Logo
Logo
×

বাতায়ন

ডিপ স্টেট : কী ও কেন

Icon

আমীর খসরু

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ডিপ স্টেট : কী ও কেন

সাম্প্রতিককালে বেশি মাত্রায় ব্যবহৃত হচ্ছে বেশকিছু শব্দ বা শব্দাবলি। যেমন : অলিগার্কি, ডিপ স্টেট। এ সবই রাজনৈতিক শব্দচয়ন। আর এগুলো রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ কথাগুলো খুব সহজ করে বলা হচ্ছে এ কারণে যে, এর সঙ্গে সর্বশ্রেণির মানুষের স্বার্থ, ভাগ্য, তাদের প্রাপ্য, ন্যায়, ন্যায্যতা ও অধিকারের প্রশ্নটি জড়িত।

নির্বাচন সামনে। এখন সমানে শোনা যাবে একটি শব্দমালা ‘এ সরকারটি হবে আপনার’ অথবা ‘জনগণের সরকার গঠিত হবে’-এসব হচ্ছে প্রতিশ্রুতি বা আশ্বাস, যা কোনোদিনই বাস্তবায়িত হবে না, যতক্ষণ না ‘প্রকৃত গণতন্ত্র’ অথবা রাষ্ট্রটি ‘আমি বা আমার’ থেকে বদলে ‘আমাদের’ হবে অথবা রাষ্ট্র-কাঠামোতে ‘মানুষের অধিকার’ নিশ্চিত হবে।

তাহলে প্রশ্ন উঠবেই-রাষ্ট্র কাঠামো কী? সহজ কথায়, যে রাষ্ট্রটি আছে, তা পরিচালনার জন্য যে ব্যবস্থাগুলো বা প্রতিষ্ঠানগুলো আছে তাকে সবাই সরকার বলে জানে। প্রশ্ন হলো-ভোটে যারা নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেন অথবা যে ব্যবস্থায় সরকার রয়েছে, তারা কি তাদের একক বা নিজস্ব সিদ্ধান্তেই সরকার বা রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারেন? জবাব হচ্ছে, ‘না’। রাষ্ট্রকাঠামো বিশেষ করে গণতন্ত্রহীন বা কম মাত্রার অথবা নামমাত্রার কিংবা গণতন্ত্রের নামে অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রে কাঠামোর বাইরেও এমন কিছু শক্তি আছে, যা অদৃশ্য বা দৃশ্যমান নয়। কোন অদৃশ্য শক্তি আসলে রাষ্ট্র চালায় অর্থাৎ জনগণের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের রাষ্ট্রকাঠামোর মূল চালক কে, তা সাধারণ মানুষ বুঝতেই পারে না।

অনেকেই ‘পুতুলনাচ’ দেখেছেন-যত কম মাত্রার গণতন্ত্র থাকবে অথবা সরকারটি যতই জনবিচ্ছিন্ন হবে, ততই ‘পুতুলনাচ’ জমে উঠবে। আমাদের মতো দেশে এ কারণে রাষ্ট্রব্যবস্থার চলমানতা হচ্ছে ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’।

যেসব দেশ উপনিবেশের অধীনে ছিল, তারা দৃশ্যত উপনিবেশিকতামুক্ত হয়েছেন মনে করলেও বাস্তবে ঘটনাটি তেমন নয়। উপনিবেশ-উত্তর শাসনব্যবস্থায় দেখা যায়, সবকিছু অর্থাৎ শাসনব্যবস্থা, কাঠামো, পদ্ধতি, আমলাতন্ত্র, প্রশাসনিক ব্যবস্থাবলি আগের মতোই আছে। শুধু শাসক বদল হয়ে অল্পসংখ্যক অভিজাত বা কুলীন শ্রেণির শাসন কায়েম হয়েছে।

একে রাজনীতি বিজ্ঞানীরা বলেন অভিজাততন্ত্র। আবার শরীরের সবকিছু একই আছে ঠিক আগের মতোই-শুধু ‘মুণ্ডু’ বদল হয়েছে। রাজনীতির পণ্ডিতরা বা বিজ্ঞানীরা এমন রাষ্ট্রকে বলেন, ওভার ডেভেলপড স্টেট। এর একটি খটমট বাংলাও করা হয়েছে-অতি বর্ধিষ্ণু রাষ্ট্রব্যবস্থা। এতসব বুঝে লাভ নেই, অবস্থাটা হচ্ছে-ঔপনিবেশিকতার বিভিন্ন ক্ষেত্রের এবং স্তরের ক্ষতি ও কুপ্রভাবের সম্মিলিত নাম হচ্ছে ওই ‘ওভার ডেভেলপড স্টেট’।

যেসব দেশে বিপ্লবের মাধ্যমে তা হতে পারে বা হয়েও থাকে, সশস্ত্র রক্তস্নাত বিপ্লব করে দেশ ঔপনিবেশিকতার হাত থেকে মুক্তি এনেছে বা পেয়েছে-তাদের কাহিনি ভিন্ন। তারা ওই অভিজাত বা কুলীনতন্ত্র, ওভার ডেভেলপড রাষ্ট্র। আগের আমলাতন্ত্র, প্রশাসনিক ব্যবস্থার সব কুফল থেকে মুক্ত থাকতে পারে।

তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, তাহলে ওই বিষয়গুলো অর্থাৎ ডিপ স্টেট, অলিগার্কি-এসব কথা কেন আসে? এসব পরিভাষা কেন রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যায়?

রাষ্ট্র জনগণ চালায় অর্থাৎ রাষ্ট্র হলো জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা-আব্রাহাম লিংকনের ওই দিন শেষ। এটা এখন ‘সংবিধান’-এর ভাষা। আর যদি ভাগ্যে জোটে তাহলে একটি নির্দিষ্ট সময় শেষে বা অন্তর অন্তর নির্বাচন হয় তার ভাষা। গণতন্ত্রের সংজ্ঞায়ও এখন পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন গণতন্ত্র হচ্ছে-কত বেশি মাত্রায় গণপ্রতিনিধিত্ব বা জন-অংশীদারত্বের বৃদ্ধি ঘটানো সম্ভব। এটাকে বলা হয় প্রকৃত প্রতিনিধিত্বশীল সরকার।

আগেই বলেছি, তাহলে রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে অলিগার্কি বা গোষ্ঠী বা কতিপয়তন্ত্রের সঙ্গে কেন এলো? এ বিষয়টি বোঝানোর জন্যই এতক্ষণ ধরে রাষ্ট্রকাঠামো সম্পর্কে নানা বিষয়ের অবতারণা করা হলো।

রাষ্ট্র যাকে সর্বজন সরকার বলেই মনে করে-তার সঙ্গে নানা বিষয় জড়িয়ে আছে। রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে বা এর ক্ষেত্রে নানা কাণ্ড বা ছোট-বড় শক্তি ও স্বার্থ কেন্দ্রে জন্ম নেয়-এটা স্বয়ংক্রিয়। এ কেন্দ্র যদি রাষ্ট্র অনুমোদিত বা সমর্থনপুষ্ট হয়, তবে তা হচ্ছে ক্ষমতার আনুষ্ঠানিক কেন্দ্র। আর যদি সরকারের বা রাষ্ট্রের অগোচরে হয়, তবে তা হলো ক্ষমতা অনানুষ্ঠানিক কেন্দ্র। শেষোক্ত কেন্দ্র অননুমোদিত। এগুলো এক বা একাধিক হতে পারে। এ কেন্দ্রগুলো সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত বা বিঘ্নিত করে এবং জন্মই নেয় এ কাজটি করার জন্য।

ক্ষমতার অনানুষ্ঠানিক কেন্দ্র যখন বড় আকারে, আরও বেশি সংখ্যককে নিয়ে আরও বৃহৎ উদ্দেশ্যে গঠিত হয়, যার ক্ষমতা রাষ্ট্রব্যবস্থা বা সরকারের ওপর ব্যাপক এবং সর্বগ্রাসী হয়-তাকেই বলা হয় ‘ডিপ স্টেট’। অর্থাৎ রাষ্ট্রের মধ্যে আরেকটি রাষ্ট্র। এ ডিপ স্টেট বা রাষ্ট্রের বা সরকারের গভীরে যে আরেকটি অনানুষ্ঠানিক কাঠামো থাকে, তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প থেকে বাংলাদেশের এনসিপিকে চিল্লাতে হয়-‘রাষ্ট্রের ভেতর আরেকটি রাষ্ট্র’ নিয়ে। ডিপ স্টেট হলো একটি অননুমোদিত, অতি গোপনীয় কেন্দ্র-কার্যক্রম বা নেটওয়ার্ক-যা সরকার এবং রাষ্ট্রকাঠামোর নিজস্ব সিদ্ধান্ত এবং স্বাধীন কার্যক্ষমতা গ্রহণকে অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে রেখে এবং থেকে প্রভাবিত করে। এটা এমন একটি নেটওয়ার্ক, যা দৃশ্যমান নয়। আবার এটি রাষ্ট্রীয় কোনো গোয়েন্দা সংস্থাও নয়। ডিপ স্টেট সরকারের-রাষ্ট্রের মধ্যে থেকে নিজস্ব এজেন্ডা বা উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে। এরা জননির্বাচিত নেতৃত্ব বা ব্যবস্থার বাইরে থেকে কার্যক্রম চালায় সুনির্দিষ্ট স্বার্থে ও ফন্দি-ফিকিরের জন্য। আমাদের মতো দেশে যেখানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তাব্যবস্থা সুসংগঠিত নয়, মোট কথা নিম্নমাত্রার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিদ্যমান, সেখানে ডিপ স্টেট খুবই বিপজ্জনক। এ নেটওয়ার্ক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুদৃঢ়, সহজ-সজীব এবং কার্যকর হোক-তা হতে দিতে চায় না। এরা গণতন্ত্রকে অবজ্ঞা করার সঙ্গে সঙ্গে অগণতান্ত্রিক শাসন কায়েম, দুর্নীতিকে উৎসাহ এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া, বেসামরিক কর্তৃত্বকে অবজ্ঞা ও অস্বীকার, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি এবং এ লক্ষ্যে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজির সৃষ্টিকারী ও উৎসাহদাতা।

ডিপ স্টেটকে একটি অদৃশ্য ও ছায়া সরকারও বলা যায়। সাম্প্রতিককালে রাষ্ট্রক্ষমতায় কে আসবে-কারা তাদের বন্ধু মনোভাবাপন্ন, এসবও গোপন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নির্ধারণের চেষ্টা চালানো ডিপ স্টেটের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। বিশেষ করে ডিপ স্টেট রাষ্ট্রের প্রশাসনিকব্যবস্থা বা সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। আর উপনিবেশ-উত্তর উভয় আমলাতন্ত্র সহজেই তাদের বন্ধু হয়ে যায়। এখানে যে দ্বন্দ্বটিকে সহজে কাজে লাগানো হয়-তা হলো, রাজনৈতিক কর্তৃত্বের-নেতৃত্বের সঙ্গে আমলাতন্ত্রের দ্বন্দ্ব।

রাজনৈতিক নেতৃত্ব দুর্বল হলে ডিপ স্টেট রাষ্ট্রের স্বাধীন নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পর্যন্ত হাত দেয়। তারা তাদের নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতেই এসব করে। বাধা না পেলে তাদের হাত এমন লম্বা ও ভয়াল, ভয়ংকর হয়ে পড়ে, যারা দেশের স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে সক্ষম হতে পারে।

তাহলে এ প্রশ্নটি আসবেই যে, কারা এই ডিপ স্টেট বা রাষ্ট্রের মধ্যে আরেক রাষ্ট্র অথবা গভীর রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর আগে জানা দরকার, কেন এ ব্যবস্থাটির উৎস বা উৎপত্তিস্থল বা এর কারণ কী সে সম্পর্কে।

শব্দের উৎপত্তি তুরস্ক থেকে। তুরস্কে যাকে বলা হয় ক্যালকু বা ডেরিন ডেভেলেট। এ সম্পর্কে দুটি ভাষ্য রয়েছে। এটি বোগোসিয়ান ‘অপারেশন নেমেসিস’-এ বলেন, ১৯১৫-২০-এর দিকে আর্মেনিয়ার গণহত্যার মূল পরিকল্পনাকারীদের অর্থাৎ উসমানীয় এবং আজারবাইজানের কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্টদের গুপ্তহত্যার জন্য আর্মেনিয়ারই বিপ্লবী ফেডারেশন ‘এআরএফ’ যে গোপন পরিকল্পনা করে-তাই পরবর্তীকালে এই ডিপ স্টেটের ধারণা তৈরি করে বা জন্ম দেয়। অন্যটি হচ্ছে-তুরস্কের সামরিক বাহিনী মাদক পাচারকারীদের ব্যবহার করে কুর্দিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার যে গোপন পরিকল্পনা করে। তবে পরেরটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও পশ্চিমা প্রচারণা হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে।

