‘বাংলাদেশপন্থি সাংস্কৃতিক বিপ্লব না হওয়া পর্যন্ত মুক্তি আসবে না’
শরিফ ওসমান হাদি
প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
(জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সম্মুখসারির যোদ্ধা এবং ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শহীদ শরিফ ওসমান হাদি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণার পরদিন গত ১২ ডিসেম্বর দুপুরে পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। দীর্ঘ প্রায় ১ সপ্তাহ চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে রাত পৌনে ১০টার দিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। অকুতোভয় এ মানুষটি গুলিবিদ্ধ হওয়ার মাত্র ক’দিন আগে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে শেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। যেখানে উঠে এসেছিল তার চিন্তা-চেতনা, রাজনৈতিক লক্ষ্যসহ অনেক কিছুই। সেই সাক্ষাৎকারের উল্লেখযোগ্য অংশ যুগান্তরের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।)
আমাদের ইচ্ছা ছিল, আমরা একটা রোল মডেল তৈরি করতে চাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে। মানে, যে ঐতিহাসিক জুলাই অভ্যুত্থান হলো, এটাকে কেন্দ্র করে নতুন করে কিছু শুরু করা, যেটি আগে হয়নি, যেটাকে মানুষ পছন্দ করবে। আমরা খুব সাহস নিয়ে শুরু করেছিলাম। নিঃসঙ্গ লড়াই ছিল; কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ নিঃসঙ্গ লড়াইটা এখন এত, আল্লাহ এর সঙ্গে এত মানুষ জোগাড় করে দিয়েছেন এবং এত আনন্দময় করে দিয়েছেন! এবারের ইলেকশনটা আমাদের লড়াইয়ের একটা অংশ। আমরা এমন একটা জায়গা তৈরি করতে চাই, যাতে বাংলাদেশে এই যে হাজার হাজার কোটি টাকার নির্বাচন, মানুষকে ভয় দেখিয়ে নির্বাচন করা, এই জায়গা থেকে যেন সরে গিয়ে ভালোবাসার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভালোবাসার একটা দেশ এবং ইনসাফের একটা দেশ যেন তৈরি হয়। ইনশাআল্লাহ আমার মনে হচ্ছে, আমরা একটু একটু আগাচ্ছি এবং এটাই আমাদের সব থেকে ভালো লাগার জায়গা।
অনেকেই নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছে, বলছে যে, নির্বাচন আদৌ হবে কিনা। আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার হতেও দেখি যে, নির্বাচন হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নাকি দেখা যাচ্ছে না; কিন্তু নির্বাচনটা না হলে সুবিধা কার? নির্বাচনটা না হলে একমাত্র সুবিধা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের। কারণ তারা চাইবে যে, এ নির্বাচনটা পিছিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে অন্যান্য দলগুলোর মধ্যে পলিটিক্যাল কেওয়াস তৈরি করা। সেটি হলে যদি দেশে একটা অস্থিতিশীল পর্যায় তৈরি, তখন তারা একটা ওয়ান-ইলেভেন তৈরির চেষ্টা করবে অথবা এমন একটা সরকার বসাবে, যে সরকার ছয় মাস-১ বছর সময় নিয়ে একটা ‘গুড আওয়ামী লীগ’ তৈরি করে একটা নির্বাচন দেবে। আমাদের দেশের স্থিতিশীলতার জন্য তাই নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি এবং আমরা যেটা বুঝি, সরকারের তরফে একটা ভীষণ আন্তরিক চেষ্টা আছে যে, তারা খুব সুন্দর একটা নির্বাচন দিতে চায় এবং আমার ধারণা নির্বাচন ইনশাআল্লাহ সময়মতো হয়ে যাবে। সেটি না হলে আমাদের জন্য অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।
এখন থেকে নয় মাস আগে আমি প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিলাম, আমি ঢাকা-৮-এ নির্বাচন করব এবং এটা বুঝে-শুনেই বলেছি। আপনারা যদি আমাদের একক্টিভিজমটা খেয়াল করেন, দেখবেন আমাদের পুরো লড়াইটা একটা কালচারাল লড়াই। আমরা বলেছি, বাংলাদেশে যতক্ষণ না পর্যন্ত একটা বাংলাদেশপন্থি সাংস্কৃতিক বিপ্লব হবে, ততদিন পর্যন্ত আমাদের মুক্তি হবে না। এই যে সবাই বলে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় নেই, আমি এটা বিশ্বাস করি না। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় কালচারালি, মানে রাজনৈতিক ক্ষমতার জায়গা থেকে হয়তো এর ওপরের স্তরটা নেই; কিন্তু যে ন্যারেটিভ, যে এস্টাবলিশমেন্ট, যে ভাবনা, যে চিন্তা কাঠামো-এর পুরোটাই আওয়ামী লীগের তৈরি রাজনীতির ওপরে দেশ চলছে। ধরেন এ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরে বাংলাদেশি যত দল আছে-বিএনপি বলেন, জামায়াতে ইসলামী বলেন, তারা কিন্তু শুধু আগের আলোচনাগুলোর ওপরে রিঅ্যাকশন দিচ্ছে। আমরা কি নতুন করে কোনো কালচারাল এস্টাবলিশমেন্ট বা চিন্তা মনস্তত্ত্ব তৈরি করতে পারছি? আওয়ামী লীগের একশটা লেয়ার ছিল বেনামে, এ সাংস্কৃতিক হেজিমনি তৈরি করার জন্য, যে তার মনস্তত্ত্ব তৈরি করে দেবে। যে ছেলেটা প্রচুর অ্যান্টিআওয়ামী লীগ হবে, সেই ছেলেটাও দিনশেষে নিজের অজান্তেই যে পলিটিক্যাল অ্যান্ড কালচারাল ইনপুটটা দেবে, সেটা কিন্তু আওয়ামী লীগের ঘরে যাবে। যেমন ধরেন, আমি আওয়ামী লীগ পছন্দ করি না; কিন্তু শেখ হাসিনার বিকল্প তো কেউ নেই। এ ধরনের এস্টাবলিশমেন্ট তৈরি করা হয়েছিল। আগামীতে যারাই নির্বাচনের পর পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবে, তারা কি শুধুই পাঁচ বছরের চিন্তাই করবে? আগামী ৫০ বছরের চিন্তা কই?
