|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কতটা নাজুক, এবারের করোনা এসে সবার চোখে আঙুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিয়েছে। বছরের পর বছর ধরে এ খাতে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে কিন্তু সে তুলনায় ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেনি। সেবা নিশ্চিত হয়নি সাধারণ মানুষের। অনিয়ন্ত্রিত লুটপাট, অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে এমনটি হয়েছে। চিকিৎসাসেবায় গোড়ায় গলদের বিষয়টি করোনাকালেই প্রকাশ্যে চলে এসেছে। বাজেটে অর্থ বাড়ালেই রোগ সারবে না। দরকার সুস্থ স্বাস্থ্য অবকাঠামো। ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে কীভাবে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করানো যায়, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছেন- মিজান মালিক
সেবা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য খাতের অডিট দরকার- ইকবাল মাহমুদ: আমি মনে করি, সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যেন চিকিৎসা সুবিধা পায় সেভাবে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা সাজাতে হবে। আমাদের দেশে এখন ‘ইনক্লোসিভ’ (অন্তর্ভুক্তিমূলক) স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দরকার। বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতে নিয়মিত অডিট প্রয়োজন। আমাদের কী কী সুবিধাদি আছে, কী নেই, আমাদের প্রয়োজন কীÑ বড় বড় হাসপাতালে অডিট করলে এগুলো স্পষ্ট হবে। আমাদের ঘাটতি কী আছে তা সামনে আসবে। কীভাবে তা পূরণ করতে হবে সেটাও দেখা যাবে। অডিটের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেয়া হলে তা অধিক কার্যকর হবে।
করোনা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশা। সীমাহীন দুর্নীতির কারণে এটা হয়েছে। যন্ত্রপাতি ছাড়া খালি বাক্সও কেনা হয়েছে। ইউনিয়ন বা উপজেলা পর্যায়ে কিছু স্টেশন আছে। সেটি সচল করতে হবে, একজন ডাক্তার ঘুরে ঘুরে সেখানে যাবেন।
আমি মনে করি, ডাক্তারদের পড়শোনার গুণগত মান বাড়াতে হবে। যোগ্যতা সম্পন্নরাই পেশায় নিয়োগ পাবেন। বিদেশে দেখেছি, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সেক্টরের কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য সিভিল সোসাইটিকে যুক্ত করা হয়। আমাদের দেশেও জেলা পর্যায়ে হাসপাতালগুলোতে এ ধরনের কমিটি ছিল বলে জানি। তবে এখনও সেগুলো বহাল কিনা জানি না। প্রত্যেক হাসপাতালে সিভিল সোসাইটিকে যুক্ত করা হলে খুবই ভালো হয়। এতে ট্রান্সপারেন্সি ও গুড গভার্নেন্স নিশ্চিত হবে।
অবকাঠামো নামমাত্র গোড়ায় হাত দিতে হবে-ড. ইফতেখারুজ্জামান: চিকিৎসাসেবা পর্যায়ে দুর্নীতির শিকার হন জনগণ। এখন হয়রানিটা বেশি। গত তিন মাসে আমরা যা দেখেছি, তাতে স্পষ্ট হয়েছে অব্যবস্থাপনা চরম, আছে সক্ষমতার ঘাটতিও। বাজেট বাড়ালেই হবে না, তা বাস্তবায়নে কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে। টাকা কোথায় কী কারণে ব্যয় হবে, সেটা তদারকির আওতায় আনতে হবে। কেনাকাটায় অনিয়ম দুর্নীতির পথ বন্ধ করতে হবে।
আমি মনে করি, দৃশ্যমান অবকাঠামো নামেমাত্র। একেবারে গোড়ায় হাত দিতে হবে। বাজেটে অর্থ বরাদ্দ বাড়ানোর বিষয়টি এখন সামনে আসছে। এক্ষেত্রে প্রকল্প, স্বাস্থ্য অবকাঠামো, নিয়োগ প্রক্রিয়া, কেনাকাটা, প্রশিক্ষণসহ সব দিকেই কঠোর নজরদারি থাকতে হবে। এটা নিশ্চিত হওয়ার পরই বড় ধরনের অর্থ ছাড় দিতে হবে।
ক্রয় খাতের আইন না মানার অর্থ হচ্ছে অনিয়ম ও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়া। প্রাক্কলন বর্ধিত করলে নিয়ন্ত্রণও দরকার। অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে যারা জড়িত তারাই যেন অনিয়ম না করে সেদিকে নজর দিতে হবে। কারণ আমরা দেখতে পাচ্ছি অবকাঠামো নামেমাত্র। সে কারণে গোড়ায় হাত দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। এর জন্য অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও জোরদার করতে হবে।
প্রশিক্ষণ হল না, অথচ কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়। এ ধরনের দুর্নীতি বন্ধ করে প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। প্রশাসনিক পর্যায়ে যারা দুর্নীতিতে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। কাদের প্রশ্রয়ে তারা অনিয়মের সুযোগ পাচ্ছে তাও খুঁজে দেখে তা বন্ধ করতে হবে। সুবিধাভোগীদের প্রতিরোধ করা না গেলে সব মুখের বুলি হয়ে থাকবে।
এখন স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের বাইরেও বিদেশি অর্থায়ন হবে। আগের তুলনায় অনেক বেশি অর্থ খরচ হবে। বিশ্বব্যাংক, আইডিবিসহ অনেক সংস্থা দেশে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তারা একটা স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করে দেয়। সেটা মানতে হবে। একই সঙ্গে প্রতিটি প্রকল্পের মধ্যে শুদ্ধাচার আনতে হবে। যারা অর্থায়ন করছে তারাই পর্যবেক্ষণ করবে। সতর্ক করবে। সরকারকে বলবে। তাদের অর্থায়নে প্রকল্পও তারা নিজেরা অডিট করে।
দেশের বিরাজমান স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি দমনে দুদক কী করছে সেটিও দেখার বিষয়। আমরা সব সময় মনে করি, দুদকের যতটুকু ক্ষমতা আছে দুদক তাও প্রয়োগ করতে পারে না। সরকার মনে করছে এটি তাদের অন্য প্রতিষ্ঠানের মতো একটি প্রতিষ্ঠান। দুদকও মনে করছে তারা সরকারি চাকরি করছে। ফলে নাম দেখলে তাদের চিন্তা করতে হয়। তদন্ত হবে কী হবে না। তারা নাম দেখলে এটাও মনে করে, হাত দেয়া যাবে না। আমি মনে করি, দুদকের এ মনোভাবের পরিবর্তন দরকার। এছাড়া সুষ্ঠু স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার জন্য একটি মনিটরিং বডিও থাকতে পারে। আইএমইডি তাদের প্রকল্প মনিটরিং করে। হংকংয়েও এ ধরনের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। সরকার সিভিল সোসাইটির পরামর্শ নেয়।
দক্ষ তদারকি ব্যবস্থা নিশ্চিত না হলে কাজ হবে না-অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুব: স্বাস্থ্য খাতের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যাপক সংস্কার দরকার। আমরা কীভাবে সেবা নিশ্চিত করতে চাই, তা আগে ঠিক করে সেভাবে প্রয়োজনে আইনকানুন বানাতে হবে। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। চাহিদা না থাকলেও মন্ত্রণালয় থেকে কেনাকাটার বিষয়ে চাপিয়ে দেয়ার সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। স্বাস্থ্য অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য দরকার দক্ষ জনবল। উদাহরণ দিলে বিষয়টি এমন দাঁড়ায়Ñ ভেন্টিলেটর পরিচালনার লোক নেই। প্রশিক্ষণ নেই। সেই ভেন্টিলেটর কিনে টাকা গচ্চা। টাকা বরাদ্দ করার আগে এ দিকটাও ভাবতে হবে।
বর্তমান সিস্টেমে কেন্দ্রীভ‚ত ব্যবস্থাপনাকে ডিসেন্ট্রালাইজড করতে হবে। এর জন্য কীভাবে কাজটি করা হবে তার বিচার বিশ্লেষণ দরকার। দক্ষ তদারকিও বিশেষভাবে দরকার। তা না হলে কোনো কাজ হবে না; যা আছে তার চেয়ে অবনতিই হবে।
আমি মনে করি, সিস্টেমের কারণেই দুর্নীতি হচ্ছে। সিস্টেম ঠিক করেন। হাসপাতালের জন্য যে মেশিন বা যন্ত্রপাতি কেনা হল এর জবাবদিহি দরকার। প্রতিটা জায়গায় সুষ্ঠু ও দুর্নীতিমুক্ত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা না গেলে স্বাস্থ্যসেবার যে দুরবস্থা যেখানেই থেকে যাবে। তাই এখন বিশেষ দরকার দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।
গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে জনস্বাস্থ্যের চোখ দিয়ে দেখতে হবে-প্রফেসর ডা. মুশতাক আহমেদ: আমি মনে করি, বিশেষভাবে নজর দেয়া দরকার স্বাস্থ্য কাঠামোর দিকে। এলাকাভিত্তিক স্বাস্থ্যকর্মী ও কর্মকর্তা নিয়োগে মনোযোগ দিতে হবে। জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মী থাকলেও শহরে নেই।
জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা যেমন- আইইডিসিআর বা আইপিএস’র মতো অনেক প্রতিষ্ঠান বিদেশি অর্থের ওপর নির্ভরশীল। এখানে সরকারি বাজেটের বরাদ্দ আসা দরকার। জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়ে কেন আমরা অন্যের ওপর নির্ভরশীল থাকব।
কমিউনিটি ভলেন্টিয়ার বা স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য বাজেট রাখতে হবে। তাদের দিয়ে সচেতনতার সব ধরনের কাজ করানো সম্ভব। তারা স্কুলে বা বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্য আচরণ শেখায়। করোনাসহ যে কোনো সংক্রমণ ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এখন শহরেও জনস্বাস্থ্য অবকাঠামো নিশ্চিত করার সময় এসেছে।
ঢাকা শহরে কমিউনিটি হেলথ কাঠামো বাড়ানো দরকার। কারণ মানুষ হাসপাতালে গিয়ে সেবা পাচ্ছে না। রোগী ফেরত আসছে। মানুষ ভয়ে আতঙ্কে থাকে। তাদের মনোবল বৃদ্ধিসহ স্বাস্থ্য পরিষেবা নিশ্চিত করতে হবে; যাতে একজন সাধারণ উপসর্গের রোগীকে হাসপাতালে যেতে না হয়। স্বাস্থ্যকর্মীরা ঘরে ঘরে গিয়ে খবর নেবেন বা তাদের কল করা হলে ছুটে যাবেন। বাসার রোগীর সতর্কতামূলক সব বিষয়ে তিনি কাজ করবেন। জেলা পর্যায়ে এই স্বাস্থ্য কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ থাকে সিভিল সার্জনের ওপর। আর উপজেলা পর্যায়ে ইউএসএফপি’র ওপর। ঢাকা জেলায় সিভিল সার্জন কাজটি করেন। রাজধানীসহ দেশের সব সিটি কর্পোরেশনের জন্য নতুন একজন সিভিল সার্জন বা একজন পরিচালকের পদ সৃষ্টি করা দরকার। একই সঙ্গে শহরে ওয়ার্ডভিত্তিক একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ থাকবেন।
