দ্য ডিপ্লোম্যাটের নিবন্ধ
যে কৌশলে দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগ টানছে বাংলাদেশ
হিউ সারসোনো
প্রকাশ: ০৭ আগস্ট ২০২৫, ০৬:০২ পিএম
সিউলে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়ার একটি সমঝোতা স্মারক সই, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪। ছবি: ইউএনবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাংলাদেশ এখন আর শুধু শ্রমনির্ভর উৎপাদনের দেশ নয়—বরং ধীরে ধীরে এক কৌশলগত অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়ে উঠছে। দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণের মাধ্যমে বাংলাদেশ নিজের অর্থনীতির ভিত্তি আরও মজবুত করছে।
কৌশলগত পরিকল্পনা, রাজনৈতিক সংস্কার, প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ এবং তরুণ জনশক্তির কারণে দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশকে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগস্থল হিসেবে বিবেচনা করছেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগে আগ্রহ বাড়ছে
বর্তমানে বাংলাদেশে দক্ষিণ কোরিয়ার মোট বিনিয়গের পরিমাণ প্রায় ১.৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এফডিআই-এর উৎস হিসেবে দেশটি এখন বাংলাদেশের তৃতীয় শীর্ষস্থানীয় বিনিয়োগকারী। ২০২৩ সাল থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থান উন্নতির ধারায় রয়েছে, যা প্রমাণ করে—বাংলাদেশ দিন দিন তাদের কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও নতুন সম্ভাবনা
২০২৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতায় দীর্ঘদিনের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন। এরপর নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়। প্রথমে এই পরিবর্তন কিছুটা বিনিয়োগ অনিশ্চয়তা তৈরি করলেও, সরকারের সংস্কারপন্থি মনোভাব ও বিনিয়োগবান্ধব অবস্থান নতুন করে আস্থা তৈরি করেছে।
এরই প্রমাণ ২০২৫ সালের বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট, যেখানে প্রায় ২,৫০০ অংশগ্রহণকারী উপস্থিত ছিলেন।
উৎপাদন থেকে ডিজিটাল খাতে কোরিয়ার অংশীদারিত্ব
দক্ষিণ কোরিয়ান বিনিয়োগ এখন শুধু পোশাক বা গার্মেন্টস খাতে সীমাবদ্ধ নেই। বর্তমানে তারা সেমিকন্ডাক্টর, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, ডিজিটাল ইলেকট্রনিকস ও স্টার্টআপ খাতেও বিনিয়োগ করছে।
২০২৫ সালের এপ্রিলে এলজিসহ কোরিয়ান ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল চট্টগ্রামের কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেড) পরিদর্শন করে। সেখানে ‘ইয়াংগন’ গ্রুপ টেক্সটাইল এবং সোলার এনার্জি প্রকল্পে বিনিয়োগ করে।
এর আগে মার্চে হুন্ডাই বাংলাদেশের ডিএক্স গ্রুপ-এর সঙ্গে যৌথভাবে ইলেকট্রনিক পণ্য বাজারে প্রবেশের ঘোষণা দেয়।
এছাড়া স্যামসাং বাংলাদেশের ফেয়ার গ্রুপ -এর সঙ্গে মোবাইল, টিভি ও এসি উৎপাদনে অংশীদার হয়েছে।
স্টার্টআপ ও প্রযুক্তি খাতে যৌথ উদ্ভাবন
উভয় দেশের সরকারই বাংলাদেশের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমকে এগিয়ে নিতে সক্রিয়।
২০২৩ সালে বাংলাদেশের সিউল দূতাবাসে একটি ভার্চুয়াল ডেস্ক চালু হয়, যার উদ্দেশ্য—তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কোরিয়ান বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা।
এছাড়া, বাংলাদেশের আইসিটি বিভাগ এবং ‘কোরিয়া প্রডাক্টিভিটি সেন্টার’ একটি স্টার্টআপ মেন্টরিং উদ্যোগ চালু করে। এর মাধ্যমে গড়ে উঠেছে একাধিক উদ্যোগ। যেমন-
- ‘এমএফএম কোরিয়া’—একটি কোরিয়ান ফুডটেক স্টার্টআপ, যা বাংলাদেশের নারীদের পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ দিয়ে কাজের সুযোগ তৈরি করেছে।
‘চারদিকে’—একটি বাংলাদেশি প্ল্যাটফর্ম, যেটি কোরিয়ান পণ্য বিপণনে কাজ করছে।
এছাড়া ‘গ্লোবাল ব্রান্ড পিএলসি’ ও কোরিয়ান ‘হাইসুং টিএনএস’ যৌথভাবে ব্যাংকিং অবকাঠামো আধুনিকায়নে কাজ করছে।
সাউথ কোরিয়ান ব্যাংক ‘উরি ব্যাংক’ ইতোমধ্যে বিকাশ এবং ‘ব্যাংক কম্পেয়ার বিডি’-এর সঙ্গেও অংশীদারিত্ব করেছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এবং কোরিয়ার সহায়তা
বাংলাদেশ এখন শুধু পণ্য উৎপাদনের দিকে নয় বরং ডিজিটাল অর্থনীতি গড়ার লক্ষ্যেও এগোচ্ছে। এই লক্ষ্যে দক্ষিণ কোরিয়া হতে পারে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।
এক নজরকাড়া প্রকল্প হচ্ছে চট্টগ্রামের মীরসরাই জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এনএসইসি)—যেটিকে স্মার্ট সিটি হিসেবে গড়ে তুলতে কোরিয়ার সহায়তায় কাজ চলছে।
২০২৮ সালের মধ্যে এটি কোরিয়ার উলসান অথবা চীনের শেনজেন শহরের আদলে রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য শুধু একটি বিনিয়োগ গন্তব্য নয়, বরং একটি কৌশলগত অংশীদার। জনসংখ্যার শক্তি, ভৌগলিক অবস্থান ও ডিজিটাল রূপান্তরের লক্ষ্য—এই তিন শক্তির সমন্বয়ে বাংলাদেশ এখন এশিয়ার ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চলেছে।
দক্ষিণ কোরিয়া ও বাংলাদেশের এই অংশীদারত্ব শুধু বাণিজ্যের সীমায় আটকে নেই—বরং এটি এক আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযাত্রা, যা আগামী দিনগুলোর অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের রূপরেখা দিচ্ছে।
লেখক: প্রযুক্তি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক


