কওমিকে আলিয়ার মতো স্বীকৃতি না দিলে তারা পিছিয়েই থাকবে
প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:২৩ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ছোট মাথা থেকে একটা কথা বলব, মাদ্রাসা পড়ুয়াদের প্রতি গত অর্ধশতক ধরে আপনারা যেভাবে বৈষম্য করে এসেছেন, এই নির্বাচনের ফলাফল তারও প্রতিক্রিয়া। দেখুন না, ডাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের যারা জয় পেয়েছেন, এমনকি এছাড়াও আবদুল কাদের ও জামালুদ্দিন খালেদের মতো যারা অংশগ্রহণ করেছেন—তাদেরও একটা বড় অংশ মাদরাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের। এটা কোনো আকস্মিক ঘটনা না, বরং দীর্ঘদিনের দমনের ফল। গত ৫০ বছরে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যে ব্যবহার হয়েছে—সীমিত স্বীকৃতি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না দেওয়া কিংবা মেরিট থাকার পরও পছন্দের সাবজেক্ট না দেওয়া, চাকরির বাধা, সামাজিক উপেক্ষা—তার ফলে তাদের মধ্যে একটা ‘দেখিয়ে দেওয়ার’ মনোভাব কাজ করে আসছে।
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় মাদ্রাসা পড়ুয়াদের ফলাফল লক্ষ করেছেন? সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায়, তারা অনেকের চেয়ে ভালো করছে, দারুন্নাজাতের মতো মাদ্রাসার ছাত্ররা এক–দুই হচ্ছে, কারণ সুযোগ পেলে সেটার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে চেয়েছে তারা। এটা শুধু সংখ্যায় নয়, মানসিকতায়ও প্রমাণিত।
সন্দেহ নাই, আলিয়া মাদ্রাসা পড়ুয়াদের অবদান কওমির তুলনায় অনেক বেশি, কারণ তাদের অংশগ্রহণ বেশি, রেস্ট্রিকশন কম। আলিয়া সরকারি নিয়ন্ত্রিত হলেও এবং তাতে ইসলামি শিক্ষার সঙ্গে বিজ্ঞান, গণিত, ইংরেজির মতো আধুনিক বিষয় মিশিয়ে দেওয়া হলেও তাদের ডিগ্রি সরকারি স্বীকৃত। ফলে তারা সহজে ইউনিভার্সিটির লড়াইয়ে আসতে পারে। কিন্তু কওমি মাদ্রাসার ঘটনা ভিন্ন। তারা ট্র্যাডিশনাল, স্বায়ত্তশাসিত, নামমাত্র সরকারি স্বীকৃতি আছে, যা কোনও কাজের না। এমনকি তাদের সনদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও সত্যায়ন করেত রাজি না। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা বা বিশ্বিবদ্যালয় কেন্দ্রিক লড়াইয়ে তারা নাই। জুলাই আন্দোলেন সারাদেশের ছাত্ররা কোটার বৈষম্যের বিরুদ্ধ লড়লেও কওমিরা কিন্তু শুধু ‘জুলুম’কে বিবেচনায় নিয়ে লড়েছে, কারণ কোটা তো দূরের কথা, কওমিদের জন্য তো সারা দেশে কোনও ভ্যাকেন্সিই নাই।
২০১৮ সালের একটা রিপোর্ট বলছে, মাদ্রাসা গ্র্যাজুয়েটদের ৭৫% চাকরিহীন থাকে, কারণ তাদের শিক্ষা ‘ব্যবহারিক’ চাকরির জন্য মান্য না। এটা ডিসক্রিমিনেশনের স্পষ্ট উদাহরণ—সমাজ আর চাকরির বাজারে কওমি পড়ুয়াদেরকে ‘অপ্রস্তুত’ বলে উপেক্ষা করা হয়, যদিও তারা ধর্মীয় জ্ঞানে অনেক এগিয়ে। যুক্তি সোজা- যদি কওমিকে আলিয়ার মতো স্বীকৃতি দেওয়া না হয়, তাহলে তারা পিছিয়ে থাকবেই। এখন কওমি পড়ুয়াদের ঢাবি কিংবা জাতীয় অন্যান্য পর্যায়ে যেতে আলিয়ার হাত ধরে যেতে হয়—মানে, তারা আলিয়া সার্টিফিকেট নিয়ে আবেদন করে। ফলে তারা স্বাভাবিকভাবে পিছিয়ে পড়ে, আর সমাজে বৈষম্যের চক্র চলতে থাকে।
কেন এই বৈষম্য? ঐতিহাসিকভাবে ১৯৭১ সালের পর থেকে সেক্যুলারিজমের নামে ইসলামী শিক্ষাকে দমন করা হয়েছে, যাতে কওমি আরও আঘাত পেয়েছে। ফলে এই নির্বাচনে মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের অনেকে শিবিরের মাধ্যমে উঠে এসেছে, বাগছাসের মাধ্যমে এসেছে কেউ কেউ, আবার কেউ ছিলেন স্বতন্ত্র, যা প্রমাণ করে যে দমিত গোষ্ঠী সুযোগ পেলে শক্তিশালী হয়। যদি এটা অবহেলা করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আরও বড় প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে।
কওমি পড়ুয়ারাও সুযোগ পেলে সামনে এগিয়ে আসতে পারবে। হাত মুক্ত করে দিলে—মানে, কওমি ডিগ্রিকে সরকারি স্বীকৃতি দিয়ে আধুনিক কারিকুলাম যোগ করে—তাহলে দেশ গঠনে কওমিদের অংশগ্রহণ বাড়বে। তারা ইতিহাসে দেখিয়েছে, ধর্মীয় জ্ঞানের পাশাপাশি সমাজসেবায় তারা অগ্রগামী। এতে এই জাতি আরও সমৃদ্ধ হবে, বৈচিত্র্য বাড়বে, সৌন্দর্য বাড়বে। সত্যিকার অর্থে তখনই ‘কওমি’ (জাতীয়) নামটি সার্থক হবে। এখনই সময়, এই বৈষম্য ভাঙার। না হলে, ডাকসুর মতো সুঘটনা বারবার ঘটবে তা না, দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে।
লেখক: তরুণ আলেম ও অ্যাক্টিভিস্ট

