ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
অন্তর্বর্তী সরকারের ‘এক্সিট’ নিয়ে ভাবার সময় এসেছে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২৫, ১১:৩০ পিএম
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
অন্তর্বর্তী সরকারের ‘এক্সিট’ নিয়ে ভাবার সময় এসেছে, এমন মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ পরবর্তী সরকার কতটা বৈধতা দেবে, তাও চিন্তা করতে হবে। বিশেষ করে যেসব সংস্কারকাজ হাতে নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে পরিপূর্ণ স্বচ্ছতা প্রয়োজন। এখন এক্সিট পলিসি ও অর্জনের স্পষ্ট ঘোষণা দেওয়ার সময় এসেছে।
বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে ‘গণতান্ত্রিক উত্তরণ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ ও সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন : বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক প্রেক্ষিত’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন। ডেমোক্রেসি ডায়াস বাংলাদেশ এই সেমিনারের আয়োজন করে। সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির উপদেষ্টা ও বিএনপি মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেল। বক্তব্য দিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খানসহ বিশিষ্ট নাগরিক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সংগঠনটির চেয়ারম্যান ড. আব্দুল্লাহ-আল-মামুন। বক্তারা সংস্কারের নামে সময়ক্ষেপণ না করার পরামর্শ দেন। সুশাসন, গণতন্ত্র ও নীতিনির্ধারণে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়দায়িত্ব ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করেন।
সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু নয়, আবার প্রয়োজনের কমও নয়, এমন ভারসাম্যপূর্ণ সংস্কার নীতিই গ্রহণযোগ্য। নইলে আমরা আবারও অসংস্কার প্রক্রিয়ায় ফিরে যাব।’
অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, কতখানি সংস্কার করতে পারবেন এবং কতখানি সংস্কার এই সময়ের মধ্যে শেষ করতে পারবেন, সেইটা মনে রাখতে হবে। চলমান প্রক্রিয়া হিসাবে অনেক সংস্কার অসম্পূর্ণ থাকবে, অনেক সংস্কার পরের সরকার করবে। এটা আপনাকে মেনে নিয়ে আগামী দিনে ধারাবাহিকতার ভেতরে থাকতে হবে। এটা না করলে যদি আমি না করি, তাহলে ‘সংস্কার-সংস্কার’ বলে আমি আবার বিভিন্ন অসংস্কারী কাজের ভেতরে যুক্ত হয়ে যেতে পারি। ‘সংস্কারবাদী’ শব্দটা আবার বাজারে ফিরে এসেছে। এক-এগারোর পরে এটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ইদানীংকালে সংস্কারবাদী বললে এখন আর অত খারাপ বলে না। এখন অবশ্য ফ্যাসিবাদী বলে।
তিনি বলেন, আগের তিনটি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল, তাদের প্রত্যেকেরই একটা নিষ্ক্রমণ পথ ছিল। অর্থাৎ ‘এক্সিট পলিসি’ যেটাকে বলে। জিয়াউর রহমান যখন দায়িত্ব নিয়েছেন, তখন ওনার দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। পঞ্চম সংশোধনী বা অন্যান্য বিষয় এগুলোকে বৈধতার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হয়নি। পার্লামেন্ট কাজ করেছে ওনার পক্ষে। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ জাতীয় পার্টি দিয়ে অষ্টম সংশোধনী পর্যন্ত যেসব বিষয় ছিল, এটাকে তিনি বৈধতা দিতে পেরেছেন। এক-এগারোর সরকারের দিকে তাকালে দেখা যায়, যেই সরকারটি এসেছিল, সেই সরকারটি কিন্তু ওই ফখরুদ্দীন আহমদের সরকারের অনুগমনে হয়েছিল। সেহেতু তাদের বৈধতার ক্ষেত্রে খুব বেশি সমস্যা হয়নি। বর্তমান সরকার যে কাজকর্মগুলো করেছে, আগামী সরকার সেগুলোকে সম্পূর্ণভাবে বৈধতা দেবে কি না, এ বিষয় এখনো সামনে রয়ে গেছে।
