তারেক রহমান। ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ঘটনার সূচনা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার এবারে হাসপাতালে ভর্তি হবার পরপরই। ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসের জনাকীর্ণ অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার দু-দিনের মাথায় ফুসফুসে সংক্রমণ নিয়ে তার হাসপাতালে যাওয়া।
সম্প্রতিকালে তার হাসপাতালে ভর্তির একাধিক ঘটনা ঘটেছে। ফলে সেটা নিয়ে কৌতুহল থাকলেও রাজনীতি খুব একটা ছিল না। সমস্যার শুরু মেডিকেল বোর্ড যখন তার অবস্থা সংকটময় বললেন—তারপর থেকেই।
তারেক রহমানের চরিত্র হননের সুযোগ পেলেই যাদের সব দূষিত রক্ত মস্তিষ্কে পৌঁছায়, তাদের লেখনীতে সোশ্যাল মিডিয়া রীতিমত ‘গীবত জটে’ আক্রান্ত হলো। কার আক্রমণ কতটা তীব্র, কতটা কুৎসিত হতে পারে সেটার এক নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা শুরু হলো। সঙ্গে যুক্ত হলো বিশেষ ‘বট’ বাহিনীর বিষোদগার।
ডিসেম্বরে এরা সচরাচর গুহাবন্দি থাকে অতীত কাণ্ডের স্মৃতি রোমন্থনে লজ্জা আর জনরোষের ভয়ে। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার এবারের অসুস্থতা তাদের জন্য অপ্রত্যাশিত গুহা-মুক্তির সুযোগ করে দিলো। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মার্জারগুলোর কণ্ঠে সহজাত মিউ-মিউ শব্দের পরিবর্তে ব্রাঘ্র গর্জন শোনা গেলো। সেটা তাদের আকারের সঙ্গে যতই বেমানান হোক না কেন!
‘তারেক রহমান দেশে আসছেন না কেনো’—চারদিকে এই চিৎকারের শব্দে কান পাতা দায়। লাফাঙ্গা, কুলাঙ্গার থেকে শুরু করে গালিগালাজের মাত্রা সর্বকালের রেকর্ড ছাড়ালো। শুরু হলো ফেসবুকে বীরত্বের বর্ণনা। ‘আমি হলে এই করতাম’ ‘সেই করতাম’— মা বলে কথা, অথচ খোঁজখবর নিলে দেখা যাবে, পাশের রুমে প্রস্বাব পায়খানায় ভেসে যাওয়া বাবা-মা’র দরজায় সারা মাসে একবার টোকা পরে কি না সন্দেহ। অথবা শহরে কেতাদুরস্ত পুত্রের কাছ থেকে আসা মাত্র ৫০০ টাকার বিকাশ নোটিফিকেশনের প্রত্যাশায় গ্রামের জীর্ণ কুটিরে মিনিটে মিনিটে মেসেজ চেকের নিষ্ফল চেষ্টায় বিধ্বস্ত পিতার অন্তহীন প্রতীক্ষার অবসান হয় না।
এরাই রাতারাতি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হয়ে ফেসবুকে দামোদর নদ পাড়ি দেয়া শুরু করে দিল। ঈশ্বরচন্দ্র প্রয়োজনে দামোদর পাড়ি দিতেন প্রায়ই এটা সত্য, কিন্তু তার সঙ্গে মায়ের জন্য ঝড়ের রাতের সম্পর্ক আমরা আবেগ দিয়ে সৃষ্টি করেছি, ইতিহাস বা তথ্যসূত্র দিয়ে নয়।
কেউ কেউ আবার আরেক কাঠি সরেস। এই ফাঁকে ইতোপূর্বের সব নির্বাচনে জামানত হারানো হঠাৎ নেতাদের তারা উৎসাহে আগামীর প্রধানমন্ত্রীও বানিয়ে ফেললো। দুর্জনেরা বলে তারাও শতগুন উৎসাহে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনঅভ্যস্ত শরীরকে স্যুট কোর্ট টাইয়ের সঙ্গে ধাতস্থ করার চেষ্টায় তখন মরিয়া প্রায়। তারেক রহমান আসছে না কেন? আসছে না কেন? অভিযোগ যখন সাইক্লোন থেকে সুনামিতে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে, তখন ফেসবুকে তারেক রহমান এক অসাধারণ লেখা লিখলেন, প্রথমেই দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রোগ মুক্তির নিরন্তর দোয়া কামনার জন্য দেশবাসীকে জানালেন তার নির্ভেজাল কৃতজ্ঞতা। ধন্যবাদ জানালেন প্রধান উপদেষ্টাকে, কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুললেন না সকল আন্তর্জাতিক নেতাদের, যারা দেশনেত্রীর আরোগ্য কামনা করে বার্তা দিয়েছেন তাঁদের।
সন্তান হিসেবে মাতৃস্নেহের দুর্নিবার আকর্ষণের আকুতি প্রকাশে রইলেন অকৃত্রিম। জানালেন দুর্যোগময় সময়ে মানুষের এমনও পরিস্থিতি হয় যখন কিছু বিষয় সম্মিলিত সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ব্যক্তি সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা সকল ক্ষেত্রেই অবারিত নয়। অনুরোধ করলেন দেশবাসীকে দোয়া অব্যাহত রাখার।
তার এই অসাধারণ ফেসবুক পোস্টের বাস্তবতাকে আরও প্রাঞ্জলভাবে উপস্থাপন করলেন সোশ্যাল মিডিয়ার অসংখ্য বিবেকবান যোদ্ধা। টেলিভিশন টকশোতেও তার অবস্থানের যৌক্তিকতাকে মানবিকভাবে দেখালেন বোদ্ধাজনেরা। কিন্তু চরিত্র হননের এই মহাকাব্যিক শিল্পীরা শয়তানের চাইতেও সংকল্পবদ্ধ, তারা ক্ষান্ত দেবে না কিছুতেই। পাশের কক্ষে শ্বাসকষ্টে অস্থির বাবার অবিরাম কাশির শব্দে এরা বিচলিত হয় না, সামান্য একটা কাশির সিরাপ আনার সময় বা ইচ্ছে এদের নেই। সপ্তাহ ধরে জ্বরে কাতড়ানো ছোট মেয়েকে ডাক্তার দেখানো এদের কাছে সময় নষ্ট।
কিন্তু তারেক রহমানের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধারে এরা বিরামহীনভাবে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। এই কাজে তাদের একাগ্রতায় বাবা বা কন্যার অসুস্থতা কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। তাদের অগ্রাধিকার একটাই—‘তারেক রহমান কেন আসে না’। এই প্রশ্নের উত্তর পেতে প্রয়োজনে বাবা বা কন্যাকে কোরবানি করতেও এরা পিছু পা হবে না।
ওদিকে ধীরস্থির শান্ত তারেক রহমান শত কটুক্তিতেও অবিচল তার পরিকল্পিত লক্ষ্যে। আবেগ নয়, তার মায়ের সর্বোচ্চ সুচিকিৎসাই তার অগ্রাধিকার, সঙ্গে সমান গুরুত্বপূর্ণ দেশবাসীর জন্য তার উপর অর্পিত দায়িত্ব। এমনকি তার সহকর্মী নেতৃবৃন্দ যখন বিচলিত-ইতস্তত, তখন তিনি লন্ডনে বসে নিবিড় যোগাযোগ রাখলেন ঢাকায় বিশেষজ্ঞ মেডিকেল টিমের সাথে, সংযুক্ত করলেন বিশ্ববিখ্যাত জন হপকিনস, লন্ডন ক্লিনিক, চীনের সর্বশ্রেষ্ঠ মেডিকেল টীমকে, যোগাযোগ করলেন কাতারে, ব্যবস্থা হলো এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের। যেটায় রয়েছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ আইসিইউ সুবিধা, মেডিকেল বোর্ডের সাথে সংযুক্ত থাকলেন প্রতিদিন, অপেক্ষা করলেন সঠিক সময়ের, ধৈর্য হারালেন না এতোটুকুও, শত ট্রল, শত কুটুক্তির একটাও গায়ে মাখালেন না, ঠিক সঠিক সময়ে স্ত্রী হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ জোবাইদা রহমানকে পাঠিয়ে দিলেন মায়ের চিকিৎসা সরাসরি তদারকি করতে।
চিকিৎসক বোর্ডের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত যখন বেগম জিয়া’র বিদেশ গমন বিলম্বিত করার পক্ষে তখন এক মুহুর্ত বিলম্ব করলেন না সিদ্ধান্ত নিতে। জানিয়ে দিলেন তিনি আসছেন ২৫ ডিসেম্বর। এমন এক সময়ে যখন জুলাই যোদ্ধা ওসমান হাদির মাথায় গুলিবিদ্ধ হবার ঘটনা ঘটেছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে। ওসমান হাদির উপর কাপুরুষচিত আক্রমণের করলেন তীব্র নিন্দা আর বুঝিয়ে দিলেন এমন আক্রমণের মহড়ায় বিচলিত হবার মত মানুষ তিনি নন। আর জনদুর্ভোগের বিষয় মাথায় রেখে ফেরার এমন এক দিন নির্বাচন করলেন যখন টানা তিনদিনের ছুটি। আরও সতর্কতায় দিন জানালেও ক্ষণটি রাখলেন গোপন।
এটাই হলো একজন নেতার সিদ্ধান্তের মাহাত্ম্য। যেখানে আবেগের চাইতে যুক্তি আর বাস্তবতা অনেক উপরে। যেখানে মায়ের জন্য হা-হুতাশ আর গগনবিদারী আহাজারি নয়। বরং শান্ত সহিষ্ণু চিত্তে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে ঠান্ডা মাথায় শত সহস্র সমস্যা আর প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে মায়ের জন্য নিশ্চিত করলেন সুচিকিৎসা আর অবসান ঘটালেন দীর্ঘ প্রতিক্ষার। লজ্জায় নত করলেন সমালোচকদের। মাতৃভক্তি নামে প্রচলিত অর্থহীন প্রচলিত আবেগের বাইরে এক নতুন মাত্রার মাতৃভক্তির সঙ্গে পরিচিত করালেন বিশ্ববাসীকে। দুর্জনদের স্তব্ধ করলেন সাহসিকতার সর্বোচ্চ প্রমাণ দিয়ে।
তারেক রহমান আপনিই প্রকৃত নেতা, আপনি প্রমাণ করেছেন আপনার পরিবার যেমন আপনার কাছে নিরাপদ। তেমনি দেশবাসীকে আশ্বস্ত করতে পেরেছেন, বাংলাদেশ আপনার হাতে কতটা নিরাপদ। আপনার জন্য আগাম অভিনন্দন।
ইনশাআল্লাহ আপনিই আমাদের আগামীর প্রধানমন্ত্রী।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ , বগুড়া
