Logo
Logo
×

জাতীয়

‘মিডিয়া সার্ভের নিউজ পোর্টাল র‌্যাংকিং ভুয়া’

Icon

কাদরুদ্দিন শিশির

প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২৩, ০৫:৩৯ পিএম

‘মিডিয়া সার্ভের নিউজ পোর্টাল র‌্যাংকিং ভুয়া’

গত কয়েকদিনে বাংলাদেশের কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের অনলাইন সেকশনের দায়িত্বে থাকা কয়েকজন ব্যক্তির ফেসবুক পোস্টে দেখলাম একটি ওয়েবসাইট নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করতে। আবার বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে দেখেছি সেই একই ওয়েবসাইট নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতেও।

ওয়েবসাইটটির নাম mediasurvey.org; যাদের একই নামের একটি ফেসবুক পেইজও আছে।

উষ্মা এবং উচ্ছ্বাস হচ্ছে এই ওয়েবসাইটের কয়েকটি প্রতিবেদন নিয়ে। কিছু দিন পরপর ওয়েবসাইটটি ‘টিভি মিডিয়া নিউজ পোর্টাল র‌্যাংকিং’, ‘নিউজ পোর্টাল র‌্যাংকিং’, ‘মাসের শীর্ষ ইউটিউব চ্যানেল: ডিসেম্বর ২০২২’ ইত্যাদি নানান শিরোনামে একটি করে রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে।

এসব রিপোর্টে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশি বিভিন্ন ওয়েবসাইটের অনলাইন র‌্যাংকিং (পাঠক সংখ্যার দিক থেকে) তুলে ধরা হয়।

কারো ওয়েবসাইট কোন র‌্যাকিংয়ে ভালো করলে তারা খুশি হন, আবার খারাপ করলে অখুশি হন! গত কয়েকদিনেও এমন খুশি-অখুশিমূলক পোস্ট করেছেন কেউ কেউ।

এই হচ্ছে ঘটনা।

তো, দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের প্রতিক্রিয়া দেখে ওয়েবসাইটটি সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হওয়ায় একটু ঘেঁটে দেখার চেষ্টা করলাম—এটি কী কাজ করে, কীভাবে করে এবং এটি কারা পরিচালনা করেন?

ওয়েবসাইটটির সর্বশেষ কয়েকটি রিপোর্ট পড়লাম। বুঝতে পারলাম, তারা অনলাইন ট্রাফিক এনালাইসিস কোম্পানি সিমিলার ওয়েবের র‌্যাংকিংকে নানান ভাগে ভাগ করে একেকটা আলাদা রিপোর্ট তৈরি করে 'জরিপ' এবং 'অ্যানালাইসিস' ইত্যাদি শব্দ যুক্ত করে প্রকাশ করে থাকেন।

যদিও আমি উনাদের রিপোর্টগুলোতে তাদের নিজস্ব 'জরিপ' বা 'অ্যানালাইসিস' এর তেমন কোনো ছাপ পাইনি।

সিমিলার ওয়েব বাংলাদেশের বিভিন্ন ডোমেইন, ইউটিউব চ্যানেল, ফেসবুক পেইজ ইত্যাদিকে ক্লিক, ভিউ, সাবসক্রাইবার, ফলোয়ার, এনগেইজমেন্ট, রিচ ইত্যাদি নানান মেট্রিক্সে ভাগ করে কয়েক ধরনের র্যাং কিং ডাটা তাদের ওয়েবসাইট প্রতিনিয়ত আপডেট করে থাকে।

mediasurvey.org সেই ডাটাকে নতুন কিছু ক্যাটাগরিতে (যেমন টিভি চ্যানেলের ডোমেইন, অনলাইন পোর্টালের ডোমেইন, পত্রিকার ডোমেইন অথবা টিভির ইউটিউব চ্যানেল, রান্না সংক্রান্ত ইউটিউব চ্যানেল, ট্রাভেল সংক্রান্ত ইউটিউব চ্যানেল ইত্যাদি) ভাগ করে সিমিলার ওয়েবের ডাটাকেই ক্যাটাগরি-ওয়াইজ সাজিয়ে উপস্থাপন করে।

এটা রিপোর্টিং। সংবাদমাধ্যমগুলো যেমন করে থাকে। সিমিলার ওয়েবের এই ডাটা নিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলোও চাইলে নিজেরা তাদের ওয়েবসাইটে নানান অ্যাঙ্গেলে সেটাকে উপস্থাপন করে রিপোর্ট করতে পারে।

আমি যতটুকু বুঝলাম, mediasurveyএর উপস্থাপিত ডাটা তাদের নিজস্ব কোনো জরিপে প্রাপ্ত ফল নয়, ফলে এই ডাটার সঠিকতা/অসঠিকতার দায়ও তাদের নয়। এসব ডাটা সিমিলার ওয়েব তাদের নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করেছে। এটির দায়ও পুরোপুরি সিমিলার ওয়েবের।

কিন্তু মিডিয়া সার্ভে তাদের রিপোর্টগুলোতে স্পষ্ট করে তা উল্লেখ করেনি।

মনে রাখা দরকার, এই ধরনের ট্রাফিক এনালাইসিস কোম্পানিগুলো কোনো ধরনের বাইবেল নয়। 

আর মিডিয়া সার্ভে ওয়েবসাইটটির মজার দিক হলো, এটি একটি 'ভুয়া ওয়েবসাইট' এর প্রায় সব ক্রাইটেরিয়াই ফুলফিল করে!

