
বর্তমান সমাজে জাকাতের নামে যা চলছে তা নিছক নোংরামী আর ভণ্ডামী ছাড়া কিছুই নয়। ধনী সমাজের অদ্ভুত, ঘৃণ্য, ভয়ঙ্কর এবং প্রতারণার নাম এখন জাকাত। দেশে গত ৪০ বছরে জাকাত নিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে নিহত হয়েছেন প্রায় ৩০০ মানুষ। আহত হয়েছেন হাজার হাজার। এদের মধ্যে রয়েছেন অসংখ্য নারী ও শিশু।
জাকাত নিয়ে চিন্তা করতে গেলেই ছোটবেলার চিরচেনা কিছু দৃশ্যপট চোখের সামনে ভেসে ওঠে। রোজার ঈদ এগিয়ে আসলেই দেখতাম গ্রামের গরিব মহিলাগুলো ১৫০ থেকে ২০০ টাকা দামের একটি শাড়ির জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করছে। কারো ভাগ্যে জুটত, কারো জুটত না। শাড়িটি পরে রাস্তায় বের হলেই যে কেউ বলে দিতে পারতো- এটা জাকাতের কাপড়। ওই মহিলার দিকে তাকিয়ে সবাই এক ধরনের উপহাসের ইঙ্গিত করতো। জাকাতের নাম করে ২০০ টাকার একটি কাপড় দিয়ে সারাজীবনের জন্য একজন মায়ের শরীরে এঁকে দেয়া হতো বিদ্রূপের চিহ্ন। সারাদিন রোজা রেখে ৫০ টাকার একটি নোটের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে কেউ পেয়েছে, কেউ পায়নি। এক রঙের শাড়ি, ৫০-১০০ টাকার নোট দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে বিদায় করা। এ কোন ইসলাম? ইসলামের কোথায় লেখা আছে এই জাকাত পদ্ধতির কথা? ইসলাম তো বলে, ডানে হাতে দান করলে বাম হাত যেন না জানে।
জাকাত নিয়ে তো গরিবের দরজায় হাজির হবেন ধনী। ধনীর দুয়ারে গরিব কেন? আমাদের সমাজের উচ্চবিত্তদের ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নিজেকে জাহির করা উন্মাদ এক খেলার নাম এখন জাকাত। কারো কারো তো নির্বাচনী প্রচারণাও বটে।
সবচেয়ে অবাক লাগে, যখন দেখি কোনো শপিং মলের শোরুমে লেখা থাকে এখানে ‘জাকাতের কাপড় পাওয়া যায়’। একজন সম্পদশালীর যে পরিমাণ জাকাত আসে, তা পুরোপুরি অনেকেই দেয় না। আবার যতটুটু দেয়া হয়, তা সঠিকভাবে দেয়া হয় না।
ইসলামের ৫টি মৌলিক বিষয়ের একটি জাকাত। জাকাত নিয়ে পড়াশুনা করে যতটুকু দেখেছি, বিধান হলো- যাকে জাকাত দেয়া হয় ভবিষ্যতে যাতে আর জাকাত নিতে না হয়, এরকম ব্যবস্থা করে দেয়া । যেমন এমন কিছু দেয়া যা দ্বারা সে আয় করে জীবিকা অর্জন করতে পারে । রিকশা, ভ্যান, অটোগাড়ি, গরু, ছাগল, হাঁস-মুররির খামার ইত্যাদি জাকাত হিসেবে প্রদান করা যেতে পারে, যাতে তার আর্থিক সচ্ছলতা আসে । কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, প্রতি বছরই ঘুরেফিরে জাকাতের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন ওই একই মানুষগুলো এবং তাদের অভাব-অনটনের কোনো পরিবর্তন হয় না। গত বছর যে জাকাত নিয়েছিল, তাকে যদি এ বছরও যাকাত নিতে হয়, তাহলে এ জাকাত দেয়া একেবারেই অনর্থক।
সাহাবীরা এমন পরিমাণে জাকাত দিতেন পরিবর্তীতে সে লোকের আর জাকাত নেয়ার প্রয়োজন হতো না। খলিফা হযরত উমার (রা.) এর আমলে জাকাত বা অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এত সুন্দরভবে রূপায়িত হয়েছিল যে, একটা সময়ের পরে সারাদিন ঘুরেও জাকাত নেয়ার মতো কাউকে খুঁজে পাওয়া যেত না। লোক না পেয়ে শেষে আফ্রিকা মহাদেশে গিয়ে জাকাত বণ্টনের আদেশ দিয়েছিলেন ওমর (রা.)।
অর্থনীতিবিদরা বলে থাকেন, দেশের ৯০ ভাগ টাকা ১০ ভাগ মানুষের হাতে। বাকি ১০ ভাগ টাকার মালিক বাকি ৯০ ভাগ মানুষ। পুঁজিবাদের এই খড়গ থেকে সভ্যতাকে মুক্ত করতে পারে একমাত্র জাকাত। সেজন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় জাকাত নীতি প্রণয়ন।
অবশ্য আমরা সবকিছুকে যত সহজে চিন্তা করি, ততও কিন্তু সহজনা পৃথিবীর সব মতবাদের পেছনে একটা বড় দর্শন কাজ করে। পুঁজিবাদেরও দর্শন রয়েছে। জাকাতের নামে ভণ্ডামী করা কিংবা যাকাত ব্যবস্থাকে সঠিক জায়গায় যেতে না দেয়া তাদের দর্শন। পুঁজিবাদি সমাজের দুশ্চিন্তার কারণ জাকাত। সঠিক পরিমানে সঠিকভাবে জাকাত প্রদান করলে, স্বাবলম্বী হয়ে উঠবেন নিম্নআয়ের মানুষেরা। তখন আর এত সস্তায় শ্রম কিনতে পারবেন না পুঁজিপতিরা। জাকাতের নামে গরিবকে পদদলিত করে রাখা কিংবা স্বাবলম্বী হতে না দেয়াই পুঁজিবাদী দর্শন। এটা আপনি মানেন কিংবা না মানেন।
জাকাত এমন একটি পদ্ধতি, এটা সঠিকভাবে বণ্টন করলে কয়েক বছরের মধ্যে দেশে সত্যি কোনো হতদরিদ্র মানুষ থাকবে না। প্রকৃত অর্থে দেশ পরিণত হবে উন্নত রাষ্ট্রে। ইসলাম বলে, জাকাত হলো ধনীদের সম্পদের ওপর গরিবের হক। গরিবের প্রতি জাকাত কোন দয়া কিংবা করুণা নয়।
কারণ কোনো ধনী নিজে নিজে টাকার মালিক হতে পারেননি। গরিবের শ্রম আর ঘামের ওপর ভর করেই তিনি সম্পদশালী। আর জাকাত যেহেতু ইসলামেরই একটি বিধান। সুতরাং ইসলামে যেভাবে তার পদ্ধতি নির্দেশ করা আছে, সেভাবেই তা পালন করা উচিত।
এ দুঃসময়ে এমনভাবে জাকাত দিতে হবে, যাতে সত্যি ক্ষুধার কাছে অন্তত মানুষের প্রাণহানি না ঘটে। শুভবুদ্ধির উদয় হোক- এই প্রত্যাশায়।
বেলায়েত হোসাইন
রিপোর্টার