মিসরেও ১৯৫০-এর দিকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য ডিপ স্টেটের কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর থেকে মিসরে ডিপ স্টেটের কার্যক্রম ও নেটওয়ার্ক বেশ কার্যকর এবং এর জন্য ইসরাইল, পশ্চিমা কোনো কোনো দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশকে দায়ী করা হয়। এ দায় যে দায়ীরা এড়াতে পারবেন-তার পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণাদি রয়েছে।

তাহলে এই ডিপ স্টেটের সঙ্গে কারা জড়িত-এ প্রশ্নটি আসবেই। যেহেতু এটি এমন একটি নেটওয়ার্ক, যা গোপন, যার ছায়া আছে-কায়া নেই, লুকানো রাষ্ট্রযন্ত্র কিংবা সরকারের অনানুষ্ঠানিক অনুমোদনহীন-কাজেই তাদের কার্যক্রমে কারা জড়িত, তাও প্রমাণিত নয়। সাধারণত ধরে নেওয়া যায়, সামরিক-বেসরকারি আমলাতন্ত্রের কিছু সদস্য, রাষ্ট্রের যেসব প্রতিষ্ঠান নীতি-কৌশল গ্রহণ করে, সেসবের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, করপোরেট সংস্থা, গোয়েন্দা-প্রতি-গোয়েন্দা (কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স), প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বৃহৎ ব্যবসায়ী, ধনিক এবং অভিজাত শ্রেণিসহ দেশীয় অনেকেই এতে জড়িত। তবে এটি যে শুধু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ এমন নয়। বিদেশি অথবা বিদেশিদের জন্য কাজ করে যথা সাহায্য অথবা দাতা সংস্থা যেমন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি বা এমন সব সংস্থার সুনির্দিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবিশেষও হতে পারে।

বিশেষ করে ডিপ স্টেটের সঙ্গে জাতীয় প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তাব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক নীতি-কৌশল জড়িত থাকায় বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা বা তাদের সঙ্গে অর্থের কিংবা যে কোনো স্বার্থে সম্পৃক্ত ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তারা তাদের স্বার্থ হাসিল করে। বিদেশি বিশেষত প্রতিপক্ষ, বৈরী বা শত্রু মনোভাবাপন্ন দেশ বা দেশগুলোর জন্য তাদের ভূরাজনৈতিক কৌশলগত দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডিপ স্টেটকে প্রভাবিত করা এক নম্বর অগ্রাধিকার হয়। ওই সুনির্দিষ্ট দেশের প্রভাবশালী অর্থাৎ সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে পারে অথবা মতামত উৎপাদন করতে পারে-এমন সব প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, কথিত সুশীলসমাজ, বুদ্ধিজীবীদের তারা যে কোনো উপায় কাজে খাটায়। এটা সংবাদপত্র থেকে নাটক, সিনেমা অর্থাৎ সর্বস্তরে এর বিদ্যমানতা থাকতে পারে। কোনো একটি দেশ নিজ গোয়েন্দা সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান দিয়ে যখন স্বার্থ হাসিল করতে পারে না, তখন সে দ্বিতীয় বা তৃতীয় কোনো দেশ অথবা সংস্থার মাধ্যমে কার্য সম্পাদন করে। ডিপ স্টেট এমন একটি নেটওয়ার্ক বা পদ্ধতি, যা সব সময়ই অনানুষ্ঠানিক কেন্দ্র হিসাবে গোয়েন্দাদের মতো কাজ করে। কাজেই ‘অতি গোপনীয়’ কাজে কে জড়িত আর জড়িত নয়, তা বলা মুশকিল।

রাষ্ট্রযন্ত্র বা সরকারকে কীভাবে অদৃশ্য শক্তি প্রভাবিত করে, সে সম্পর্কে কিছু গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যেমন : ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত ব্রিটিশ সাংবাদিক অ্যান্থনি স্যাম্পসনের সাড়া জাগানো গ্রন্থ দি আর্মস বাজার। আর এ গ্রন্থে দেখানো হয় কীভাবে অস্ত্র উৎপাদন প্রতিষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক অস্ত্র ব্যবসায়িক শ্রেণি গোপনে অস্ত্র বিক্রি করে এবং উপায় হিসাবে রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানদের ‘দাতব্য’ চিকিৎসা বা বিদেশি সাহায্যের আড়ালে অস্ত্র বিক্রির মতো অশুভ কাজটি হয়। ২০০৬ সালে প্রকাশিত হয় আরেকটি বিখ্যাত গ্রন্থ সেলিং সিকনেস : হাউ দি ওয়ার্ল্ডস বিগেস্ট ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিস আর টার্নিং ইউএস অল ইনটু প্যাশেন্টস (অসুস্থতা বিক্রি : বিশ্ব ওষুধশিল্প মোড়লরা কীভাবে সবাইকে রোগী বানায়)। গ্রন্থটির লেখক রে মহিয়ান এবং অ্যালেন ক্যাসলেস। গ্রন্থন্টির মোদ্দা কথা-কীভাবে সুস্থ মানুষকে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র বা সরকারব্যবস্থার নানা পন্থায় অনুমোদন নিয়ে বা বাধ্য করে মানুষকে অসুস্থ বানিয়ে ওষুধ বিক্রি করা হয়। মহামারির বা বৈশ্বিক ছোঁয়াচে রোগের ক্ষেত্রে বিদেশি ও দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো কী করেছে, তাও আমরা দেখেছি।

তৃতীয় বিশ্বের অর্থাৎ গরিব দেশের মানুষের খাদ্য নিয়েও যে নোংরা আন্তর্জাতিক রাজনীতি হয় এবং এর পার্টনার যে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র বা সরকারব্যবস্থার একটি গভীর নিয়ন্ত্রণ গোষ্ঠী, সে বিষয় নিয়েও সাধারণ গবেষণা এবং অনুসন্ধানী তথ্যসমৃদ্ধ একটি গ্রন্থ বেরিয়েছিল ১৯৭৬ সালে : সুসান জর্জের হাউ দি আদার হাফ ডাইজ (অন্য অর্ধেক মানুষ কীভাবে মারা যায়)। সুসান জর্জ গ্রন্থটিতে দেখিয়েছেন, অতিরিক্ত সংখ্যা অথবা খাদ্যের অভাবে তৃতীয় বিশ্বের মানুষ মারা যায় না। সমস্যাটি জলবায়ুও নয়। যে খাদ্য উৎপাদন হয়, তা দিয়ে সব মানুষ খেতে পারে। কিন্তু একটি আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক গোষ্ঠী খাদ্য ও শস্যবাজার বৈশ্বিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তারা কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে। এর সঙ্গেও আমাদের দেশের সরকারের অদৃশ্য নিয়ন্ত্রকরা জড়িত।

একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, ডিপ স্টেটের সঙ্গে তার আন্তর্জাতিক মুরুব্বি বা মাস্টাররা জড়িত ছিল এবং এখন আরও বেশি সক্রিয়। এছাড়া বিশেষ করে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কার্যক্রমের খণ্ডচিত্র বা কাহিনি যেমন ইনসাইড সিআইএ বা মোসাদ ইত্যাদি। অথবা গুপ্তহত্যা, যা এখনো রহস্যাবৃত্ত। যেমন : ১৯৬৩-এর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি, ১৯৮৬-এর সুইডেনের ওলফ পাম, এমনকি ১৯৫১-এর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, ১৯৭৩ সালের চিলির প্রেসিডেন্ট সালজাদর আলেন্দেসহ অসংখ্য বিশ্বখ্যাত নেতার মৃত্যু এখনো রহস্যাবৃত্ত। অনেকেই এখন বলছেন, এসব ঘটনায় বিদেশিদের সঙ্গে ডিপ স্টেটের মতো গভীর নিয়ন্ত্রক বা অ্যাক্টরদের হাত আছে, যে নামেই হোক ওরা আছে।

কাজেই ডিপ স্টেটের হাত অনেক লম্বা-কঠিন-কঠোর এবং সুদূরপ্রসারী। যদিও বামপন্থিরা মনে করে, উপরতলার দ্বন্দ্বে অনেক সময় সত্য বেরিয়ে আসে।

আমীর খসরু : লেখক, গবেষক, সাংবাদিক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম