নবায়নযোগ্য জ্বালানি: চীনের অভিজ্ঞতা ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা
প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৬ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন আজ এক ভয়াবহ সংকটে পরিণত হয়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সব মিলিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থায় টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ ও রূপান্তর এখন সময়ের দাবি।
সম্প্রতি চীনে আয়োজিত Capacity Building Training of South-South Cooperation on Climate Change-এ অংশগ্রহণের সুযোগে আমি প্রত্যক্ষ করেছি কীভাবে চীন দ্রুততম সময়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়িয়ে এক নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করেছে। এই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্যও হতে পারে দিকনির্দেশক।
চীনের অভিজ্ঞতা
চীন আজ নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিশ্বের নেতৃত্ব দিচ্ছে।
সৌরশক্তি: চীনে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সোলার ফার্ম রয়েছে। গ্রামাঞ্চল থেকে শহর পর্যন্ত ঘরবাড়ি, অফিস, শিল্পকারখানায় সৌরশক্তির ব্যবহার এখন সাধারণ বিষয়।
বায়ুশক্তি: উপকূলীয় অঞ্চল ও পার্বত্য এলাকায় বিশাল উইন্ড ফার্ম স্থাপন করে চীন বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে।
হাইড্রো ও বায়োগ্যাস: নদীভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও কৃষিভিত্তিক বায়োগ্যাস প্লান্ট গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে।
গবেষণা ও উদ্ভাবন: বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও শিল্পখাতের মধ্যে সমন্বিত প্রচেষ্টায় তারা নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছে এবং খরচ কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে।
সরকারি সহায়তা: সবচেয়ে বড় বিষয় হলো রাষ্ট্রীয় নীতি ও ভর্তুকি। নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে তারা জাতীয় উন্নয়ন কৌশলের কেন্দ্রে রেখেছে।
চীনের এই উদ্যোগ শুধু তাদের জ্বালানি নিরাপত্তাই নিশ্চিত করেনি, বরং আন্তর্জাতিক বাজারে নবায়নযোগ্য প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ হিসেবেও প্রতিষ্ঠা করেছে।
বাংলাদেশের বাস্তবতা
বাংলাদেশ একটি জলবায়ু-সংবেদনশীল দেশ। বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় অংশ এখনো প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা ও তেল নির্ভর। যদিও গ্রামীণ এলাকায় সৌরবিদ্যুতের (Solar Home System) একটি সফল উদ্যোগ রয়েছে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অবদান এখনো খুব সীমিত।
সৌরশক্তি: গ্রামীণ বিদ্যুতায়নে সৌরশক্তি কার্যকর হলেও বড় মাপের সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প এখনো সীমিত।
বায়ুশক্তি: উপকূলীয় অঞ্চলে বায়ুশক্তি উৎপাদনের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকলেও বিনিয়োগ ও গবেষণা অভাব রয়েছে।
বায়োগ্যাস ও বায়োমাস: কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির কারণে বায়োমাস ও বায়োগ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিশাল সুযোগ রয়েছে, যা এখনো পর্যাপ্তভাবে কাজে লাগানো হয়নি।
নীতি ও পরিকল্পনা: সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি প্রণয়ন করলেও বাস্তবায়নে ধীরগতি রয়েছে।
বাংলাদেশের সম্ভাবনা
চীনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশ তিনটি ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে পারে:
১. বৃহৎ প্রকল্পে বিনিয়োগ
- উপকূলীয় এলাকায় বড় মাপের উইন্ড ফার্ম
- চরাঞ্চল ও অনাবাদি জমিতে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প
- নদীনির্ভর ছোট হাইড্রো প্রকল্প
২. প্রযুক্তি স্থানান্তর ও গবেষণা
- চীনের সঙ্গে যৌথ গবেষণা ও প্রযুক্তি বিনিময়
- বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন
৩. নীতিগত সহায়তা
- বিনিয়োগকারীদের জন্য কর সুবিধা
- গ্রামীণ পর্যায়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ইকো-ফ্রেন্ডলি এনার্জি স্টার্টআপে সহায়তা
- সবুজ অর্থায়ন (Green Finance) প্রণোদনা
চীন দেখিয়েছে, রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছা ও সুপরিকল্পিত কৌশল থাকলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত খুব দ্রুত প্রসার লাভ করতে পারে। বাংলাদেশের জন্য এটি শুধু একটি বিকল্প নয় বরং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা ও টেকসই উন্নয়ন অর্জনের অপরিহার্য পথ। তাই এখনই প্রয়োজন শক্তিশালী রাজনৈতিক অঙ্গীকার, গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ এবং বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করা। নবায়নযোগ্য জ্বালানির সঠিক ব্যবহারই হতে পারে বাংলাদেশের জন্য সবুজ ও টেকসই ভবিষ্যতের চাবিকাঠি।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিজিডি) ও পিএইচডি গবেষক

