। রাত ১১টা বাজে।

তিনি বক্তৃতার জন্য উঠলেন। আমার যতদূর মনে পড়ে, যাদের কথা মনে আছে-বেগম বদরুননেসা আহমেদ, আমেনা বেগম তারা সঙ্গে ছিলেন। বেগম বদরুন্নেসা ও আমেনা আপা ধবধবে সাদা শাড়ি পরা, বঙ্গবন্ধু সাদা পাঞ্জাবি পরা ছিলেন।

পরবর্তীকালে মালেক মন্ত্রিসভার সদস্য উবায়দুল্লাহ মজুমদার সেই সময় পটিয়া কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন। তিনি পটিয়া কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি শামসউদ্দীনকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করেন, বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতায় শামস উদ্দীনের বহিষ্কার প্রত্যাহার করতে বলেন।

রাতের বেলায় হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে মিটিং চলছিল। হ্যাজাক লাইট থেকে পোকা এসে বঙ্গবন্ধুর চুলে, পাঞ্জাবির ভেতরে আসছিল। আমরা দুই-তিনজন ছেলে উঁচু টোলের উপর দাঁড়িয়ে পোকাগুলো সরিয়ে দিচ্ছিলাম। এটা আমার জীবনের দুর্লভ স্মৃতি বা সৌভাগ্য। 

যুগান্তর: এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। দেশের সব জেলা শহরে কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার চালু নিয়ে কিছু বলুন। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ রফিকুল আলম: ওই বিশেষায়িত সেন্টারগুলো চালু হলে জনসাধারণ খুবই উপকৃত হবেন। যাতায়াতের দূরত্ব কমে যাওয়ায় তারা নির্বিঘ্নে সেবাটা নিতে পারবেন। 

ডায়ালাইসিস সেন্টারগুলো চালু হয়ে গেলে আমরা আশা করছি যে, এগুলো আমরা দেখভাল করতে পারব। তার কারণ হলো, এখন দেশের বেশিরভাগ কিডনি বিশেষজ্ঞ এখন ঢাকা কেন্দ্রিক। তখন কিন্তু ডিসেন্ট্রালাইজ হবে। এটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এজন্য তাকে আমি বাংলাদেশ রেনাল এসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই।

যুগান্তর: নতুন কিডনি সেন্টারগুলো চালু করতে যে পরিমাণ জনবল বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রয়োজন সেই পরিমাণ জনবল কি আছে?

অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ রফিকুল আলম: সেই পরিমাণ জনবল এই মুহূর্তে নেই, তবে আমরা প্রতি বছর ৩০-৪০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বের হচ্ছে। আমাদের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ এবং বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এমডি কোর্স চালু আছে। বিসিপিএসে এফসিপিএস নেফ্রোলজি কোর্স চালু আছে। যার ফলে আমাদের কিডনি বিশেষজ্ঞ প্রতি বছর বাড়ছে। অচিরেই আমরা আমাদের দেশের চাহিদার কাছাকাছি পৌঁছে যাব|

যুগান্তর: দেশে কিডনি রোগীর অবস্থা কেমন?

অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ রফিকুল আলম: দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা প্রচুর।  প্রায় ২ কোটির কাছাকাছি কিডনি রোগী। প্রতি বছর ৩০-৪০ হাজার নতুন কিডনি রোগী যুক্ত হচ্ছে।

যুগান্তর: আমরা জানি, কিডনি চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। গরিব রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে আপনার পরামর্শ কী?

অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ রফিকুল আলম:   কিডনি চিকিৎসায় যে পরিমাণ ব্যয় হয় রাষ্ট্রের পক্ষে সেটা বহন করা সম্ভব না। কিডনি রোগীদের সরকারি হাসপাতাল পুরো ভার নিতে পারছে না। সরকারি হাসপাতাল নামমাত্র মূল্যে, বেশিরভাগ বিনামূল্যেই ডায়ালাসিস সেবা দিচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে এটা হচ্ছে। আর বেসরকারি পর্যায়ে যেসব ডায়ালাসিস সেন্টার রয়েছে সেখানে তারা তাদের মত করে  ডায়ালাইসিসের মূল্য নির্ধারণ করে। সেখানে ড্রপআউটের সংখ্যা খুবই বেশি। সার্বিকভাবে ১০ ভাগের বেশি রোগী এটি ছয় মাসের বেশি চালাতে পারে না। তারা ঝরে পড়ে। এ জায়গায় যদি স্বাস্থ্য বীমা চালু করতে পারি তাহলে এ সমস্যা সমাধান হতে পারে। এখানে বিভিন্ন এনজিওকেও এখানে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। ব্র্যাকের মতো এনজিও এখানে এলাকাভিত্তিক দায়িত্ব নিতে পারে। সরকারও ভাগাভাগি করে দায়িত্ব নিতে পারে। পুরোটা সরকারের পক্ষে হয়তো সম্ভব না। কারণ, আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনা করলে এ জায়গায় পৌঁছাতে আরেকটু সময় লাগবে।

এখানে কিডনি বিশেষজ্ঞ, কিডনি ডায়ালাইসিস, কিডনি চিকিৎসায় সম্পৃক্ত নার্স ইত্যাদির সংখ্যা বাড়াতে হবে। কিডনি সংযোজনের জন্য কিডনি ট্রান্সপ্ল্যানটেশন সংখ্যা বাড়াতে হবে। এজন্য সুযোগ-সুবিধাগুলো বাড়াতে হবে। ট্রান্সপ্ল্যানটেশনের রোগীদের ওষুধপত্রগুলোর দাম বেশি, সেসবের ওপর ভ্যাট-ট্যাক্স মওকুফ করে সেগুলো সহজলভ্য করতে হবে।

সিএপিডি বলে একটা ডায়ালাইসিস আছে যেটা peritoneal ডায়ালাইসিও বলা হয়। এটা ঘরে বসে করা যায়। কেউ এটা হোম এটাকে হোম ডায়ালাইসিস বলে। এটাতে পেটে একটা ক্যাথেটার ফিট করে রাখা হয়। এটার মাধ্যমে একটা ডায়ালাইসিস সলিউশন পেটের মধ্যে ঢুকানো হয়, এটা ছয় ঘন্টা রেখে সংযুক্ত টিউবের আরেক প্রান্ত দিয়ে সলিউশনটা বের করে আনা হয়। এটা বাংলাদেশের জন্য খুবই উপযোগী মনে করা হচ্ছে।

দূর-দূরান্তের রোগীরা এটা ঘরে বসে করতে পারবেন। এটা সীমিত মাত্রায় চালু আছে, কিন্তু পেরিটনিয়াল ডায়ালাইসিস ফ্লুই আমদানি করতে হয়।  বছরে এটার জন্য রোগীদের প্রত্যেকের প্রায় আড়াই লাখ টাকার মতো ফ্লুইডের পেছনে খরচ হয়ে যায়। সিএপিডির ফ্লুইডটা যদি সরকার দেশে তৈরির ব্যবস্থা করতে পারে তাহলে জনসাধারণ উপকৃত হবেন।

যুগান্তর: কিডনি বিশেষজ্ঞ তৈরিতে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা পর্যাপ্ত কিনা?

অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ রফিকুল আলম:  আমাদের আসনগুলো এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত। এরপরেও এগুলো বাড়ানো সম্ভব, এগুলো কোন ফিক্সড না। যখনই দরকার হয় এগুলো বিশ্ববিদ্যলয় চাইলে সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে পারে। তবে আসন সংখ্যা বাড়াতে গেলে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর অনুপাতেরও একটা ব্যাপার আছে। সেটাও একটা উন্নত দেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে করতে হয়। যেমন ধরুন এখানে ২জন শিক্ষক আছে আপনি ছাত্র দিয়ে দিলেন ১০-১২ জন তাহলে হবে না। তাদেরকে সুপারভাইজ করতে হবে।

যুগান্তর: সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ রফিকুল আলম: আপনাকেও ধন্যবাদ। যুগান্তরের সব পাঠকদের শুভেচ্ছা জানাই।

অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ রফিকুল আলম

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম