যুগান্তর এক্সপ্লেইনার
‘দুঃখপ্রকাশ’ না ‘ক্ষমা চাওয়া’? বাংলাদেশ সফরে পারভেজ মোশাররফ কী বলেছিলেন
প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২৫, ০৯:৫২ পিএম
২০০২ সালের ২৯ জুলাইয়ে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় তিন দিনের সফরে ঢাকায় আসেন পাকিস্তানের প্রয়াত সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ। ছবি: সংগৃহীত/গেটি ইমেজ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে আবারও উঠে এসেছে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের অমীমাংসিত ইস্যু। পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নে ইসহাক দাবি করেছেন- ‘১৯৭৪ সালে প্রথমবারের মতো বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়েছে। এরপর ২০০০ সালে (আসলে ২০০২) জেনারেল পারভেজ মোশাররফ এখানে এসে প্রকাশ্যে ও খোলামনে বিষয়টির সমাধান করেছেন’।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে ১৯৭৪ সালের চুক্তি কিংবা তৎকালীন পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোর বাংলাদেশ সফর নিয়ে যতটা আলোচনা হয়, পারভেজ মোশাররফের বাংলাদেশ সফর অতটা আলোচনায় আসেনি।

মূলত ২০০০ সালে নয়, বিএনপি নেতৃত্বাধীন তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে ২০০২ সালের জুলাইয়ে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফ।
ঢাকায় মোশাররফের সফরের শুরুর কথা
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের বাংলাদেশ সফরের আগে আওয়ামী লীগ শাসনামলে ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কে তলানিতে পৌঁছে। যদিও ১৯৭৬ সাল থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নত হয় এবং ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে সেটা আরও পরিপক্ব হয়, তবে ১৯৯৬ সালে এসে সেটা আবার খারাপ হয়ে যায়।
২০০০ সালের গোড়ার দিকে এসে দুই কারণে এটি সর্বকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছে যায়। প্রথমত, ওই বছরের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের মিলেনিয়াম সামিটে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সামরিক নেতৃত্বের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল নিয়ে নিন্দা জানান। এছাড়া আন্তর্জাতিকভাবে তা প্রতিরোধে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বানও জানান তিনি। এরপর নিউইয়র্কে শেখ হাসিনার সঙ্গে পূর্ব নির্ধারিত বৈঠকে হাজির হননি পারভেজ মোশাররফ।

কূটনীতিকদের বরাত দিয়ে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনার মন্তব্য জেনারেল মোশাররফকে অসন্তুষ্ট করতে পারে। যদিও জেনারেল মোশাররফ বৈঠকটি পুনঃনির্ধারণ করার চেষ্টা করেন। তবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নিউইয়র্কে ব্যস্ত সময়সূচির কারণে বাংলাদেশ তা প্রত্যাখ্যান করে দেয়।
এরপর ঢাকায় ফিরে শেখ হাসিনা দাবি করেন, পাকিস্তান যেন মুক্তিযুদ্ধের সময় তার সেনাবাহিনীর দ্বারা সংঘটিত নৃশংসতার জন্য ক্ষমা চায় এবং জড়িতদের বিচারের আওতায় আনে।
দ্বিতীয়ত, একই বছরের নভেম্বরে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্যের অভিযোগে ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানি ডেপুটি হাইকমিশনার ইরফানুর রহমান রাজাকে বহিষ্কার করে বাংলাদেশ। শুধু তাই নয়, তিনি মুক্তিযুদ্ধে নিহত মানুষের সংখ্যা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। এতে ঢাকার রাজনৈতিক ও নাগরিক সংগঠনগুলো তাকে বহিষ্কারের দাবি জানায় এবং সরকার পাকিস্তান সরকারের কাছে তীব্র প্রতিবাদ জানায়, এক পর্যায়ে তাকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য করে। সেটি ছিল প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে কোনো বিদেশি কূটনীতিককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার ঘটনা।
পারভেজ মোশাররফের ঢাকা সফর ও জাতীয় স্মৃতিসৌধ পরিদর্শনে ‘দুঃখপ্রকাশ’
২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ধীরে ধীরে সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে শুরু করে। ২০০২ সালে ২৯ জুলাই সস্ত্রীক বাংলাদেশ সফরে আসেন জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। তার ওই সফর ঘিরে ঢাকায় ব্যাপক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। মোশাররফের ঢাকা সফরের আগের সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের এক হলে অভিযানের সময় পুলিশি বর্বরতার অভিযোগে উঠে। এর বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভের ডাক দেন।
ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের খবর ছিল খবরের প্রধান শিরোনাম। এক সপ্তাহ ধরে ছাত্র-পুলিশের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষের পর ৩১ জুলাই শেষপর্যন্ত পদত্যাগ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরী।
জেনারেল মোশাররফের সফরের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বর্তমান নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ধর্মঘটের ডাক দেয়। এমনকি সংগঠনটি দাবি তুলে জেনারেল মোশাররফ ‘একজন সামরিক স্বৈরশাসক যিনি পাকিস্তানে গণতন্ত্রকে পদদলিত করার চেষ্টা করছেন এবং তার স্বৈরাচারী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছেন।’ দেশব্যাপী হরতাল ঘোষণার মাধ্যমে পারভেজ মোশাররফকে বাংলাদেশে ‘অযাচিত’ ও ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ।
এছাড়া টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতা কবির চৌধুরী এবং শাহরিয়ার কবির জনগণকে দেশে মোশাররফের অনুষ্ঠান বয়কট করার আহ্বান জানান।

দ্য ডনের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, প্রেসিডেন্ট মোশাররফের সঙ্গে দেখা করা হবে কিনা তা নিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ভেঙে পড়েছে। ‘অনিবার্য কারণে’ দলটি পাকিস্তানি নেতার সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত বৈঠক বাতিল করেছে। মোশাররফের সফরের সময় আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, জেনারেল পারভেজ মোশাররফের হাই-প্রোফাইল সফরের সময় এ আন্দোলনে সরকারকে ‘যথেষ্ট বিব্রত’ করে ।
এমন ‘উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে’ মোশাররফকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে হাজির হন তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি জমিরউদ্দীন সরকার ও প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা পরবর্তী এটি ছিল কোনো পাকিস্তানি সরকারপ্রধানের চতুর্থ সফর। বিমানবন্দরে বাজানো হয় দুই দেশের জাতীয় সংগীত। বাংলাদেশে এসে ওই দিনই ঢাকার উপকণ্ঠে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ জাতির শ্রেষ্ঠসন্তানদের শ্রদ্ধা জানাতে যান। সেখানে স্মৃতিসৌধের পরিদর্শন বইয়ে মোশাররফ ‘দুঃখপ্রকাশ’ করেন।
পরিদর্শন বইয়ে পারভেজ মোশাররফ লিখেন— ‘আমি ইসলামিক প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের পক্ষ থেকে তাদের বাংলাদেশি ভাইবোনদের জন্য আন্তরিক শুভেচ্ছা এবং শুভকামনা জানাচ্ছি। আমরা এই ভূমি এবং এর জনগণের শান্তি, অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধি কামনা করি।’
