Logo
Logo
×

বাতায়ন

ক্লাইমেট গভর্ন্যান্স ও ইকো-ফ্রেন্ডলি স্টার্টআপ: টেকসই উন্নয়নের নতুন ব্লুপ্রিন্ট

সাইদুল ইসলাম

সাইদুল ইসলাম

প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:১০ পিএম

ক্লাইমেট গভর্ন্যান্স ও ইকো-ফ্রেন্ডলি স্টার্টআপ: টেকসই উন্নয়নের নতুন ব্লুপ্রিন্ট

ছবি: সংগৃহীত

একুশ শতকের পৃথিবী আজ জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে অভূতপূর্ব এক সংকটের মুখোমুখি। একদিকে প্রযুক্তি, বাণিজ্য ও নগরায়নের অগ্রগতি আমাদের জীবনযাত্রাকে গতিশীল করেছে; অন্যদিকে, একই অগ্রগতি প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করে তুলেছে।

অতিমাত্রায় কার্বন নিঃসরণ, বন উজাড়, সমুদ্রদূষণ, অতিরিক্ত ভোগবাদ এবং অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়ন পৃথিবীকে ঠেলে দিয়েছে এক ইকোলজিক্যাল বিপর্যয়ের দিকে। প্রতিনিয়ত দেখা দিচ্ছে খরা, বন্যা, সাইক্লোন, নদীভাঙন ও গ্লেসিয়ার গলনের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়।

এই সংকট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক মহলে একটি নতুন ধারণা ক্রমে গুরুত্ব পাচ্ছে- ক্লাইমেট গভর্ন্যান্স, অর্থাৎ জলবায়ু-সংবেদনশীল সুশাসন এবং এর পাশাপাশি তরুণ উদ্যোক্তাদের নেতৃত্বে বিকশিত হচ্ছে ইকো-ফ্রেন্ডলি স্টার্টআপ। দুটি ধারাই মিলেমিশে এখন টেকসই উন্নয়নের এক নতুন রূপরেখা বা ব্লুপ্রিন্ট গড়ে তুলছে।

ক্লাইমেট গভর্ন্যান্স কী এবং কেন জরুরি

ক্লাইমেট গভর্ন্যান্স (Climate Governance) হচ্ছে এমন এক প্রশাসনিক ও নীতিনির্ধারণ কাঠামো, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে নেওয়া হয় অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রযুক্তিগত সিদ্ধান্ত। এর মূল ভিত্তি তিনটি-

ক. অংশগ্রহণমূলক নীতি (Participatory Policy)  জনগণ, নাগরিক সমাজ ও বেসরকারি খাতের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া।

খ. জবাবদিহিমূলক সিদ্ধান্ত (Accountable Decision) নীতি প্রয়োগে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা।

গ. বৈজ্ঞানিক ভিত্তি (Science-Based Policy)  গবেষণা ও প্রমাণভিত্তিক নীতি গ্রহণ করা।

জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতা কেবল পরিবেশগত নয়; এটি অর্থনীতি, সমাজ, কৃষি, স্বাস্থ্য ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সব ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করে। তাই সুশাসন ছাড়া জলবায়ু অভিযোজন ও প্রশমন (adaptation & mitigation) কার্যকর হয় না।

ইকো-ফ্রেন্ডলি স্টার্টআপ: নতুন প্রজন্মের সবুজ বিপ্লব 

বিশ্বজুড়ে তরুণ উদ্যোক্তারা এখন শুধু মুনাফার নয়, মানবিক ও পরিবেশগত মূল্যবোধের দিকেও নজর দিচ্ছেন। এই নতুন প্রজন্মের ব্যবসার মূলমন্ত্র ‘Profit with Purpose’।

ইকো-ফ্রেন্ডলি স্টার্টআপ বলতে বোঝায় এমন উদ্যোগ, যা ব্যবসার পাশাপাশি প্রকৃতিকে রক্ষা করে, কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমায় এবং নবায়নযোগ্য সম্পদ ব্যবহার করে। উদাহরণ হিসেবে দেখা যাক- 

SolarShare (বাংলাদেশ): গ্রামীণ পর্যায়ে সৌরবিদ্যুৎ শেয়ারিং নেটওয়ার্ক তৈরি করে বিদ্যুতের অভাব দূর করছে।

BD Recycle: প্লাস্টিক ও ই-বর্জ্য পুনর্ব্যবহার করে সার্কুলার ইকোনমি তৈরি করছে।

Green Savers: শহরে ছাদবাগান স্থাপন করে তাপমাত্রা কমাচ্ছে ও জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনছে।

AgroShift: ডিজিটাল কৃষি মার্কেট তৈরি করে স্থানীয় উৎপাদকদের টেকসই উপায়ে বাজারে যুক্ত করছে।

এই ধরনের স্টার্টআপ শুধু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডই নয়, সামাজিক পরিবর্তনেরও হাতিয়ার।

যখন নীতি ও উদ্ভাবন হাত মেলায়

জলবায়ু গভর্ন্যান্স ও উদ্যোক্তা উদ্ভাবনের মিলনেই তৈরি হয় প্রকৃত টেকসই উন্নয়ন।

১. নীতিগত সহায়তা ও ইনসেনটিভ

সরকার যদি পরিবেশবান্ধব উদ্যোগের জন্য কর ছাড়, বিশেষ ফান্ড বা লো-ইন্টারেস্ট লোন প্রদান করে। তবে তরুণ উদ্যোক্তারা জলবায়ু-সমাধানভিত্তিক ব্যবসায় প্রবেশে উৎসাহিত হবে। এভাবে নীতি (policy) ও উদ্ভাবন (innovation) মিলিত হয় Green Growth Model-এ।

২. পাবলিক–প্রাইভেট পার্টনারশিপ (PPP)

পরিবেশ প্রকল্পে সরকারি সংস্থা ও স্টার্টআপ একসঙ্গে কাজ করলে ফলাফল হয় বাস্তবসম্মত ও স্থায়ী।

যেমন: বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি বা জল সংরক্ষণ প্রকল্পে এই মডেল অত্যন্ত কার্যকর।

৩. গভর্ন্যান্সে তথ্যপ্রযুক্তির ভূমিকা

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এখন নীতি বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা আনছে। ব্লকচেইন, বিগ ডেটা, ও আইওটি (IoT) প্রযুক্তি ব্যবহার করে জলবায়ু অর্থায়ন ও প্রকল্প মনিটরিং আরও জবাবদিহিমূলক করা সম্ভব।

৪. শিক্ষা ও গবেষণার সংযোগ

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি ক্লাইমেট ইনোভেশন ল্যাব, গ্রিন ইনকিউবেশন সেন্টার ও গবেষণা তহবিল গড়ে তোলে, তবে শিক্ষিত তরুণ সমাজ টেকসই উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ পাবে।

টেকসই উন্নয়ন: শুধুই লক্ষ্য নয়, এক দর্শন

টেকসই উন্নয়ন (Sustainable Development) মানে শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয় বরং এমন এক সমন্বিত উন্নয়ন, যা পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রয়োজন মেটানোর সুযোগ রাখে।

জাতিসংঘের SDGs (Sustainable Development Goals)-এর মধ্যে জলবায়ু পদক্ষেপ (Goal 13), পরিষ্কার জ্বালানি (Goal 7), শিল্প-উদ্ভাবন (Goal 9), ও দায়িত্বশীল ভোগ (Goal 12)—সবগুলোই ইকো-স্টার্টআপ ও ক্লাইমেট গভর্ন্যান্সের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত।

অর্থাৎ, এই দুটি ক্ষেত্র একত্রে কাজ করলে SDGs বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় অবদান রাখতে পারে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সম্ভাবনা

বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ বলা হয়। তবে এখানেই রয়েছে সবচেয়ে বেশি অভিযোজন সাফল্য ও উদ্ভাবনের সম্ভাবনা।

বাংলাদেশের নিজস্ব Climate Change Trust Fund (BCCTF) আছে, যা জলবায়ু অভিযোজনে সরকারি অর্থায়নের অন্যতম বড় উদাহরণ।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাইমেট স্টাডিজ ও এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট বিভাগ চালু হয়েছে।

যুব উদ্যোক্তারা ক্রমে আগ্রহী হচ্ছেন গ্রিন এনার্জি, স্মার্ট কৃষি, ইকো-ট্যুরিজম ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগে।

তবে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে—

১️. আর্থিক প্রণোদনার অভাব।

২️.টেকনিক্যাল স্কিল ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি।

৩️. প্রশাসনিক জটিলতা।

এই গ্যাপগুলো দূর করতে হবে একটি ‘গভর্ন্যান্স-স্টার্টআপ ইন্টিগ্রেটেড মডেল’ তৈরি করে, যেখানে সরকার, ব্যবসা ও নাগরিক সমাজ একসাথে কাজ করবে।

আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্ত

সুইডেন: ক্লাইমেট নীতি ও উদ্যোক্তা উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দিচ্ছে ‘Greentech Innovation Hubs’ তাদের সাফল্যের চাবিকাঠি।

সিঙ্গাপুর: সরকারি নীতিতে কার্বন ট্যাক্স ও সবুজ বিনিয়োগ বাধ্যতামূলক করে টেকসই উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দিচ্ছে।

নেদারল্যান্ডস: সার্কুলার ইকোনমি মডেলকে ব্যবসায়িক উদ্ভাবনের কেন্দ্রবিন্দু করেছে।

এই উদাহরণগুলো প্রমাণ করে যেখানে নীতি ও উদ্ভাবন একসাথে চলে, সেখানে টেকসই উন্নয়ন বাস্তব হয়।

ভবিষ্যতের অর্থনীতি: Green Economy

আগামী দশকে বিশ্ব অর্থনীতি ক্রমেই ‘Green Economy’-তে রূপ নেবে। যে দেশ যত দ্রুত এই রূপান্তর ঘটাতে পারবে, সে-ই অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে থাকবে। Green Jobs হবে ভবিষ্যতের কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস। Carbon Neutral Business Model হবে আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকার শর্ত এবং Climate Smart Innovation হবে বিনিয়োগের মূল লক্ষ্য।

অতএব, আজ যে তরুণ উদ্যোক্তা পরিবেশ-বান্ধব উদ্ভাবনে মন দিচ্ছেন, তিনিই আগামীকালের পরিবর্তনের স্থপতি।

জলবায়ু পরিবর্তন শুধু পরিবেশের নয়, মানব সভ্যতার অস্তিত্বের প্রশ্ন। এখন সময় এসেছে নীতিনির্ধারক, উদ্যোক্তা, গবেষক ও সাধারণ মানুষের একযোগে কাজ করার। ক্লাইমেট গভর্ন্যান্স দেবে নীতিগত দিকনির্দেশনা, আর ইকো-ফ্রেন্ডলি স্টার্টআপ দেবে সেই দিকনির্দেশনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার শক্তি। দুটির সমন্বয়েই তৈরি হবে এক নতুন উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে অগ্রগতি হবে পরিবেশের সঙ্গে সুর মিলিয়ে, যেখানে মুনাফা মানে শুধু টাকা নয়, মানুষের ও পৃথিবীর কল্যাণ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিজিডি) ও পিএইচডি গবেষক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম