জনপ্রশাসন সংস্কার
‘বিসিএস’ ও ‘বিশেষ বিসিএস’ পার্থক্যটা বুঝতে হবে
মুহম্মদ শামীম কিবরিয়া
প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বিসিএসের বিভিন্ন সার্কুলার পর্যালোচনায় দুই রকমের সার্কুলার দেখা যায়-
১. বিসিএস, যেখানে জেনারেল ও টেকনিক্যাল ক্যাডারের শূন্যপদের সংখ্যা উল্লেখ থাকে। জেনারেল ক্যাডারের শূন্যপদ থাকায় নির্দিষ্ট বয়সসীমা যোগ্যতা থাকা সাপেক্ষে সব ডিসিপ্লিনের গ্র্যাজুয়েটরা এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেন। অর্থাৎ এ ক্যাডারগুলোর পোস্টগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত।
২. বিশেষ বিসিএস, যেখানে মূলত বিশেষ সেক্টরে ওই সেক্টরসংশ্লিষ্ট ডিসিপ্লিনে পড়াশোনা করা এবং দক্ষ কিছু সাবজেক্ট ম্যাটার স্পেশালিস্ট নেওয়ার প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ সাবজেক্ট ম্যাটার স্পেশালিস্ট নিয়োগের উদ্দেশ্যে এ ধরনের বিসিএসের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এ ধরনের বিশেষ বিসিএস পরীক্ষায় শুধু ওই বিষয়ে সেবা দেওয়ার জন্য বিশেষ বিষয়ে পড়াশোনা করা গ্র্যাজুয়েটদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে। সব বিষয়ের গ্র্যাজুয়েটদের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে না। আর যেহেতু তারা যে বিশেষ কাজটির জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন, সে বিষয় নিয়ে ৪-৫ বছর পড়াশোনা করে উত্তীর্ণ হয়েছেন, তাই তাদের আর এ সংক্রান্ত লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয় না। শুধু ১০০/২০০ নম্বরের এমসিকিউ পরীক্ষা দিয়ে ভাইভা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে তাদের দেশের সব সাবজেক্টের গ্র্যাজুয়েটদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয় না, শুধু নিজের সাবজেক্টের গ্র্যাজুয়েটদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়। ফলাফল, এখানে কম প্রতিযোগিতা করে সহজে সাবজেক্ট ম্যাটার স্পেশালিস্ট হিসাবে নিয়োগ পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। একইসঙ্গে তাদের বিশেষ বিষয়ে দক্ষতাকে মূল্যায়ন করে একটি অথবা দুটি ইনক্রিমেন্টসহ বেতন স্কেল শুরু হয়। উদাহরণস্বরূপ, ১২তম বিশেষ বিসিএস; ১৪তম বিশেষ বিসিএস; ১৯তম, ২৬তম, ৩২তম, ৩৯তম এবং ৪২তম বিশেষ বিসিএস।
এখন আসি মূল বিসিএসের আলোচনায়। মূল বিসিএস পরীক্ষায় দুই ধরনের ক্যাডার কর্মকর্তা নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়-১. জেনারেল ক্যাডার (যেখানে সব বিষয়ের গ্র্যাজুয়েটরা অংশগ্রহণের সুযোগ পান) এবং ২. টেকনিক্যাল ক্যাডার (বিশেষ সাবজেক্টের গ্র্যাজুয়েটরা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ সুযোগ পান)।
সবার প্রিলিমিনারি পরীক্ষা একই প্রশ্নে নেওয়া হয়। এ প্রিলিমিনারি পরীক্ষার নম্বর শুধু লিখিত পরীক্ষার্থী নির্বাচনের কাজে ব্যবহৃত হয়; কিন্তু চূড়ান্ত সুপারিশের ক্ষেত্রে এ নম্বর যোগ করা হয় না। যেসব প্রার্থী প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, শুধু তারাই লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান। উল্লেখ্য, আবেদন দাখিলের সময় আবেদনকারী শুধু জেনারেল ক্যাডার বা শুধু টেকনিক্যাল ক্যাডার (সংশ্লিষ্ট বিসিএস সার্কুলার অনুযায়ী যাদের সাবজেক্ট টেকনিক্যাল ক্যাডারের জন্য বিবেচ্য) বা উভয় ক্যাডারের জন্য (যাদের সুযোগ থাকে) পছন্দক্রম দেওয়ার সুযোগ পেয়ে থাকেন। বিসিএসের সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর মেধাক্রমের সঙ্গে এ পছন্দক্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কেউ উভয় ক্যাডারে আবেদন করার পর প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলে তিনি জেনারেল ও টেকনিক্যাল উভয় ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার জন্য জেনারেল ক্যাডারের নির্ধারিত ৯টি বিষয়ে ৯০০ নম্বরের পরীক্ষার সঙ্গে নিজের সাবজেক্টের ২০০ নম্বরের পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পান। ফলে তার টেকনিক্যাল সাবজেক্টে পড়াশোনা করার কারণে কিছুটা অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। কোনো কারণে তিনি জেনারেল ক্যাডারের জন্য নির্ধারিত লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারলেও নিজের সাবজেক্টের ২০০ নম্বরের পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ পান। কেউ কেউ জেনারেল ক্যাডারের জন্য নির্ধারিত ৯টি বিষয়ে উত্তীর্ণের পাশাপাশি নিজ সাবজেক্টের ২০০ নম্বরের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উভয় ক্যাডারে ভাইভা দেওয়ার সুযোগ পান।
এরপর ভাইভা শেষ হলে চূড়ান্ত মেধা তালিকা প্রস্তুত করা হয়। দুটি মেধা তালিকা হয়-১. যারা শুধু জেনারেল ক্যাডারে লিখিত পরীক্ষা দিয়েছেন এবং যারা উভয় ক্যাডারে লিখিত পরীক্ষা দিয়ে জেনারেল ক্যাডারের জন্য নির্ধারিত ৯০০ নম্বরের মধ্যে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ এবং ভাইভায় ৪০ শতাংশ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হন, তাদের সম্মিলিত মেধা তালিকা প্রস্তুত করা হয়। এক্ষেত্রে টেকনিক্যাল ক্যাডারে লিখিত পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত ২০০ নম্বরের ভেতর প্রাপ্ত নম্বর বিবেচনায় আসে না। ২. যারা উভয় ক্যাডারে লিখিত পরীক্ষা দিয়ে জেনারেল ক্যাডারের ২০০ নম্বর বাদ দিয়ে টেকনিক্যাল বিষয়ে ২০০ নম্বরের ভেতর প্রাপ্ত নম্বরসহ উত্তীর্ণ এবং যারা শুধু টেকনিক্যাল ক্যাডারের জন্য নির্ধারিত লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, তাদের সাবজেক্টিভ মেধা তালিকা প্রস্তুত করা হয়। এক্ষেত্রে ২০০ নম্বরের পরীক্ষা ভিন্ন ভিন্ন সাবজেক্টভিত্তিক হওয়ায় সম্মিলিত মেধা তালিকা করার সুযোগ থাকে না।
এ দুটি মেধা তালিকার প্রথমটি থেকে মেধা স্থান এবং তার ক্যাডার পছন্দক্রম অনুযায়ী নির্ধারিত হয় তিনি কোন জেনারেল ক্যাডারে (পররাষ্ট্র, প্রশাসন, পুলিশ, কাস্টমস, অডিট, ট্যাক্স, খাদ্য, ডাক, তথ্য ইত্যাদি) সুপারিশপ্রাপ্ত হবেন। আর দ্বিতীয় মেধা তালিকা অর্থাৎ সাবজেক্টিভ মেধা তালিকা থেকে নির্ধারিত হয় তিনি আসলে তার সাবজেক্টের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ক্যাডারে সুনির্দিষ্ট পদ বা পদগুলোর কোনটিতে সুপারিশপ্রাপ্ত হবেন। পদগুলো বললাম এজন্য যে, অনেক সময় দেখা যায় কারও সাবজেক্ট একটি, কিন্তু একাধিক টেকনিক্যাল ক্যাডারের শর্ত পূরণ করেন। কেউ কেউ আছেন, উভয় মেধা তালিকায় থেকে উভয় জায়গায় ক্যাডার পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন। তাদের ক্ষেত্রে ওই প্রার্থীর বিসিএস পরীক্ষার আবেদনের সময় দাখিলকৃত ক্যাডার পছন্দক্রম বিবেচনায় আসবে।
একটা উদাহরণ দেই। ধরুন জনাব মুমিনুল ইসলাম জেনারেল ক্যাডারের জন্য সম্মিলিত মেধা তালিকায় ৩৯২তম এবং নিজ সাবজেক্ট কৃষি বিষয়ে যারা পরীক্ষা দিয়েছিলেন, সেই সাবজেক্টিভ মেধা তালিকায় ১৭তম হয়েছেন। এরপর দেখা হবে তিনি আসলে মেধাক্রম অনুযায়ী তার চয়েস লিস্টের সর্বোচ্চ উপরের কোন ক্যাডারটির জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হতে পারেন। দেখা গেল তিনি সম্মিলিত মেধায় কোনো জেনারেল ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হতে পারছেন না; কিন্তু চয়েস লিস্টে ১৩ নম্বরে থাকা বিসিএস (কৃষি) ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হতে পারেন। এ কৃষি ক্যাডারে তার মেধাক্রম নির্ধারিত হবে সাবজেক্টিভ মেধায় ১-১৬ পর্যন্ত যারা আছেন, তাদের কতজন আসলে কৃষি ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হচ্ছেন, তার ওপর। এমনও হতে পারত, জনাব মুমিন সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১২তম হয়েছেন, পররাষ্ট্র ক্যাডার পাওয়ার যোগ্য; কিন্তু চয়েস লিস্টে প্রথম পছন্দ বিসিএস কৃষি ক্যাডার থাকার কারণে তিনি কৃষি ক্যাডারেই বিবেচিত হবেন।
এ আলোচনা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট-দুই ধরনের ক্যাডারের পরীক্ষা এক নয় এবং অভিন্ন মেধা তালিকাও প্রস্তুত করার সুযোগ নেই। কারণ পরীক্ষার কিছু বিষয় আলাদা। অভিন্ন মেধা তালিকা শুধু যারা জেনারেল ক্যাডারের সব বিষয়ে লিখিত পরীক্ষা দিয়ে সব স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছেন, তাদের প্রস্তুত করা সম্ভব হয় এবং শুধু তাদের ক্ষেত্রেই সম্মিলিত মেধা তালিকা প্রস্তুত করা হয়।
সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, যারা বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে বিশেষ কাজের জন্য নিয়োজিত হয়েছেন, তাদের কোনোভাবেই ডিএস পুলে আসার সুযোগ নেই। কারণ তারা ‘বিসিএস’ পরীক্ষা দেননি, যেটা দিয়েছেন সেটা ‘বিশেষ বিসিএস’ নামক এমসিকিউ পরীক্ষা, যা কোনোভাবেই বিসিএস পরীক্ষার সমতুল্য নয়। দ্বিতীয়ত, যারা মূল বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছিলেন, কিন্তু জেনারেল ক্যাডারের জন্য নির্ধারিত লিখিত পরীক্ষা উত্তীর্ণ হতে পারেননি বা লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও জেনারেল ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হতে পারেননি, তাই সম্মিলিত মেধা তালিকায় নিজের কোনো অবস্থান নেই, তাদেরও ডিএস পুলের মাধ্যমে উপসচিব হওয়ার সুযোগ নেই।
কৃষিবিদ মুহম্মদ শামীম কিবরিয়া : সিনিয়র সহকারী সচিব