আমাদের দেশে সাংস্কৃতিক মানে বলতে অনেকে বোঝে শুধু নাচ-গান-কবিতা কিংবা একটা কনসার্ট করলেই হয়ে যাচ্ছে, একটা কাওয়ালি প্রোগ্রাম করলেই হয়ে যাচ্ছে-এই যে মনস্তত্ত্ব তৈরি হয়েছে, সেখানে নতুন চিন্তাধারার আয়োজন তো নেই। আমাদের লড়াইটা হলো, আমরা একটা বাংলাদেশি সাংস্কৃতিক সংগ্রাম চাই, একটা বিপ্লব চাই। যেমন, এখন যে ছেলেটাই তৈরি হবে, সে হয়তো পরবর্তীকালে কোনোদিন বিএনপি করবে, জামায়াত করবে, এনসিপি করবে-সে হয়তো পড়তে আমেরিকায় চলে যাবে, কানাডা যাবে, অস্ট্রেলিয়ায় যাবে। কিন্তু আমাদের এ গ্রুমিংয়ের মধ্য দিয়ে যে ছেলেটা, যে মেয়েটা তৈরি হবে, সে যে ইনপুটটাই দেবে, সেটা বাংলাদেশের কাজে লাগবে। সেটা কোনোভাবে ভারতকে সাপোর্ট করবে না, সেই ইনপুটটা যাবে বাংলাদেশের সীমান্তের পক্ষে, স্বাধীনতার পক্ষে এবং আমার নিজের অধিকারের পক্ষে, ইনসাফের পক্ষে।
এই যে ঐতিহাসিক একটা গণ-অভ্যুত্থান হলো, আপনি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্যারালাল আর কোনো প্রতিষ্ঠান কি দাঁড় করানোর কোনো উদ্যোগ কারও মধ্যে দেখেছেন? আমরা দেখছি না। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের হাব হলো শাহবাগ। আপনারা দুটি জায়গায় আমাদের খুব ফোকাসড দেখবেন। আমরা পলিটিক্সটা করি সাংস্কৃতিক প্রয়োজনে, সংস্কৃতির নির্মাণের প্রয়োজনে। আমাদের রাজনীতি করা এবং নির্বাচনে অংশ নেওয়া বা নির্বাচনটা মুখ্য নয়। আমরা নতুন রাজনীতি নির্মাণ করতে চাই, তার অংশ হিসাবে নির্বাচন করছি। আর রাজনীতি নির্মাণ করতে চাই আমরা সাংস্কৃতিক কারণে। আমরা যদি আগামী ১০ বছরের মধ্যে একটা নতুন সুষ্ঠু-সুন্দর জায়গা তৈরি করতে না পারি, এদেশে আবার সেই শাহবাগ ফিরবে ২০১৩ সালের মতো। নট নেসেসারি, সেটা আওয়ামী লীগের হাত ধরে ফিরবে; কিন্তু কারও না কারও কাঁধে ভর করে ফিরবেই।
আপনি রিসেন্টলি দেখেছেন কিনা, সজীব [ওয়াজেদ জয়] একটা কথা বলেছে। বলেছে, আওয়ামী লীগ ছাড়া বাংলাদেশে নির্বাচন সম্ভব নয়, হতেও দেওয়া হবে না। আপনার কাছে কী মনে হয়, আওয়ামী লীগ আসন্ন নির্বাচনের জন্য বিশাল একটা বাধা হয়ে থাকবে? দেখেন আওয়ামী লীগের শক্তিটা কোথায়, তারা গত ১৫ বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা মানে এইটা এমন অঙ্কে বলার সুযোগ নেই, পাচার করেছে। আপনি ভাবেন, একটা জেলা সভাপতি ছাত্রলীগের ফরিদপুরের, সেও কয়েকশ কোটি টাকা পাচার করেছে। সেই টাকাগুলো তো তাদের কাছে আছে। তাদের কারণে বাংলাদেশের পরিস্থিতি এমন যে, মাত্র ৫ হাজার টাকা দিয়ে কনট্রাক্ট কিলিং করানো সম্ভব। হয়তো আপনি রিকশায় করে যাচ্ছেন, যে কোনো মাদকাসক্তকে দিয়ে.. এই যে আমি সারাদিন ঘুরি, হয়তো আমাকে পোঁচ মেরে চলে যাবে। আমাদের দেশে এখনো চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে অনেক মানুষ আছে। আমরা যদি মানুষের ন্যূনতম একটা ভালো আর্থিক জীবন সবার জন্য তৈরি করতে পারি, ধনী-গরিবের বৈষম্যটা দূর করতে পারি, তাহলে আশা করি, দেশ অনেক এগিয়ে যাবে। নির্বাচনে ভোট কেনার ব্যাপারটাই দেখেন, কোনো শিক্ষকের কাছে কিন্তু কেউ গিয়ে ভোট কিনতে যায় না। কারণ সেই শিক্ষক জানে, তার ভোটটা তার অধিকার। যার একটা ডিগনিটির লাইফ আছে, সে কি ৫ হাজার টাকায় ভোটটা বেচবে? বেচবে না। কিন্তু যে লোকটার নুন আনতে পান্তা ফুরায়, সে কিন্তু বেচবে।
আমি তো নিয়মিতই সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছি। আমার মা-বোন-স্ত্রী অর্থাৎ পরিবারের এমন কোনো নারী নেই, যাকে নিয়ে এ দুনিয়ায় এমন কোনো নোংরা শব্দ নেই, যা আমার ইনবক্সে দেওয়া হচ্ছে না; কিন্তু আমি এসব গায়ে মাখি না। আপনি আমাকে গালি দিতে পারেন অফকোর্স; কিন্তু আমাকে গালি না দিয়ে যখন আপনি আমার মা-বোন, আমার স্ত্রীকে গালি দিচ্ছেন; এর মানে হলো, আমাদের একটা তুমুল লড়াই করতে হবে সামাজিক মনস্তত্ত্ব পরিবর্তনের, আমি এইটা বোঝানোর চেষ্টা করি। যে গালিটা দিচ্ছে, সে তো মোটিভেটেড হচ্ছে। এইটা তো একদিনে তৈরি হয়নি, একদিনে ভাঙবেও না। আমাকে তো সারাদিনই একা ঘুরতে হয়। কখনো আমার সঙ্গে ১০টি ছোট ভাই থাকে; কিন্তু সারাদিন আমি একাই থাকি। সেটা না থাকলে তো সাধারণ মানুষের কাছে আমি যেতেই পারব না বা তারাও আসবে না। দেখেন, হায়াত-মউতের মালিক আল্লাহ। ন্যূনতম সিকিউরিটি নিয়ে চলাও সুন্নাহ; কিন্তু আমাদের লড়াইটা তো সাধারণ মানুষের জন্য। আমার মা স্বাভাবিকভাবে কান্নাকাটি করেন। আমি আমার মাকে বলেছি, দেখো মা, আমরা যে লড়াইয়ে নেমেছি, আমার মনে হয় কোনো রাজনীতিবিদের বাসায় মৃত্যু হতে পারে না। এটা কোনো ভালো মৃত্যু না। যিনি রাজনীতি করেন, যিনি লড়াই করেন, যিনি বিপ্লবী, যিনি সংগ্রামী-তার মৃত্যুটা হবে একটা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, একটা রাজপথে। একটা গৌরবের মৃত্যু, আমি তো ভীষণভাবে প্রত্যাশা করি। আমি ছোটবেলা থেকে এ স্বপ্নটা দেখি। অনেক জায়গায় বলেছি, একটা তুমুল মিছিল হচ্ছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সেই মিছিলের সামনে আমি আছি, কোনো একটা বুলেট এসে আমার বুকটা হয়তো বিদ্ধ করে দিয়েছে এবং সেই মিছিলে আমি হাসতে হাসতে শহীদ হয়ে গেছি। আমি তখন হাসতে হাসতে আল্লাহর কাছে ভীষণ সন্তুষ্টি নিয়ে পৌঁছাতে চাই, একটা ইনসাফের হাসি নিয়ে আমি আমার আল্লাহর কাছে পৌঁছাতে চাই। ধরেন আগামী ৫০ বছর বাঁচলাম, কিন্তু আমারে দিয়ে দেশের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য, উম্মার জন্য, জাতির জন্য কোনো ইমপ্যাক্ট তৈরি হলো না; কিন্তু আমি ধরেন পাঁচ বছর বাঁচলাম, যদি সেটার মধ্য দিয়ে আগামী ৫০ বছরের ইম্প্যাক্ট তৈরি হয়, তাহলে অনেকদিন বেঁচে থাকা কি সাফল্যের?
শরিফ ওসমান হাদি : জুলাই যোদ্ধা; মুখপাত্র, ইনকিলাব মঞ্চ