একাত্তরকে ‘দুর্ভাগ্যজনক সময়’ এবং পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা সংঘটিত নৃশংসতাকে ‘বাড়াবাড়ি’ বলে অভিহিত করে মোশাররফ বলেন, যা ঘটেছে ‘দুঃখজনক’। একইসঙ্গে বাংলাদেশের কাছ থেকে ‘উদারতার চেতনা’ প্রত্যাশা করেন তিনি।

তিনি আরও লিখেন— ‘পাকিস্তানে আপনার ভাইবোনেরা ১৯৭১ সালের ঘটনার বেদনা ভাগ করে নেয়। সেই দুর্ভাগ্যজনক সময়ে ঘটে যাওয়া বাড়াবাড়িগুলো দুঃখজনক। আসুন উদারতার চেতনা দিয়ে আমরা অতীতকে কবর দেই। ভবিষ্যতের আলো যেন ম্লান না হয়। আসুন আমরা একসঙ্গে এগিয়ে যাই। আমি নিশ্চিত যে আমাদের যৌথ সংকল্পের সাথে আগামী বছরগুলোতে পাকিস্তান-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব আরও সমৃদ্ধ হবে।’
পারভেজ মোশাররফের সফরে স্বাধীনতা পূর্ববতী সম্পদ বণ্ঠনের কথা
পারভেজ মোশাররফের ঢাকা সফর নিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান ৩০ জুলাই এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে স্বাধীনতা পূর্ববতী সম্পদ বণ্ঠন আলোচনায় তোলার কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
বৈঠক শুরুর আগে তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী গার্ডিয়ানকে বলেন— ‘আমরা সবসময় যেকোনো দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে এ বিষয়গুলো তুলে ধরি।’ তবে বৈঠকে আদৌ স্বাধীনতা পূর্ববতী সম্পদ বণ্ঠন ও আটকেপড়া পাকিস্তানিদের প্রসঙ্গ ছিল কিনা তা স্পষ্ট নয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মোশাররফের ঢাকা সফরে স্বাধীনতা পূর্ববতী সম্পদ বণ্ঠনের দাবি রয়েছে বাংলাদেশের। ঢাকা জানায়, পাকিস্তানের কাছে এখনো কমপক্ষে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার সম্পদ রয়েছে, যার মধ্যে যুদ্ধের পরে জব্দ করা পাকিস্তানি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে থাকা অর্থও রয়েছে। ঢাকা চায়— ইসলামাবাদ ক্ষতিপূরণ দেওয়া শুরু করুক।
এছাড়াও ঢাকা চায় প্রায় আড়াই লাখ পাকিস্তানি, যাদের ‘বিহারি’ বলা হয়, যারা পাকিস্তানের নাগরিকত্ব দাবি করে এবং বাংলাদেশে বাস করে, তাদের ফেরত পাঠাতে। তাদের বেশিরভাগই এখনো বাংলার পরিবর্তে পাকিস্তানের ভাষা উর্দুতে কথা বলে। তবে ইসলামাবাদ সবসময় তাদের পাকিস্তানে ফেরাতে অনিচ্ছুক।

গার্ডিয়ানের চোখে এই সফর ছিল— ‘১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের তিন দশক ধরে চলা তিক্ত অভিযোগের অবসান ঘটানোর নতুন প্রচেষ্টা।’
শমসের মবিন চৌধুরী বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, পারভেজ মোশাররফের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় বাণিজ্য ও অর্থনীতির ওপর আলোকপাত করা হবে, তবে বাংলাদেশে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব দাবিকারী আড়াই লাখ রাষ্ট্রহীন মুসলিমের ভাগ্য নিয়েও আলোচনা হবে।
তবে ওই সফরে পূর্ববর্তী সম্পদ বণ্ঠন ও উর্দুভাষী পাকিস্তানি নাগরিকদের প্রত্যাবাসন নিয়ে পাকিস্তানের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ওই বছরের ১৭ আগস্ট ফ্রন্টলাইন ডট দ্য হিন্দুর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশ কয়েকটি বাংলাদেশি দৈনিক পত্রিকা মোশাররফের ‘অনুশোচনা’ এবং ‘দুঃখ’ প্রকাশের জন্য প্রশংসা করে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে এবং তার কথাগুলোকে ‘ভালো চেষ্টা’ কিংবা ‘ভালো শুরু’ হিসেবে বর্ণনা করে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়— কিন্তু অন্যান্য কয়েকটি দৈনিক তাদের সম্পাদকীয় মন্তব্য এবং নিবন্ধে পাকিস্তানি সামরিক শাসকের ক্ষমা চাওয়াকে ‘কসমেটিক’ এবং ‘মানবতার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক অপরাধকে এড়িয়ে যাওয়ার একটি ধূর্ত প্রচেষ্টা’ বলে অভিহিত করে।
একই সফরে দ্বিতীয়বার ‘দুঃখপ্রকাশ’ করেন পারভেজ মোশাররফ
বাংলাদেশসহ বিদেশি গণমাধ্যমের একটি অংশ পারভেজ মোশাররফের দুঃখপ্রকাশকে ‘আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার’ কাছাকাছি বলে প্রচার করে। এমন আবহে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির আয়োজিত ভোজসভায় ১৯৭১ সালের নৃশংসতাকে ‘করুণ’, ‘দুর্ভাগ্যজনক’ ঘটনার আখ্যা দিয়ে ‘অনুশোচনা’ প্রকাশ করেন মোশাররফ।
ভোজসভার বক্তৃতায় তিনি স্মৃতিসৌধের দুঃখপ্রকাশকে আবারও তুলে ধরার সুযোগ নেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানের জনগণ ‘১৯৭১ সালের ঘটনার বেদনা ভাগ করে নেয়’।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে তার ভাষণে পারভেজ মোশাররফ বলেন, ‘আমাদের এমন বন্ধন যা ইতিহাস, ধর্ম, সংস্কৃতি, ৫৪ বছর আগে আমাদের স্বাধীনতার জন্য যৌথ সংগ্রাম এবং ভবিষ্যতের একটি অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে নিমজ্জিত। পাকিস্তানের জনগণ তাদের বাংলাদেশি ভাইদের এবং পাকিস্তান আন্দোলনের অনেক নেতার কাছে ঋণী, যারা পাকিস্তান সৃষ্টির সময় আল্লামা ইকবালের স্বপ্ন এবং কায়েদে আযমের দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য কাজ করেছিলেন। আমরা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার ঘূর্ণিতে ভেঙে পড়া একটি পরিবার ছিলাম। কিছু বেদনাদায়ক স্মৃতি আমাদের ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্কের ওপর ছায়া ফেলে। সত্য এবং প্রজ্ঞার তাদের প্রভাব পুনরুজ্জীবিত হতে সময় লাগে। শান্তি, প্রকৃত শান্তি এবং পুনর্মিলন ফিরে আসতে সময় লাগে’।
পারভেজ মোশাররফ বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের জনগণকে জানাতে চাই ১৯৭১ সালের ঘটনার বেদনা পাকিস্তানের ভাইবোনেরাও সমানভাবে ভাগ করে নেয়। আমি বাংলাদেশের জনগণের কাছে সেই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করতে চাই, যা আমাদের উভয় জাতির ওপর গভীর ক্ষত রেখে গেছে। তবে সময়ের সাথে সাথে ক্ষতগুলো সেরে যায় এবং গত ত্রিশ বছরে আমাদের দুই ভ্রাতৃপ্রতিম জাতির সম্পর্ক অবশ্যই অনেক দূর এগিয়েছে’।
‘আসুন আমরা আমাদের অতীতের দুঃখ এবং তিক্ততা কাটিয়ে উঠি। আসুন আমরা সার্বভৌম সমতা এবং পারস্পরিক-উপকারী সহযোগিতার ভিত্তিতে আমাদের দুই জাতির জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়ে তোলার জন্য এগিয়ে যাই’— যোগ করেন মোশাররফ।

ভোজসভায় নিজের বক্তব্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেন, ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট, ১৯৭১ সালের ঘটনাবলী সম্পর্কে আপনার স্পষ্ট বক্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। এটি নিঃসন্দেহে পুরোনো ক্ষত প্রশমিত করতে সাহায্য করবে।'
পারভেজ মোশাররফের ‘দুঃখপ্রকাশ’ নিয়ে যা বলেছিলেন বিরোধীরা
২০১২ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খারের বাংলাদেশ সফর ঘিরে আবারও একাত্তরের অমীমাংসিত ইস্যু উঠে আসে। ওই বছরের ৯ নভেম্বর পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন জানায়, বাংলাদেশে অবস্থানকালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ দুবার দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন, যা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া স্বাগত জানিয়েছিলেন।
তবে ওই সময়ের বিরোধী দল, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ এটিকে যথেষ্ট মনে করেনি। আওয়ামী লীগের দাবি ছিল, মোশাররফের ‘বিশেষভাবে ক্ষমা’ চাওয়া উচিত। এছাড়া মোশাররফ ‘অস্পষ্ট ভাষায়’ তার দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

প্রতিবেদন অনুযায়ী— তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ দাবি করে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জনগণের ওপর সেনাবাহিনীর দ্বারা সংঘটিত কর্মকাণ্ডের জন্য পাকিস্তানকে বিশেষভাবে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া উচিত।
তারই ধারাবাাহিকতায় ২০১২ সালে হিনা রাব্বানি খারের ছয় ঘণ্টার ঢাকা সফরে একই দাবি তুলে ধরে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ইসলামাবাদ জানায়, বাংলাদেশ সফরে পারভেজ মোশাররফের ক্ষমা চাওয়াই ‘যথেষ্ট’। তাদের যুক্তি, এটি ঢাকায় তৎকালীন সরকার গ্রহণ করেছিল।
আর সেটাই এবারের ঢাকা সফরে আবারও পুনর্ব্যক্ত করে গেলেন পাকিস্তানের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার।
পারভেজ মোশাররফের ‘দুঃখপ্রকাশ’ কতটুকু গ্রহণযোগ্য?
পাকিস্তান কখনো পার্লামেন্টে সর্বদলীয় কোনো প্রস্তাব পাসের মাধ্যমে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চায়নি। জাতিসংঘের কোনো ফোরামে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চায়নি। ঢাকার দাবি আমলে নিয়ে পূর্ববর্তী সম্পদ ফেরত দেয়া ও আটকেপড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসনের সমাধান খুঁজতে কোনো যৌথ টাস্কফোর্স গঠন করেনি।
এছাড়া রাষ্ট্রীয়ভাবে গণহত্যার দায় স্বীকার করে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনার দলিল হিসেবে বাংলাদেশের কাছে কোনো পত্র পাঠায়নি।
পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে বুঝতে হবে, বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম ও জনগণের কাছে ২০০২ সালের এই ‘দুঃখপ্রকাশ’ আদৌ গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে কী না। একাত্তরে গণহত্যার দায়ে ইসলামাবাদ নিঃশর্ত ক্ষমা না চাইলে, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা থেমে থাকবে না। তবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে যতই পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছাকাছি আসতে চেষ্টা করুক না কেন, একাত্তরের অমীমাংসিত ইস্যু তত জোরালভাবে প্রতিধ্বনি হবে।
‘হৃদয় পরিষ্কার’ করার পরামর্শ দিয়ে ইসহাক দার ধর্মের বাণী শোনালেন, অথচ কৃতকর্মের জন্য ভুক্তভোগীর কাছে ক্ষমা চাওয়া তো মহৎ আচরণ। একাত্তরে পাকিস্তানের কৃতকর্ম কোনো সাধারণ অপরাধ ছিল না, যা ঘটেছিল তা নয় মাসব্যাপী একটা জাতির ওপর নৃশংস গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ।
বলতে হয়, বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের সামনে ক্ষমা চাওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপনের সুযোগ হারিয়েছে পাকিস্তান। ‘ঐতিহাসিক’ সফরে এসে সেই উদারতা দেখাতে ব্যর্থ হলেন ইসহাক দার। বাংলাদেশের অর্থ ফেরতের দাবি নিয়ে কোনো জবাবও পাওয়া যাইনি তার কাছ থেকে।
এ প্রশ্ন রয়ে যায়— সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে আলাপে ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নে ইসহাক দার কতটুকু সম্মান দেখিয়েছেন বাংলাদেশকে, এছাড়া স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ের বাংলাদেশের পাওনা ও আটকেপড়া উর্দুভাষী পাকিস্তানিদের ব্যাপারে ইসলামাবাদের অবস্থানই বা আদতে কী?

