চানখাঁরপুলে ৬ হত্যা মামলায় হত্যাকারীদের মৃত্যুদণ্ড চেয়েছেন শহীদ আনাসের বাবা
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১১ আগস্ট ২০২৫, ১১:২৪ পিএম
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে রাজধানীর চানখাঁরপুলে ৬ জনকে গুলি করে হত্যা মামলায় ট্রাইব্যুনালে প্রথম সাক্ষ্য দিলেন শহীদ আনাসের বাবা শাহরিয়ার খান পলাশ। জবানবন্দিতে তিনি জুলাই আন্দোলনে ছেলে আনাসসহ যারা নিহত ও আহত হয়েছেন, তাদের হত্যাকারীদের মৃত্যুদণ্ড চেয়েছেন। পরে তাকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।
সোমবার (১১ আগস্ট) বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ এই সাক্ষ্যগ্রহণ হয়।
ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। এর আগে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সূচনা বক্তব্য দেন।
সেখানে তিনি বলেন, গণ-অভ্যুত্থানকালে ব্যাপক মাত্রায় এবং পদ্ধতিগত অপরাধের অংশ হিসাবে রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সেখানে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এ মামলার আসামিরা ব্যাপক মাত্রায় এবং পদ্ধতিগত অপরাধের অংশ জেনেও হত্যার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। যারা মনে করেছিলেন বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়ে পার পাওয়া যাবে, কিংবা প্রতিবিপ্লব ঘটিয়ে বিচারকাজকে বানচাল করা যাবে; তাদের জন্য পরিষ্কার বার্তা হলো- যারা অপরাধ করেছেন, তারা কেউ ছাড় পাবেন না। বিচারের প্রক্রিয়া কোনোভাবেই বন্ধ হবে না বলেও জানান তিনি। তার বক্তব্য শেষে গুলি করার ভিডিও ফুটেজ দেখানো হয় ট্রাইব্যুনালে। এ সময় ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় বসে থাকা আসামিদের হাসতে দেখা যায়।
গত বছরের ৫ আগস্ট চানখাঁরপুল এলাকায় শাহরিয়ার খান আনাস, শেখ মাহদি হাসান জুনায়েদ, মো. ইয়াকুব, মো. রাকিব হাওলাদার, মো. ইসমামুল হক ও মানিক মিয়া গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। ওই ঘটনায় করা মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছিল ২৫ মে।
এ মামলায় আটজন আসামি। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ্ আলম মো. আখতারুল ইসলাম এবং রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল পলাতক। আর বাকি আসামি- শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক আরশাদ হোসেন, সাবেক কনস্টেবল সুজন হোসেন, ইমাজ হোসেন ইমাদ ও মো. নাসিরুল ইসলাম গ্রেফতার আছেন। সোমবার তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
আসামিদের মধ্যে হাবিবুর, সুদীপ, আখতারুল, ইমরুল ও আরশাদ এই পাঁচজনের বিরুদ্ধে কমান্ড রেসপনসিবিলিটির (নেতৃত্বের দায়) অভিযোগ আনা হয়েছে। তারা হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা বা অপরাধ সংঘটনের সুযোগ করে দিয়েছেন। আর সুজন, ইমাজ ও নাসিরুলের বিরুদ্ধে সরাসরি গুলি করার অভিযোগ এনেছেন চিফ প্রসিকিউটর।
পরে সাংবাদিকদের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, যেসব তরুণ রক্ত দিয়ে বাংলাদেশকে দ্বিতীয়বার মুক্ত করেছেন, তাদের স্বজন-পরিবার বেঁচে আছেন। তাদের সাক্ষ্যের মাধ্যমেই দেড় হাজারেরও বেশি মানুষের জীবন যাওয়া পরিবারের প্রতি জাস্টিস করার যে চেষ্টা, সেটা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হবে।
প্রথম সাক্ষ্য দিলেন শহীদ আনাসের বাবা: সাক্ষ্য দেওয়ার শুরুতে আনাসের বাবা শাহরিয়ার খান পলাশ আদালতের উদ্দেশে বলেন, ঘাতকদের বসানো হয়েছে কেন? এ সময় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলেন, এটা কোর্টের সিস্টেম। এটা আন্তর্জাতিক আদালত। কোনো আসামি তথ্যপ্রমাণে দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা নির্দোষ হিসাবে ধরে নিই। তাই সে বিষয়ে না বলে আপনি ন্যায়বিচারে সহযোগিতা করেন। যা বলতে এসেছেন, তা বলেন।
পরে শাহরিয়ার খান পলাশ জবানবন্দিতে বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট আমি, আমার স্ত্রী, দুই সন্তান সাফওয়ান (৫) ও সুফিয়ান (২) গেন্ডারিয়ার ভাড়া বাসায় অবস্থান করছিলাম। আমার স্ত্রী আনাসকে ঘরে দেখতে না পেয়ে তার পড়ার টেবিলে যায় এবং সেখানে তার হাতের লেখা একটি চিঠি পায়। চিঠিটা আনাস তার কোচিং ক্লাসের রসায়ন খাতায় রেখে যায়। চিঠিটা একটি ওষুধ কোম্পানির প্যাডে লেখা ছিল। চিঠিটা তার মায়ের উদ্দেশে লিখে যায়। সেখানে লেখা ছিল, ‘মা আমি মিছিলে যাচ্ছি। যদি না ফিরি, তাহলে গর্বিত হইয়ো।’ চিঠিতে আরও কথা লেখা ছিল।
শাহরিয়ার খান পলাশ বলেন, দুপুরে আনাসের মায়ের মোবাইলে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে কল আসে এবং জিজ্ঞাসা করা হয় ‘আপনাদের কেউ কি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচিতে গিয়েছে?’ তখন আমার স্ত্রী বলে, ‘আমার ছেলে আনাস গিয়েছে।’ ওই লোকটি তখন আমার স্ত্রীকে দ্রুত মিটফোর্ড হাসপাতালে যেতে বলেন। আমার স্ত্রী তাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘আমার মোবাইল নম্বর আপনি কীভাবে পেয়েছেন?’ ওই লোকটি বলেন, ‘আপনার ছেলের সঙ্গে থাকা সীমবিহীন মোবাইল থেকে।’ পরে জানতে পারি, ওই লোকটিও আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী একজন ছাত্র। তার নাম সৌরভ আহম্মেদ।
পলাশ বলেন, সংবাদ শুনে আমি, স্ত্রী ও শ্বশুর মিটফোর্ড হাসপাতালে গিয়ে জরুরি বিভাগের সামনে একটি স্ট্রেচারের ওপর রক্তাক্ত অবস্থায় আমার সন্তানের গুলিবিদ্ধ লাশ দেখতে পাই। সেখানে উপস্থিত আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন ছাত্র-জনতার মাধ্যমে জানতে পারি, চানখাঁরপুল মোড়ে নিমতলী নবাব কাটারা গলিতে আমার ছেলে আনাসকে পুলিশ গুলি করে। তারপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জরুরি বিভাগে ভর্তির টিকিট, আনাসের ব্যবহৃত মোবাইল এবং মৃত্যুসনদ নিয়ে আমরা আনাসকে কোলে করে রিকশায় বাসায় নিয়ে আসি। বাসায় নিয়ে আসার পর আনাসের লাশ নিয়ে এলাকার লোকজন স্বৈরাচার খুনি হাসিনার বিরুদ্ধে মিছিল করে।
আনাসের বাবা বলেন, ওইদিন আসরের নামাজের পর গেন্ডারিয়া ধুপখোলা মাঠে আনাসের জানাজার জন্য নিয়ে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি, শেখ মেহেদী হাসান জুনায়েদ (১৪ বছর) নামের আরও একজন ছাত্রের লাশ জানাজার জন্য আনা হয়। সেও ওইদিনই চানখাঁরপুল এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। দুজনের জানাজা একই সঙ্গে হয়। আমরা আনাসকে গোসল করাইনি। শহীদি মর্যাদায় অর্থাৎ গোসল না করিয়ে রক্তাক্ত পরিধেয় পোশাকসহ দাফন করি।
শাহরিয়ার খান পলাশ বলেন, চানখারপুলের ওই ঘটনায় আমার ছেলে আনাসসহ ছয়জন নিহত হয়। পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান, পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, এডিসি আক্তার, এসি ইমরুল, ওসি (অপারেশনস শাহবাগ) আরশাদের পারস্পরিক নির্দেশে ও নেতৃত্বে কনস্টেবল সুজন, কনস্টেবল ইমাজ হোসেন ইমন, কনস্টেবল নাসিরুল ইসলামদের গুলিতে ওই ছয়জন শহীদ হয় মর্মে বিভিন্ন গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের মাধ্যমে জানতে পারি। আমি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যারা আমার ছেলে আনাসসহ অন্যদের নিহত ও আহত করেছে, তাদের বিচার ও ফাঁসি চাই।
