দৃষ্টিপাত
নতুন প্রেক্ষাপটে বিজয় দিবস
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আজ ১৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের মানুষ নয় মাস যুদ্ধ করে হানাদার বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে কাঙ্ক্ষিত বিজয় অর্জন করেছিল। সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে দখলদার বাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় অর্জন করা যে কোনো জাতির জন্য অত্যন্ত গৌরবজনক একটি ঘটনা। সব জাতির জন্যই স্বাধীনতা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য হলেও সবার পক্ষে স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব হয় না।
হৃদয়ে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ধারণ করা সত্ত্বেও যে জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে মুক্ত হতে পারে না, তার মতো দুর্ভাগা জাতি আর হয় না। মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য প্রচুর মূল্য দিতে হয়। বাংলাদেশের মানুষ বরাবরই স্বাধীনতাপ্রিয়। তারা স্বাধীনতাহীনতায় বাঁচতে চায় না। কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা এমনি এমনি আসেনি। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশের মানুষকে বারবার আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়েছে, দিতে হয়েছে প্রচুর রক্ত।
চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৭১ সালে লাখ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্তের দামে কেনা, কারও দয়া বা অনুগ্রহে প্রাপ্ত নয়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কোনো ধরনের পূর্বঘোষণা ছাড়াই নিরীহ বাঙালির ওপর নৃশংস আক্রমণ পরিচালনা করে। সেই রাতে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হাতে গ্রেফতার বরণ করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর এমন কাপুরুষোচিত হামলার কারণে জাতি তখন দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ে, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও সব পালিয়ে যান; ফলে ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে জাতি কোনো নির্দেশনা পাচ্ছিল না। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক।
মাত্র কয়েক বছর আগে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেছি। মার্চের ৩ তারিখে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করায় ঢাকা আন্দোলনের শহরে পরিণত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়। আমি নিজ মহকুমা শহর ফেনীতে চলে যাই। একপর্যায়ে আমি ঢাকা আসার জন্য প্রস্তুতি নিলেও মা-বাবার ম্লান মুখ দেখে আর তাদের নিষেধ শুনে ঢাকা আসার সাহস পাইনি। ফেনীতে অবস্থান করেই আন্দোলন-সংগ্রামের খবর পাচ্ছিলাম। ২৫ মার্চ ঢাকায় সংঘটিত পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের কথাও ফেনীতে বসেই শুনতে পাই। ২৮ তারিখ সকালে ফেনী শহরের রাস্তার মোড়ে মোড়ে জটলা করে লোকজনকে রেডিও শুনতে দেখি।
কৌতূহলী হয়ে আমি ও আমার কয়েকজন বন্ধু সেই জটলায় শামিল হই। এমন সময় শুনতে পাই রেডিওতে জনৈক মেজর জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছেন। প্রথমে নিজ নামে এবং পরবর্তীকালে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়। মেজর জিয়াকে আমি চিনতাম না। তার নামও আগে কখনো শুনিনি। কিন্তু সেদিনের মেজর জিয়ার সেই স্বাধীনতার ঘোষণা আমার মনে যে কী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, তা এখন ব্যাখ্যা করে বোঝানো যাবে না।
আমি তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেব। কিন্তু বিষয়টি আমি অন্য সবার কাছে গোপন রাখি। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্লাস শুরুর ঘোষণা দেন এবং সবাইকে নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে কর্মস্থলে যোগদানের নির্দেশ প্রদান করেন। আত্মীয়স্বজন ও শুভাকাক্সক্ষীদের পরামর্শে আমি ৩১ মে ঢাকায় চলে আসি এবং কর্মস্থলে যোগদান করি।
ঢাকায় আসার পরও আমি সুযোগ খুঁজতে থাকি কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত হওয়া যায়। ঢাকায় এসেও স্বস্তিতে থাকতে পারছিলাম না। আমাকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছিল। জুলাইয়ের শেষদিকে ‘যমদূত বাহিনী’ ডাকযোগে আমাকে একটি চিঠি পাঠিয়ে হত্যার হুমকি দেয়। আমি অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি এবং ঢাকা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেই। আমি বাড়িতে চলে যাই। বাড়ি যাওয়ার পরদিনই রাজাকার বাহিনী আমাদের বাড়ি আক্রমণ করে। তারা নির্বিচারে গুলি করতে তাকে।
আমি বুঝতে পারি, যে কোনো সময় আমাকে গ্রেফতার করা হতে পারে। আমার বড় চাচা একটি গোপন পথ দিয়ে বাড়ির বাইরে চলে যেতে সাহায্য করেন। আমি বুঝতে পারি, ফেনীতে অবস্থান করা আমার জন্য নিরাপদ নয়; তাই শেষ পর্যন্ত সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে আমি সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করি। পরবর্তীকালে সেখান থেকে কলকাতা গমন করি এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতে থাকি। একইসঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত হই।
ভারতে অবস্থানকালে আমরা দেশের স্বাধীনতার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। ডিসেম্বরের প্রথমদিক থেকেই যুদ্ধের ফলাফলের চিত্রটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিভিন্ন সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় এবং পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আমরা বুঝতে পারি বিজয় অতি সন্নিকটে। ১৬ ডিসেম্বর আমরা রেডিও মারফত পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের সংবাদ জানতে পারি। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী রেডিওতে ভাষণ দেন।
তিনি বলেন, ‘ঢাকা এখন মুক্ত ও স্বাধীন দেশের রাজধানী।’ রেডিওতে মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত বিজয় এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের সংবাদ শুনে সেদিন কী যে খুশি হয়েছিলাম, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আনন্দে আত্মহারা হয়ে পাশের মিষ্টির দোকানে গিয়ে কয়েক প্যাকেট মিষ্টি কিনে আস্তানায় ফিরে আসি। তখনো বিশ্বাস হচ্ছিল না আমরা সত্যি সত্যি স্বাধীনতা অর্জন করেছি। মিষ্টি নিয়ে আমার আবাসস্থল প্রেসিডেন্সি বোর্ডিংয়ে গিয়ে এর বাসিন্দাদের মধ্যে বিতরণ করি। পরে আরও কয়েক প্যাকেট মিষ্টি কিনে বউবাজারে বিকাশ দা এবং ধ্রুব দা’র মেসে উপস্থিত হই। সবাই মিলে আনন্দ করে মিষ্টি খাই।
এ সময় কেউ কেউ আনন্দে আত্মহারা হয়ে নাচতে থাকে। রাতের বেলাতেই আমাদের অনেক শরণার্থী-শিক্ষকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেই। ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করলেও আমরা তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশে ফিরে আসতে পারিনি। কারণ যে চাকরিতে নিয়োজিত ছিলাম, সেখান থেকে রিলিজ নিয়ে আসতে বেশকিছু দিন লেগে যায়। আর এক মুহূর্ত সেখানে থাকতে মন চাইছিল না। কিন্তু নানা কারণেই আমাদের বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন কিছুটা বিলম্বিত হয়। অবশেষে ১৯৭২ সালের ৫ জানুয়ারি কলকাতা থেকে বিমানে আগরতলা পৌঁছি। একই দিন আগরতলা থেকে একটি বাসযোগে বিলোনিয়া সীমান্তে এসে উপস্থিত হই।
রাত তখন আনুমানিক ৯টা। আমার সঙ্গে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শহীদ উদ্দিন আহমেদ। বিলোনিয়ায় পৌঁছে দেখি সেখানকার অধিবাসীরা আনন্দে আত্মহারা। আমি, শহীদ উদ্দিন আহমেদ এবং আরও কয়েকজন যাত্রী মিলে একটি জিপ ভাড়া করে রাত ১০টার দিকে ফেনীর দিকে যাত্রা শুরু করি। বিধ্বস্ত রাস্তা দিয়ে ফেনী আসতে আমাদের প্রায় তিন ঘণ্টা লাগে। রাত ১টা নাগাদ আমরা ফেনী শহরে উপনীত হই এবং অত্যন্ত দ্রুত বাড়িতে প্রবেশ করি। আমি বাড়িতে প্রবেশ করলে মা-বাবা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না আমি ফিরে এসেছি। তারা ভেবেছিলেন হয়তো আমি বেঁচে নেই। তাই তারা আমাকে ফিরে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তারা কান্নায় ভেঙে পড়েন। মা-বাবাসহ পরিবারের সবাই বেঁচে আছেন জেনে আমি চিন্তামুক্ত হই এবং স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমাদের পরিবারের ওপর বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছে। বিশেষ করে আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছি এটা জানার পর রাজাকার বাহিনী আমার পরিবারের ওপর নির্মম নির্যাতন শুরু করে। সেই ভীতিকর দিনগুলোর কথা স্মরণ করে আমার বাবা বলেন, ‘প্রতিদিন ভোরবেলা ফজরের নামাজ আদায় করার পর মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকতাম। আর এশার নামাজ আদায় করার পর হিসাব করতাম, তাহলে আরও একদিন বাঁচালাম।’ বাবার বলা এই একটি মাত্র কথা থেকেই মুক্তিযুদ্ধকালীন আমার পরিবারের মনোযন্ত্রণার বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারি। কী দুঃসহ ছিল সেসব দিনের স্মৃতি। এমন যন্ত্রণার বিষয় শুধু অনুভব করা যায়, বর্ণনা করা যায় না।
১৯৭২ সালের ১৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। ওইদিনই একটি শোকসভার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়। আমরা সবাই শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ি। যেসব সহকর্মীকে দেশত্যাগের আগে জীবিত রেখে গিয়েছিলাম, ফিরে এসে তাদের অনেককেই আর পাইনি। দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য তারা জীবন উৎসর্গ করেছেন। আমাদের বহু ছাত্র, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারী এ স্বাধীনতা-সংগ্রামে শহীদ হয়েছেন। তাদের আত্মদান বৃথা যেতে পারে না, বৃথা যায়নি।
‘মায়ের এ অশ্রুধারা, বীরের এ রক্তস্রোত’ বৃথা যাবে না বলে আমরা সেদিন আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলাম। আজ বিজয় দিবসে তাদের স্মরণ করি। তাদের আত্মদান কতটা সফল হয়েছে, সেই হিসাব করার সময় এসেছে।
ভারতে অবস্থানকালে আমি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে একান্তভাবে মেলামেশা করেছি। তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয় জানার চেষ্টা করেছি। আমার একটি বিষয় মনে হয়েছে, যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাদের ব্যক্তিগত কোনো বৈষয়িক চাওয়া-পাওয়া ছিল না। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে দেশের স্বাধীনতা অর্জন করা। শরণার্থী শিবিবে তারা প্রচণ্ড দুর্ভোগের শিকার হলেও তাদের মধ্যে কোনো ক্ষোভ বা অসন্তোষ প্রত্যক্ষ করিনি। নির্ভেজাল দেশপ্রেম ছিল তাদের প্রেরণার উৎস। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করে এমন একটি দেশ গঠনের স্বপ্ন দেখতেন, যেখানে কোনো ধরনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য থাকবে না। প্রত্যেক নাগরিক তাদের ন্যায্য অধিকার নিয়ে বসবাস করতে পারবে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যখন আত্মসমর্পণ করে, সারা দেশে আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। সবাই ভাবতে শুরু করে, এবার আমরা নিজ দেশে অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারব। কিন্তু ছন্দপতন ঘটতে খুব একটা দেরি হয়নি। স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সব দল-মতের প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠিত হলে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের উন্নয়ন অর্জনের চেষ্টা চালানো সম্ভব হতো। কিন্তু তা না করে আওয়ামী লীগ এককভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গড়ে ওঠা জাতীয় ঐক্য অল্প সময়ের মধ্যেই বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়। স্বাধীনতার পর ক্ষমতাসীন তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেই নানা ধরনের অনিয়ম-অনাচার শুরু করে। তারা মানুষের বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেয়। রাজনৈতিক অধিকার খর্ব করা হয়।
সারা দেশে শুরু হয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ব্যাপক লুটপাট। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, লাইসেন্সবাজি হয়ে দাঁড়ায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সারা দেশে ভয়াবহ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দলীয়করণ-আত্মীয়করণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। এ অবস্থায় ১৯৭৪ সালে ঘটে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, যাতে লাখ লাখ মানুষ মারা যায়। সেই সময়ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা খাদ্যসামগ্রী দেশের বাইরে পাচার করতে থাকে। শাসক দলের নেতাকর্মীরা দুর্দণ্ড প্রতাপশালী শোষকে পরিণত হয়। আর দেশের মানুষ অসহায়ভাবে তাদের শোষণের শিকার হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দেশের মানুষের মধ্যে যে ইস্পাতদৃঢ় ঐক্য গড়ে উঠেছিল, তা ম্লান হয়ে যায়।
জাতি বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল সমাজ থেকে সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে দেশকে একটি আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করা। কিন্তু ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী তাদের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি দেশের সব রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে একদলীয় শাসন বাকশাল কায়েম করে। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ার কারণে দেশে মারাত্মক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। একাধিক রাজনৈতিক দল সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের জন্য সচেষ্ট হয়। স্বৈরাচারী শাসনের মাধ্যমে দেশের জনগণকে বিভক্ত করে ফেলা হয়।
সেই বিভক্তি পরবর্তীকালে আর কখনোই শেষ হয়নি। বেশ কয়েকবার জাতিকে আবারও ঐক্যবদ্ধ করার সুযোগ এলেও রাজনীতিবিদদের অপরিণামদর্শিতার কারণে তা কাজে লাগানো যায়নি। বিশেষ করে ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতন ঘটলে দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। এরশাদবিরোধী আন্দোলন চলাকালে তিন জোটের মধ্যে যে সমঝোতা হয়েছিল, তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হলে দেশে এত বিভক্তি ও হানাহানির আশঙ্কা সৃষ্টি হতো না। আওয়ামী লীগ যতবারই রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েছে, তা জাতিকে বিভক্ত করে তাদের দুর্বৃত্তায়িত শাসনকে চিরস্থায়ী করার চেষ্টা করেছে। বিগত ১৬ বছর আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সব গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ধ্বংস করে দিয়ে আজীবন ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন দেখেছিল।
কিন্তু বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাদের সেই দিবাস্বপ্নকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। এবারের গণ-অভ্যুত্থান কিন্তু সরকার পরিবর্তনের সাধারণ কোনো আন্দোলন ছিল না, এবারের আন্দোলন ছিল সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে সত্যিকার গণতান্ত্রিক এবং মানবিক রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলন। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেই নির্বাচনের মাধ্যমে যারা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন, তাদের গণআকাঙ্ক্ষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। কেউ যেন মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। শাসক যদি স্বৈরাচারী শোষকে পরিণত হয়, তাহলে তাদেরও বিগত সরকারের মতো করুণ পরিণতি ভোগ করতে হবে। কাজেই সাধু সাবধান।
ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত

