ওসমান হাদির হত্যা : রাষ্ট্রীয় ঐক্যের জন্য অশনিসংকেত
ব্রি. জে. এইচআরএম রোকন উদ্দিন (অব.)
প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দেশ আজ তার বিপ্লবোত্তর ইতিহাসের সবচেয়ে সংকটময় ও স্পর্শকাতর সময় অতিক্রম করছে। একের পর এক ঘটে চলা ঘটনাপ্রবাহ আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, নিরাপত্তা কাঠামো এবং সামষ্টিক জাতীয় চেতনাকে নগ্নভাবে উন্মোচিত করে দিয়েছে। এমন এক সময়ে, যখন সংযম, দূরদর্শিতা ও জাতীয় ঐক্য সর্বাধিক প্রয়োজন ছিল, ঠিক তখনই জাতি আক্রান্ত হয়েছে শোক, আতঙ্ক ও গভীর হতাশায়।
বেগম খালেদা জিয়া আজ আর কেবল একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান নন; তিনি জাতীয় নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার এক প্রতীক। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে থাকা এ নেত্রীকে ঘিরে গোটা জাতির সর্বস্তরের মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও দোয়ার ঢল নেমেছে। দল-মত নির্বিশেষে এ স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া একটি গভীর সত্য তুলে ধরেছে-জাতীয় সংকটের মুহূর্তে মানুষ দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে সেসব নেতৃত্বের দিকে তাকায়, যারা সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন এবং যাদের নেতৃত্ব রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তার অসুস্থতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে-নেতৃত্ব কেবল ক্ষমতার প্রশ্ন নয়, এটি নৈতিক কর্তৃত্বেরও বিষয়, যা দীর্ঘ ত্যাগ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়।
এরই মধ্যে জুলাই বিপ্লবের অন্যতম সামনের সারির নেতা ওসমান হাদির ওপর নৃশংস হামলা গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছে। একজন ঘাতকের গুলিতে আহত হয়ে তিনি সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে তিন দিন মুমূর্ষু অবস্থায় কাটিয়ে ১৮ ডিসেম্বর রাতে শহীদি কাফেলায় শরিক হয়েছেন। আল্লাহ তাকে জান্নাতে উঁচু মর্যাদায় আসীন করুন। এ ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়, কিংবা হঠাৎ ঘটে যাওয়া সহিংসতাও নয়। এটি একটি সুস্পষ্ট সতর্কবার্তা-পরিকল্পিত, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং গভীরভাবে উদ্বেগজনক। জাতি তার দ্রুত আরোগ্যের জন্য প্রার্থনা করছে, কিন্তু একইসঙ্গে আমাদের স্বীকার করতেই হবে, রাজনৈতিক সহিংসতা আবারও একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠগুলোকে দমিয়ে রাখা বা স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য বিশেষ মহল তাদের অপপ্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে, কিন্তু আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। এ লড়াই কখনো থামবে না, যতদিন আমাদের দেশ ভারতীয় আধিপত্য থেকে মুক্ত হবে না।
আজ দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়েছে শুধু বাইরের চাপের কারণে নয়, বরং অভ্যন্তরীণ বিভাজনের ফলেও। রাজনৈতিক দলগুলো যখন সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থকে জাতীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়, তখনই তারা হস্তক্ষেপ ও ষড়যন্ত্রের দরজা খুলে দেয়। স্পষ্ট লক্ষণ পাওয়া যাচ্ছে-কিছু স্বার্থান্বেষী মহল ইচ্ছাকৃতভাবে সহিংসতা, আতঙ্ক ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে, যার লক্ষ্য নির্বাচন বিলম্বিত বা ভণ্ডুল করা। তাদের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হলো গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যাত ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক শক্তিকে পুনর্বাসনের সুযোগ করে দেওয়া।
ওসমান হাদির ওপর হামলাকে তাই কোনো বিচ্ছিন্ন বা আকস্মিক ঘটনা হিসাবে দেখার সুযোগ নেই। এটি একটি সুপরিকল্পিত ধারাবাহিকতার সূচনামাত্র; যার লক্ষ্য রাষ্ট্রকে ধীরে ধীরে অস্থিতিশীলতার গভীর খাদে ঠেলে দেওয়া। ইতিহাস বলে, যখন একটি জাতি রাজনৈতিক রূপান্তরের সন্ধিক্ষণে পৌঁছে, তখনই অদৃশ্য শক্তিগুলো সক্রিয় হয়-ভয় সৃষ্টি করে, নেতৃত্বকে লক্ষ্যবস্তু বানায় এবং জনগণের মধ্যে অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে দেয়। আজ বাংলাদেশ ঠিক সেই বিপজ্জনক মোড়েই দাঁড়িয়ে আছে। যদি এখনই কঠোর, সমন্বিত ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হয়, তবে সামনে যে সময় অপেক্ষা করছে, তা হবে আরও ভয়াবহ।
একইসঙ্গে পুরোনো বিভাজনের ইস্যুগুলোকে সচেতনভাবে আবারও পুনরুজ্জীবিত করা হতে পারে। সংখ্যালঘু ইস্যুকে অতিরঞ্জিত ও বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টাও চলতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে নতুন করে জটিল করে তুলে জাতীয় সংহতিতে আঘাত হানার অপচেষ্টা স্পষ্ট। সামাজিক সম্প্রীতি ভাঙার জন্য গুজব, অপপ্রচার ও উসকানিমূলক বয়ান ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। এগুলো কোনো নতুন বা স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনা নয়। এগুলো পরিচিত অস্থিতিশীলতার নীলনকশা-যা অতীতে বহু দেশে প্রয়োগ করা হয়েছে রাষ্ট্রকে দুর্বল করতে, নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এবং জনগণের আস্থা ভেঙে দিতে। আজকের বাংলাদেশে সেই নীলনকশারই পুনরাবৃত্তি ঘটছে, আর ওসমান হাদির ওপর হামলা তার নির্মম প্রথম ঘোষণা।
এ পরিস্থিতিতে করণীয় স্পষ্ট, যদিও কঠিন। জাতীয় ঐক্য ও সর্বদলীয় ঐকমত্য এখন আর বিলাসিতা নয়-এটি সময়ের অপরিহার্য দাবি। ঐক্য ছাড়া স্থিতিশীলতা নেই, স্থিতিশীলতা ছাড়া বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়, আর বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন ছাড়া গণতান্ত্রিক রূপান্তর টেকসই হবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত বিদেশি এজেন্ডা ও স্বল্পমেয়াদি স্বার্থ পরিহার করে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া। সরকারের ওপর দায়িত্ব সবচেয়ে ভারী। আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় জরুরি ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে সমন্বিত নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা অভিযান চালাতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়াই অপরাধী নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতে হবে। নির্বাচন আচরণবিধি কঠোর ও নিরপেক্ষভাবে প্রয়োগ করতে হবে। অস্বীকারের সংস্কৃতি পরিহার করে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
বিদেশি হস্তক্ষেপ প্রকাশ্য হোক বা গোপন-দৃঢ়ভাবে প্রতিহত করতে হবে। যে জাতি স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে, সে জাতি তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কোনোভাবেই অন্যের হাতে তুলে দিতে পারে না। একইসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া প্রচারণা, উসকানি ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা প্রয়োজন। মত প্রকাশের স্বাধীনতা বজায় রেখেই আইনানুগ নিয়ন্ত্রণ ও জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব শুধু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নয়। জনগণকেও হতে হবে সজাগ, ঐক্যবদ্ধ ও সচেতন। জুলাই বিপ্লব কোনো একদিনের ঘটনা নয়; এটি একটি অঙ্গীকার। সেই অঙ্গীকার রক্ষা পাবে তখনই, যখন প্রতিহিংসার বদলে সংযম, বিভাজনের বদলে ঐক্য এবং দলীয় স্বার্থের বদলে জাতীয় স্বার্থকে আমরা বেছে নেব। ইতিহাস আরেকটি ব্যর্থতা ক্ষমা করবে না। এখনই একসঙ্গে পদক্ষেপ নেওয়ার সময়। কোনো উসকানিতে আমরা যেন কোনো বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতায় জড়িয়ে না পড়ি, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। হাদির মৃত্যুকে আমাদের শক্তিতে পরিণত করতে হবে।
ব্রি. জে. এইচ আর এম রোকন উদ্দিন (অব.) : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
hrmrokan@hotmail.com
