বিবিসি উর্দুর বিশ্লেষণ
ভুট্টো ও মোশাররফ কি ৭১ নিয়ে আসলেই ক্ষমা চেয়েছিলেন?
প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২৫, ০৩:৩৬ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার দাবি করেছেন, একাত্তরের গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়াসহ অমীমাংসিত তিন সমস্যার দুবার সমাধান হয়েছে।
গত রোববার (২৪ আগস্ট) রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে বৈঠকের পর এ মন্তব্য করেন ইসহাক দার।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার ব্যাপারে ইসহাক দারের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, অমীমাংসিত ইস্যু নিয়ে তিনি বলতে চান, ১৯৭৪ সালে প্রথমবারের মতো বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়েছে।
আর ওই সময়ের দলিলটি দুই দেশের জন্য ঐতিহাসিক। এরপর জেনারেল পারভেজ মোশাররফ এখানে (বাংলাদেশে) এসে প্রকাশ্যে ও খোলামনে বিষয়টির সমাধান করেছেন। ফলে বিষয়টির দুবার সমাধান হয়েছে। একবার ১৯৭৪ সালে, আরেকবার ২০০০ সালের শুরুতে।
একাত্তরের বিষয়টি দুবার মীমাংসা হয়েছে বলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশে এর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রতিবাদ হয়েছে।
ইসহাক দারের দাবি, ১৯৭৪ সালে প্রথমবারের মতো বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়েছে। এরপর ২০০০ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ এখানে (বাংলাদেশে) এসে প্রকাশ্যে ও খোলামনে বিষয়টির সমাধান করেছেন।
পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের সফরের কথা উল্লেখ করে ইসহাক দার বলেন, ‘তিনি (পারভেজ মোশাররফ) প্রকৃতপক্ষে নমনীয়ভাবে বিষয়টি তুলে ধরেছেন। আমি মনে করি, পরিবারের মধ্যে বা ভাইদের মধ্যে ঘটলে এসব করা হয়। এমনকি ইসলাম আমাদের বলেছে, “তোমাদের দিল পরিষ্কার করো।”’
জুলফিকার আলী ভুট্টো ও পারভেজ মোশাররফ কি আসলেই ক্ষমা চেয়েছিলেন?
১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনে বিশ্বের সব ইসলামী দেশের প্রধানদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তখনও পাকিস্তান স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে মেনে নেয়নি।
পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবুর রহমানকে ওআইসি সম্মেলনে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানান, এর আগেই বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশের দাবি সত্ত্বেও, তারা ১৯৭১ সালের ঘটনার জন্য তখন ক্ষমা চায়নি।
বাংলাদেশ পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ১৯৫ জন পাকিস্তানির বিচারের হুমকি দেয়। এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের বিনিময়ে, বাংলাদেশ গণহত্যা এবং অবৈধ কর্মকাণ্ডের জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছ থেকে ক্ষমা চাওয়ার দাবি পুনর্ব্যক্ত করে।
অবশেষে, ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
চুক্তিতে পাকিস্তান লিখেছিল যে- ‘যদি পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে, তাহলে পাকিস্তান সরকার এর নিন্দা এবং অনুশোচনা করে।’
চুক্তিতে লেখা ছিল, ‘প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো বাংলাদেশের জনগণের কাছে ভুল ক্ষমা করার, অতীত ভুলে যাওয়ার এবং এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান করছেন।’

এরপর ২০০২ সালে, পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল পারভেজ মোশাররফ বাংলাদেশ সফরে এসে দুঃখ প্রকাশ করেন।
তবে, অবিভক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও কোনো পাকিস্তানি সরকারই বিষয়টির সমাধান করেনি।
এমনকি ১৯৭৪ সালে, বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান, ভুট্টোর সঙ্গে বারবার বিষয়গুলো নিয়ে বৈঠক করেও কোন ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি।
বাংলাদেশ কেন এসব ‘ক্ষমা চাওয়া’কে অপূর্ণাঙ্গ মনে করে?
জুলফিকার আলী ভুট্টো ও পারভেজ মোশাররফের ‘ক্ষমা’ চাওয়া সত্ত্বেও কেন বাংলাদেশ বারবার পাকিস্তানের কাছে ক্ষমা চাওয়ার দাবি করছে?
এই প্রশ্নের উত্তর জানতে, বিবিসি এর আগে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কয়েকজন বিশ্লেষকের সঙ্গে কথা বলেছিল।
বাংলাদেশের ইতিহাসবিদ আফসান চৌধুরী বিবিসিকে বলেন, বাংলাদেশে এটা মনে করা হয় যে চুক্তিটি (ত্রিপক্ষীয়) আসলে পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে ছিল। কারণ তারা সেই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল এবং বাংলাদেশকে চুক্তিতে (অনেকটা অনিচ্ছায়) যোগ দিতে হয়েছিল।
তিনি বলেন, সে সময় নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে এটিকে একটি ‘আপস’ এবং ‘সম্মান বাঁচানোর উপায়’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছিল।এটি বাংলাদেশের জনগণের জন্য সন্তোষজনক নয়।পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেলেও এটি এখনও একটি বড় সমস্যা। সে সময় যে ক্ষমার কথা বলা হয় আমার মনে হয় না সেটি এখন কোনো কাজে আসবে। তখনও কিন্তু এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়েছিল যে- এটি আদৌ কোনো ভুল স্বীকার।
ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের সাবেক হাইকমিশনার আশরাফ কুরেশি এর আগে বিবিসিকে বলেছিলেন, তিনি ঢাকায় কর্মরত থাকাকালীন ১৯৭৪ সালে করা এই চুক্তির কথা উল্লেখ করতেন।
তিনি বলেন, বন্দীদের প্রত্যাবর্তনের প্রেক্ষাপটে ওই আলোচনার সময় চুক্তিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে: ‘প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং বাংলাদেশের জনগণকে অতীতের ভুল ক্ষমা করার জন্য অনুরোধ করেছেন।’
আশরাফ কুরেশির মতে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন এবং লিখেছেন যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও জনগণকে একটি বার্তা দিয়ে বলেছেন- বাংলাদেশের মানুষ ক্ষমা করতে জানে এবং ক্ষমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশ ১৯৫ জন বন্দীকে ফেরত পাঠাবে।
‘১৯৭১ সালের ঘটনার সঙ্গে উভয় দেশের জনগণের কোনও সম্পর্ক নেই’
ইসহাক দারের বাংলাদেশ সফর এবং ১৯৭১ সালের ঘটনার জন্য ক্ষমা চাওয়ার দাবি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়ও চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
তাসিন মেহেদী নামের একজন লিখেছেন- যতক্ষণ না পাকিস্তান ১৯৭১ সালের ঘটনার জন্য স্পষ্টভাবে ক্ষমা না চায়, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশি সরকারেরই তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা উচিত নয়।
১৯৭১ সালের ঘটনার জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ক্ষমা চাওয়ার দাবি সম্পর্কে মুহাম্মদ ইরশাদ নামে একজন লিখেছেন, ‘এটিই একমাত্র বিষয় যা দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে।’

‘অল সিজ’ নামের একজন লিখেছেন- ‘উভয় দেশেরই একে অপরের কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া উচিত’।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ঘটনার সঙ্গে উভয় দেশের জনগণের কোনও সম্পর্ক নেই এবং তারা একে অপরকে পছন্দ করে।
পাকিস্তান সরকারকে পরামর্শ দিয়ে আরেকজন বলেছেন, ‘এখন বাংলাদেশে ভারতপন্থি কোনো সরকার নেই। তাই পাকিস্তানের জন্য এগিয়ে আসার এবং এই সমস্যা সমাধানের এটি একটি ভালো সুযোগ।’
সন্তুষ্ট নয় বাংলাদেশ
বাংলাদেশের কূটনীতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা ইসহাক দারের মন্তব্যের সঙ্গে একমত নন। দ্বিমত পোষণ করেছেন স্বয়ং পররাষ্ট্র উপদেষ্টাও।
তারা বলেন, এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের কোনো সরকার একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চায়নি। ১৯৭৪ সালে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভারতে আটক সব পাকিস্তানি বন্দীকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো একাত্তরের বিপর্যয়ের জন্য সেনা নেতৃত্বকে দায়ী করে ‘তওবা’ করার কথাও বলেছিলেন। গণহত্যায় সেনাবাহিনীর দায় নিরূপণে তিনি হামুদুর রহমান কমিশন গঠন করলেও বোধগম্য কারণে সেটি প্রকাশ করেননি।
নব্বইয়ের দশকে কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে জানা যায়, কেবল পাকিস্তান সেনাবাহিনী নয়, ভুট্টোসহ পাকিস্তানি নেতারাও গণহত্যায় ইন্ধন জুগিয়েছেন।
কূটনৈতিক মহল জানিয়েছে, পাকিস্তানের সঙ্গে যে তিনটি বিষয়ে এখনো অমীমাংসিত আছে তা হলো, একাত্তরের গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা। আটকে পড়া পাকিস্তানিদের পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেওয়া ও একাত্তরপূর্ব সম্পদের হিস্যা আদায়। মাস ছয়েক আগে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিবের সফরের সময়ও বাংলাদেশ একাত্তরের বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরেছে।