শুধু নির্বাচিত সরকারেরই সংস্কার করার অধিকার রয়েছে, এমন মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান। তিনি বলেন, ১৯৯১ সালের নির্বাচন দেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো নির্বাচন হয়েছিল। সেই সময়ে তিন মাসের তত্ত্বাবধায়ক সরকার একাধিক সংস্কার কমিশন গঠন করেছিল। তারা রিপোর্ট দিয়েছিলেন; কিন্তু তা নিয়ে দেনদরবার হয়নি। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কোনো আলোচনা হয়নি। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের অত্যাবশ্যক সরকার যা করার দরকার, তারা তা করবে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি দেশের জনগণের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে যায়, তাহলে তা গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক বলেও যোগ করেন তিনি।
মঈন খান বলেন, পিআর পদ্ধতির গভীরে গেলে দেখা যাবে, সত্যিকার অর্থে জনগণ একটি দলকে ভোট দিচ্ছে, একজন ব্যক্তিকে নয়। বাংলাদেশের মানুষ জবাবদিহি করতে চায়, তাদের ধৈর্য অত্যন্ত সীমিত ও আবেগময়। সেখানে পিআর সিস্টেম একটি নৈর্ব্যক্তিক ভোটিং প্রক্রিয়া। এ পদ্ধতি বাংলাদেশের মানুষের চরিত্র, গতিপ্রকৃতির সঙ্গে কখনো খাপ খাবে না। মানুষ জানতে চায়, তাদের প্রত্যাশা পূরণ না করলে নির্বাচন এলাকায় কাকে দায়ী করবে?
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার হলে দেশের আইনশৃঙ্খলাসহ সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে মনে করেন আব্দুল মঈন খান। তিনি বলেন, ‘৫ আগস্ট যদি সত্যিই নির্বাচনের দিন ঘোষণা করা হয়, তবে সেটা যে মাসেই নির্বাচনের সময় দিক না কেন, তা নিয়ে এত ভাবনার কারণ নেই। আমরা দৃঢ় বিশ্বাস করি, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দেশের সমাজ ও সার্বিক পরিস্থিতি নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে চলে আসবে। নৈরাজ্য ক্রমেই কমে যাবে। আসুন আমরা গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষায় নতুন করে যাত্রা শুরু করি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যত বিলম্ব করা হবে, তত সমস্যা দেখা যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন ছাড়া কোনো উপায় নেই। নির্বাচন হলেই যে সব ঠিক হয়ে যাবে, এমনটাও ঠিক নয়। নির্বাচন কোনো পদ্ধতিতে হবে, তাও আমাদের নিশ্চিত হতে হবে। এ মুহূর্তে পিআর পদ্ধতি বাংলাদেশের জন্য কোনো সমাধান নয়। দেশের স্থিতিশীলতা ও অর্থনীতির স্বার্থে বিদ্যমান পদ্ধতিতেই নির্বাচন করতে হবে। অন্যথায় একটি ঝুলন্ত পার্লামেন্ট হবে। সে সুযোগে ভারতীয় আধিপত্যবাদ আমাদের সাবভৌমত্ব হনন করতে পারে।
সরকারি প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, যখনই একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন চারদিকে এক ধরনের উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি হয়। মানুষ কাজে নেমে পড়ে। বিনিয়োগকারী, ভোক্তা এবং যার যা প্রাপ্য, সবার জন্য অর্থের প্রবাহ নিশ্চিত হয়। তাই আমাদের এখন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়া জরুরি। একটা নির্বাচন দরকার, সেটা জনগণের কাছে গ্রহযোগ্য হতে হবে। অনেকে দেশে পিআর পদ্ধতি আছে। তবে এটার খারাপ দিকটা হচ্ছে, অনেকগুলো দল নিয়ে যখন হবে, তখন সরকার দুর্বল থাকে। আগামী ১৫ বছর নির্বাচিত সরকার থাকলে আমাদের অর্থনীতি ভালোর দিকে যাবে।
যুগান্তর সম্পাদক আবদুল হাই শিকদার বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এই সরকার যত তাড়াতাড়ি বিদায় নেবে, ততই মঙ্গল। কারণ, অনেক সময় পার হয়ে গেছে। আমরা এই সরকারের কর্মকাণ্ডে ক্লান্ত হয়ে গেছি। উপদেষ্টাদের মিষ্টি মিষ্টি কথা দিয়ে রাষ্ট্র চলে না, দরকার দক্ষতা। কোমলতার পাশাপাশি রাষ্ট্রের কঠোরতা দরকার। জুলাই আন্দোলনে যারা যুক্ত ছিলেন, যে কারণে আবু সাঈদরা প্রাণ দিয়েছেন, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ১৫/১৬ বছরের যে ত্যাগ-তিতিক্ষা, তার জন্য নিজেদের (রাজনৈতি দলগুলো) ঐক্যবদ্ধভাবে থাকা জরুরি।
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অনেক সময় দেওয়া হয়েছে। এ সরকার আরও বেশি সময় থাকলে অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো থাকবে না। আর সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন নিয়ে সরকারের কথা বলা উচিত না। এর মাধ্যমে সরকার দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকতে চায়।
প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, দেশের জননিরাপত্তা ভঙ্গুর, অর্থনীতি ভঙ্গুর, নির্বাচন অনিশ্চিত। জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর পর এখন জুলাই ঘোষণাপত্র বা সনদ হবে কি হবে না, এ নিয়ে অনিশ্চয়তা, সংশয়, সন্দেহ রয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, গণতন্ত্রের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে নির্বাচন। জনগণকে ক্ষমতা দিতে হবে যে, পরবর্তী ৫ বছর কে শাসনক্ষমতায় থাকবে। রাষ্ট্র কে পরিচালনা করবে, এটা নির্ধারণের দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের। জনগণ চাইলে তাদের সরাতে পারবে। জনগণের কাছে সরকারের জবাবদিহিতা থাকবে। এই সরকারের কোনো জবাবদিহিতা নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান বলেছেন, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিরপেক্ষ নয়। দেশ আরও ভালোভাবে চালানো সম্ভব ছিল, কিন্তু তারা পারেনিÑএটা জনগণও বুঝতে পারছে।
সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপন, প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক হেলেন জেরিন খান, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) ববি হাজ্জাজ, সিনিয়র সাংবাদিক এমএ আজিজ, মঞ্জুরুল আলম পান্না, গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খাঁন, হেফাজতে ইসলামের সহকারী মহাসচিব মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন রাজী, বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতি (বাপি) সভাপতি আব্দুল মুক্তাদির, শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. শাকিল আহমেদ প্রমুখ।
ড. আব্দুল্লাহ-আল-মামুন বলেন, গবেষণায় বিগত ৫০ বছরে বিশ্বজুড়ে ২৬টি দেশে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামগ্রিক পর্যালোচনা করা হয়। এতে বলা হয়, বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক সংকট কিংবা প্রশাসনিক ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের নজির রয়েছে, যা সাময়িকভাবে রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ করে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথ সুগম করে। তবে এই অন্তর্বর্তীকালীন কাঠামো যখন দীর্ঘস্থায়ী হয়ে ওঠে, তখন তা নিজেই একটি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংকটের জন্ম দেয়। দীর্ঘায়িত অন্তর্বর্তী-পর্ব বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিরোধপূর্ণ পরিস্থিতি, আইনি জটিলতা, আর্থসামাজিক অস্থিরতা এবং জনবিচ্ছিন্নতার দিকে জাতিকে ঠেলে দেয়। ২৬টি দেশের মধ্যে ১৬টি দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তুলনামূলক দ্রুত সময়ে নির্বাচন আয়োজন করতে সফল হয়েছে বলে পরিলক্ষিত হয়েছে। এই দেশগুলোতে নির্বাচন আয়োজনের গড় সময়কাল ছিল ১০ মাস তিন সপ্তাহ। অন্য ১০টি দেশে দীর্ঘমেয়াদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিলক্ষিত হয়েছে। যার ফলে দেশগুলোতে চরম রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক অস্থিরতা দৃশ্যমান হয়েছে। কোনো কোনো দেশে গৃহযুদ্ধ, সামরিক অভ্যুত্থান এবং মানবিক বিপর্যয় একত্রে দেখা দিয়েছে।