ওয়েবসাইটে about-us নামে একটি ট্যাব আছে যেখানে তাদের কোন পরিচয় নেই। আছে ল্যাতিন ভাষায় কিছু টেক্সট যার সাথে মিডিয়া/সার্ভে ইত্যাদি বিষয়ের কোন সংযোগ নেই। এই টেক্সট গুগলে সার্চ করলে বহু ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়; যা থেকে ধারণা যায় ওয়েবসাইট ডিজাইনাররা টেক্সটি কোন ওয়েবসাইট তৈরির সময় 'স্যাম্পল টেক্সট' হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন।

https://archive.ph/PPatK

এই সেকশনে 'Our Team' বলে যাদের নাম ও ছবি দেয়া আছে সেগুলোও বিভিন্ন ওয়েবসাইট ডিজাইনাররা 'সেম্পল' হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। ছবিগুলো মডেলদের। ভিয়েতনামিজ এই ওয়েবসাইটটিতেও তাদের 'এবাউট আস'-এ একই মডেলদের নাম ও ছবি ব্যবহার করা হয়েছে।

https://vulambach.com/about-us/

mediasurve.org-এর Contact ট্যাবটিতেও ভুয়া তথ্য দেওয়া। মূলত এখানেও ওয়েবসাইট পরিচালনাকারীদের প্রকৃত নাম/ঠিকানা/যোগাযোগের উপায় না দিয়ে দেয়া হয়েছে "Email Address: info@example.comexample@yourmail.com; Location: 4462 Settlers Lane, New York, NY 10007; Phone: 123-456-7890+981 547 82 12"-- যা মূলত আরেকটি 'সেম্পল টেক্সট'।

https://archive.ph/TNNMH

এই ওয়েবসাইটটির কন্টাক্ট সেকশনেও একই টেক্সট রয়েছে: https://alumnismoothie.com/contacts/

ওয়েবসাইটের প্রাইভেসি পলিসিটিও অন্য ওয়েবসাইটের নাম সহকারে (!) কপি করা হয়েছে এই ওয়েবসাইট থেকে: https://ancorathemes.com/privacy-policy/

যে ওয়েবসাইটের স্লোগান হচ্ছে ''All Media Survey in Single Platform'' এবং যারা একটি দেশের সংবাদমাধ্যমের নানান দিক নিয়ে 'জরিপ' এবং 'অ্যানালিসিস' প্রকাশ করতে চান তাদের ওয়েবসাইটের পরিচালনার সঙ্গে জড়িতদের নাম-পরিচয়, যোগাযোগ, উদ্দেশ্য, অর্থায়ন এবং তাদের কার্যক্রম সংক্রান্ত অন্য যাবতীয় তথ্য যার মধ্যে কাজের পদ্ধতিও (মেথডোলোজি) রয়েছে-- এসব প্রকাশের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা না থাকলে সেই ওয়েবসাইটকে 'ভুয়া ওয়েবসাইট' হিসেবে গণ্য করাই শ্রেয়।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ওয়েবসাইটে এটির পরিচালনার সঙ্গে জড়িত কারো কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন ইন্টারেকশন থেকে পাওয়া তথ্যে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, ওয়েবসাইটটি পরিচালনা করেন যিনি তিনি একটি টিভি চ্যানেলের ব্রডকাস্ট ও আইটি বিভাগের প্রধান।

তাদের ফেসবুক পেইজের ট্রান্সপারেন্সিও বলছে, পেইজটির একমাত্র এডমিন বাংলাদেশে অবস্থান করেন।

যে কেউ এমন ধরনের মিডিয়া ওয়াচ বা গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতেই পারেন। এতে কোন সমস্যা নেই। সমস্যা হচ্ছে, পরিচালনার সঙ্গে জড়িতদের পরিচয় এবং তাদের কর্মপদ্ধতি পাঠকের কাছে প্রকাশ্য না থাকলে এর পেছনে কোনো স্বার্থের সংঘাত (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) আছে কিনা তা বুঝার উপায় থাকে না।

প্রতিষ্ঠানের কারো ব্যক্তিগত/পেশাগত অবস্থানের কারণে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট এর শঙ্কা থাকলে সেটি কীভাবে সমাধা করা হয় সেটিও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করার বাধ্যবাকতা রয়েছে। এসব অস্বচ্ছতা দূর করতে না পারলে এ ধরনের কাজ বিভ্রান্তি তৈরি করে যা প্রকৃতপক্ষে সাংবাদিকতার জন্যই ক্ষতি বয়ে আনবে।

লেখক: কাদরুদ্দিন শিশির, এএফপির বাংলাদেশ ফ্যাক্ট চেক এডিটর। লেখাটি তার ফেসবুক পোস্ট থেকে সংগৃহীত। 

র‌্যাংকিং মিডিয়া সার্ভে

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম