Logo
Logo
×

জাতীয়

গণপিটুনির বিষয়ে সংবিধান ও আইনে কী বলা আছে?

Icon

যুগান্তর ডেস্ক

প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:৪৮ পিএম

গণপিটুনির বিষয়ে সংবিধান ও আইনে কী বলা আছে?

ছবি : সংগৃহীত

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বেশ কয়েকটি গণপিটুনির ঘটনা জনমনে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। এসব ঘটনার মধ্যে কখনও বিগত সরকারের কর্মী-সমর্থক সন্দেহে কখনো বা ধর্ম অবমাননার অভিযোগে আবার কখনো চুরির সন্দেহে এসব গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে যেখানে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।

মানবাধিকার কর্মীদের দাবি, পুলিশের দুর্বলতা এবং তদন্তে ঘাটতির কারণে এসব গণপিটুনি থামানো যাচ্ছে না। অন্যদিকে, পুলিশ প্রতিটি ঘটনা গুরুত্বসহ নিয়ে বিচারের আওতায় আনার আশ্বাস দিয়েছে।

কাউকে কেবল সন্দেহের বশে অপরাধী বলে তাৎক্ষণিক জনমত তৈরি করা এবং পরে গণপিটুনি দিয়ে হতাহত করা বাংলাদেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়।

সর্বশেষ বুধবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল নামে এক ব্যক্তিকে গণপিটুনি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদকে গণপিটুনির ঘটনা নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। 

এর আগে ৭ সেপ্টেম্বর রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আব্দুল্লাহ আল মাসুদ গণপিটুনিতে নিহত হন। এর বাইরে দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক গণপিটুনির ঘটনায় হতাহত হওয়ার খবর প্রকাশ হয়েছে।

বেশিরভাগ ঘটনায় মামলা হলেও আলোচনায় না আসলে পুলিশের তেমন তৎপরতা থাকে না। সেই মামলার তদন্ত বিচার ঝুলে থাকে বছরের পর বছর।

২০১৯ সালের ২০ জুলাই সকালে বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে তাসলিমা বেগম রেণু নামে এক নারীকে গণপিটুনি দেয়ার ঘটনা বেশ আলোচিত হলেও এখন পর্যন্ত ওই হত্যা মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। সংবিধানে মানবাধিকার নিশ্চিত করা হলেও দেশের প্রচলিত আইন ও তদন্ত ব্যবস্থায় গণপিটুনিতে শাস্তি নিশ্চিত করা বেশ কঠিন।

এ কারণে গণপিটুনিতে অংশ নেওয়ার অপরাধে বাংলাদেশে কারো দণ্ড হওয়ার নজির বাংলাদেশের আদালতে বিরল বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মীরা।

গণপিটুনি নিয়ে সংবিধান ও আইনে কী বলা আছে?

বাংলাদেশে সংবিধানে, অপরাধী-নিরপরাধী নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিককে আইনের আওতাও বিচার লাভ এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের সকল নাগরিক আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।

অনুচ্ছেদ ৩১ বলছে আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনামে বা সম্পত্তির হানি ঘটে। অনুচ্ছেদ ৩৩ অনুযায়ী একজন ব্যক্তির অবশ্যই তার মনোনীত আইনজীবীর সাথে পরামর্শ এবং নিজেকে সমর্থন করার অধিকার রয়েছে।

অনুচ্ছেদ ৩৫ অনুযায়ী অর্থাৎ, আইনের দৃষ্টিতে অপরাধী প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না এবং অপরাধের জন্য যতটুকু শাস্তি প্রাপ্য তার চেয়ে বেশি বা ভিন্ন কোনো শাস্তি দেয়া যাবে না।

এছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৯ ধারা অনুযায়ী, অপরাধী ধরা পড়লে তাকে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করতেই হবে। এর ব্যতিক্রম করলে দণ্ডবিধির ১৮৭ ধারা অনুযায়ী অনূর্ধ্ব ছয় মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ৫০০ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।

আটক রাখার পর যদি ওই ব্যক্তিকে যদি সামান্য আঘাতও করা হয় তাহলে ৩১৯ ধারায় উল্লিখিত আঘাতের অপরাধে অপরাধীকে ৩২৩ ধারার অধীনে এক বছরের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা ১০০০ টাকা জরিমানা করা যাবে। যদি পিটুনি দেয়া হয় তবে কারাদণ্ডে মেয়াদ বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে অনূর্ধ্ব তিন বছর এক মাসে। সেইসাথে অনূর্ধ্ব ৫০০ টাকা জরিমানা দিতে হবে।

যদি ইচ্ছাকৃতভাবে গুরুতর আঘাত দেয়া হয় তবে ৩২৫ ধারার অধীনে সাত বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা যায়। এছাড়া দণ্ডবিধির ৩৩৫ ধারা অনুযায়ী কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড উভয় দণ্ডেও দণ্ডিত হতে পারেন আঘাতকারীরা।

হামলা চালানোর ফলে যদি ব্যক্তির মৃত্যু হয় তাহলে দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারা অনুযায়ী দশ বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডের সাজা দেয়া যায়। আর যদি অপরাধীকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মেরে ফেলার বিষয়টি প্রমাণিত হয় তবে শাস্তি হলো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব দশ বছর মেয়াদের যে কোনো কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড।

গণপিটুনিতে ওই ব্যক্তি নিহত হলে দণ্ডবিধির ৩৪ ধারা অনুযায়ী গণপিটুনিতে অংশ নেওয়া সব ব্যক্তি সমানভাবে এজন্য দায়ী হবে। কেননা আইনে ‘যৌথ দায়িত্বশীলতা’ বলে একটি নীতি আছে। সেখানে বলা হয়েছে, একই অভিপ্রায় নিয়ে একাধিক ব্যক্তি কোনো অপরাধ সংঘটন করলে, তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তি এমনভাবে দায়ী হবেন যেন তিনি নিজেই অপরাধটি করেছেন।

এর মানে গণপিটুনিতে যারাই অংশ নেবেন সেটা আদালতে প্রমাণ করা গেলে সবারই শাস্তি নিশ্চিত করার সুযোগ আছে। এক্ষেত্রে কেউ বড় ধরনের জখম করলেও যে শাস্তি পাবেন, একজন সামান্য ধাক্কা দিলেও একই শাস্তির আওতাভুক্ত হবেন।

এছাড়া গণপিটুনিতে যদি কেউ মারা যায় আর সেটা যদি খুন হিসেবে আদালতে প্রমাণ করা যায় তাহলে দণ্ডবিধি- ১৮৬০ এর ২৯৯ ধারায় উল্লিখিত খুনের অপরাধে অপরাধীকে ৩০২ দ্বারার অধীনে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং জরিমানা দণ্ডেও দণ্ডিত করা যায়।

সে হিসেবে আদালতে গণপিটুনিতে হত্যা প্রমাণিত হলে আইনানুযায়ী সবারই ন্যূনতম দণ্ড হবে ‘যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’।

এদিকে ২০১৯ সালে বাড্ডায় গণপিটুনিতে তাসলিমা বেগম রেণু হত্যার পর আইনজীবী ইশরাত হাসানের দায়ের করা একটি রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে আদালত গণপিটুনি রোধে পাঁচ দফা নির্দেশনা প্রদান করেন।

১. পুলিশের প্রত্যেক সার্কেল অফিসার তার অধীনের প্রতিটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে ছয়মাসে অন্তত একবার গণপিটুনি প্রবণতার বর্তমান অবস্থা নিয়ে বৈঠক করবেন।

২.গণপিটুনির বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার প্রচার কার্যক্রম গণমাধ্যমে প্রচারণা অব্যাহত রাখবে।

৩. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেকোনো ধরনের অডিও, ভিডিও, মেসেজ যা গুজব সৃষ্টি বা গণপিটুনিতে মানুষকে উত্তেজিত করতে পারে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তা বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। যে দুষ্কৃতকারীরা একাজে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

৪. যখনই গণপিটুনির কোনো ঘটনা ঘটবে, কোনো রকম দেরি না করে তখনই থানার ওসি এফআইআর নিতে বাধ্য থাকবেন এবং তা সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপারকে অবহিত করবেন।

৫. গণপিটুনিতে তাসলিমা বেগম হত্যার ঘটনায় ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসার উত্তর বাড্ডা প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের অবহেলার ব্যাপারে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন।

এক্ষেত্রে পঞ্চম দফার নির্দেশনা শুধু তাসলিমা বেগম রেণু হত্যার ঘটনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বাকি চারটি নির্দেশনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তথা পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যার তিনটি প্রতিরোধমূলক এবং একটি প্রতিকারমূলক। এছাড়া আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী গণপিটুনি মানবাধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন।

মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা-১৯৪৮, এর তিন নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে “Everyone has the right to life, liberty and security of person” (প্রত্যেকের জীবন, স্বাধীনতা ও ব্যক্তি নিরাপত্তার অধিকার আছে)। অর্থাৎ একজন মানুষ সুস্থ স্বাভাবিকভাবে তার জীবন যাপনের অধিকার রাখেন।

অনুচ্ছেদ পাঁচ অনুযায়ী – “No one shall be subjected to torture or to cruel, inhuman or degrading treatment or punishment”. অর্থাৎ, কারো প্রতি নির্যাতন, অত্যাচার, নিষ্ঠুরতা, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ করা যাবে না।

নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তি- ১৯৬৬ এর অনুচ্ছেদ ছয় একই বিষয় নিয়ে আলোকপাত করেছে। অনুচ্ছেদ সাতে নির্যাতনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

ইউরোপিয়ান কনভেনশন অন হিউম্যান রাইটসের অনুচ্ছেদ দুই মানুষের জীবনের অধিকার নিয়ে আলোকপাত করেছে, অনুচ্ছেদ তিনে কারো প্রতি নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং অনুচ্ছেদ পাঁচে নিরাপত্তার কথাটি তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া ২৬ অনুচ্ছেদে সবার আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনে গণপিটুনিতে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হলেও দেশের প্রচলিত বিচার কাঠামোয় ও তদন্ত ব্যবস্থায় গণপিটুনিতে শাস্তি নিশ্চিত করা বেশ কঠিন বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মীরা।

এ বিষয়ে নূর খান জানিয়েছেন, আইনের ঘাটতি নেই। সমস্যা হলো আইনের প্রয়োগ করা হয় না এবং তদন্তে দুর্বলতা রয়ে গিয়েছে। সময় মতো আদালতে সাক্ষী হাজির করা যায় না। একারণে গণপিটুনিতে বিচার বিলম্বিত হচ্ছে।

তার মতে, গণপিটুনিতে অংশগ্রহণকারী সবাইকেই চাইলে বিচারের আওতায় আনা যায়। কেননা এতে আশেপাশের মানুষরাই যুক্ত হয়। তবে নানা কারণে সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াটা কঠিন হয়ে পড়ে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

সরকার কী বলছে?

সাম্প্রতিক এসব গণপিটুনির ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম বলেছেন, সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বার্তা হলো মব জাস্টিসের (গণপিটুনি) মতো ঘটনা কোনোভাবে বরদাশত করা হবে না।

তিনি জানান, কেউ অপরাধ করলে আইনানুযায়ী তার বিচার হবে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার সুযোগ নেই।

অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস পূর্তি উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম এসব কথা বলেন, সরকার এ ব্যাপারে যথেষ্ট কঠোর। ইতোমধ্যে অনেক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রয়োজন হলে আরও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

এসব গণপিটুনির ঘটনায় ‘পরিকল্পিত হত্যার’ অভিযোগ এনে মামলা করার কথা জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম।

সাংবাদিকদের তিনি জানান, মামলাসহ সামগ্রিক ঘটনাগুলো কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এছাড়া এসব ঘটনা নিয়ন্ত্রণে ইউনিট প্রধানদের নানামুখী নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান।

এ বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।

বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে গণমাধ্যমকে তিনি জানান, কোনো রকম মব জাস্টিস, আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া, গণপিটুনি, বিচার বহির্ভূত হত্যাকে গ্রহণ করা হবে না। সরকার আইনের মাধ্যমে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করবে।

গণপিটুনি সংবিধান আইন

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম