Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

লাল সালাম নোমান ভাই

Icon

চিন্ময় মুৎসুদ্দী

প্রকাশ: ০৬ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

লাল সালাম নোমান ভাই

১৯৬৮ সালে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম জেলা ও শহর শাখার সম্মেলনের কয়েকদিন আগে হাজারি লেনে ছাত্র ইউনিয়নের অফিসে গেলে দেখা হতেই নোমান ভাই আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘তোমাকে শহর শাখার ক্রীড়া সম্পাদকের দায়িত্ব দিলাম।’ আমি একটু অবাক হলেও খুশি হলাম। তখনো এসএসসির ফলাফল প্রকাশিত হয়নি। নবম শ্রেণি থেকেই ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হই। বড়বোন অঞ্জনা মুৎসুদ্দী চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের সংগঠন ইউনাইটেড পিপল্স পার্টির (ইউএসপিপি) অন্যতম নেত্রী। তার মাধ্যমেই ছাত্র ইউনিয়নের কয়েকটি সমাবেশে গেছি। সেখানেই নোমান ভাইয়ের সঙ্গে পরিচিত হই। ক্রমে পরিচিত হই ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আবুল কাশেম, জঙ্গি ভাই, হায়াৎ হোসেন, হুমায়ুন কবীর সেলিম, দিলীপ সুর, সৈয়দ শফিকউদ্দীন আহমেদ, হামিদ রেজা খান, গোলাম মহিউদ্দীন খান, জাহিদুল করিম কচি, মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর প্রমুখের সঙ্গে। ভাসানী ন্যাপ, শ্রমিক ফেডারেশন ও কৃষক সমিতির অফিসও ছিল একই ভবনের দোতলায়। হাজারি লেনের এ এলাকাটি সব সময় গমগম করত মানুষের আনাগোনায়। আমরাও মিছিল করে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে যাওয়ার আগে এখানে সড়কেই সমবেত হতাম। সবার মাথায় বা বাহুতে অধিকাংশ সময় থাকত লালপট্টি।

নোমান ভাই ছিলেন সার্বক্ষণিক ব্যস্ত। হালকা গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি গায়ে সদা হাসিমুখে বড় বড় চোখের চাহনিতে বিনয়ী আর নম্রসুরে সবার সঙ্গে কথা বলতেন, কুশল জানতে চাইতেন, কাজ ভাগ করে দিতেন এবং নির্দেশ দিতেন। এ সময় মিছিলে নানা স্লোগানের সঙ্গে ‘কমরেড’ এবং ‘লাল সালাম’ শব্দগুলো ছিল আমাদের খুব প্রিয়। সিনিয়র নেতাদের আমরা বলতাম ‘কমরেড লাল সালাম’। লাল রং বিপ্লবের প্রতীক। আমরা কমিউনিস্ট বিশ্বের ভাগাভাগিতে চীনের দিকেই সমর্থনের পাল্লা ভারী করি। মাও সেতুং, চৌ এন লাই, মার্শাল চেন ই, আর লিউ শাও চি আমাদের প্রিয় নাম হয়ে ওঠে। নোমান ভাই বলতেন, ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে আমরা ছাত্রছাত্রীদের লাল বিশ্ব গড়ার সৈনিক হিসাবে গড়ে তোলার শপথ নিয়েছি। কিন্তু প্রথমে আমাদের শৃঙ্খলা আর নৈতিকতা শিখতে হবে। আর যে যেখানে আছি, ক্লাসের পড়াটা সাফল্যের সঙ্গে পার করতে হবে।

ষাটের দশকের শুরুতে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি যোগ দেন ছাত্র ইউনিয়নে। ক্রমে ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম মহানগরীর সাধারণ সম্পাদক, বৃহত্তর চট্টগ্রামের সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

ছাত্রজীবন শেষে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর হাত ধরে যোগ দেন শ্রমিক রাজনীতিতে। পূর্ববাংলা শ্রমিক ফেডারেশনের সহসভাপতি ছিলেন। ভাসানীপন্থি ন্যাপের রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত হন। ১৯৭০ সালে তাকে ন্যাপের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। যুদ্ধশেষে আবারও ন্যাপের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন। জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠনের পর ১৯৮১ সালে যোগ দেন দলটিতে।

১৯৬৮ সালের মে মাসে মওলানা ভাসানীর সফরসূচি নির্ধারিত হলো চট্টগ্রামে, লালদীঘি ময়দানে জনসভার আয়োজন চলছে। নোমান ভাই খুবই ব্যস্ত। ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক সবাইকে হাজির করতে হবে জনসভায়। হাজারি লেনের কার্যালয়ে সারাক্ষণ ভিড় লেগেই আছে। আমরা প্রায় প্রতিদিনই হাজিরা দিচ্ছি। নোমান ভাই কাজের অগ্রগতি জানাচ্ছেন। আমাদের যার যার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছেন। সভাশেষে মিছিল বের হলো। দীর্ঘ এ মিছিলে আমরা শামিল হলাম।

তিন দিন পর মওলানা চলে যাবেন। তার একজন ব্যক্তিগত সহকারীর প্রয়োজন। ন্যাপ নেতারা আলোচনা করেই এ সিদ্ধান্ত নিলেন। ঠিক হলো ন্যাপকর্মী বজল আহমেদ এ দায়িত্ব নেবেন। তিনি তখন স্কুলে শিক্ষকতা করতেন (পরে বাসসে সাংবাদিক)। চাকরিক্ষেত্রে কিছু আনুষ্ঠানিকতার জন্য তিনি তখনই মওলানার সঙ্গী হতে পারছিলেন না। এই অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য ব্যক্তিগত সহকারীর দায়িত্ব পালনের জন্য আমি রাজি হলাম। কিন্তু সদ্য স্কুলের সীমানা পার হওয়া এক তরুণের ওপর ভরসা করতে পারছিলেন না অনেকে। ন্যাপ নেতা শরদিন্দু দস্তিদার তো হাসতে হাসতে বলেই ফেললেন, ‘ওকে পাঠিয়ে লাভ কী, অর্ধেক পথ থেকেই ও পালাবে।’ শরদিন্দুদার কথা ঠিক হয়নি। আমি বেশ কিছুটা সময় এ দায়িত্ব পালন করেছিলাম। নোমান ভাই এ সময়টায় আমাকে অনেক পরামর্শ দিয়েছিলেন। কী কী সমস্যা হতে পারে সেটাও বলেছিলেন। একই সঙ্গে সাহস দিয়ে বলেছিলেন, ‘এই সময়টা তোমার জীবনে স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে।’

নোমান ভাই আজীবন রাজনীতির সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন। ভাসানী ন্যাপ আর শ্রমিক ফেডারেশনের অধ্যায়ের ইতি টেনে তিনি যোগ দেন বিএনপিতে। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে তিনি বিএনপির পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে জনতাকে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগঠিত করেছেন। তিনি প্রথম দফায় প্রতিমন্ত্রী হলেন খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায়। পরে হলেন মন্ত্রী। প্রথম জাতীয় সংসদ সদস্য হয়েছিলেন ১৯৯১ সালে। ২০০১ সালেও তিনি খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায় সদস্য ছিলেন।

তিনি মন্ত্রী হওয়ার পরও দেখা হয়েছে মাঝে মাঝে। বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে মিন্টু রোডের বাসায় আমন্ত্রণ জানাতেন। সেখানে এবং সচিবালয়ে তার দপ্তরে দেখা হলে আগের মতোই আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলতেন। সবার কথা জিজ্ঞেস করতেন। আমাদের আমন্ত্রণে মন্ত্রী থাকা অবস্থায় আমাদের বাসায় এসেছেন, গল্প করে সময় কাটিয়েছেন। কোনোরকম অহংকারী মনোভাব দেখিনি কখনো। কাছের মানুষদের কেউ কথা দিয়ে কথা না রাখলে বিরক্ত হতেন, কিন্তু কোনো উষ্মা প্রকাশ করতেন না, বলতেন, ‘দেখো তো কী করি, এ জন্য আমি মহাসমস্যায় পড়ব।’ ফোন করতেন বা কাউকে পাঠাতেন কাজটা দ্রুত শেষ করার জন্য।

ফেসবুকে তাকে নিয়ে কয়েকটা স্ট্যাটাস চোখে পড়েছে। সংবাদপত্রেও কয়েকজন লিখেছেন তার কথা। এরই মধ্যে বিএনপির উদ্যোগে মিলাদ মাহফিল হয়েছে, শোকসভা হয়েছে। ঢাকায় জাতীয় পর্যায়ে একটি স্মৃতিসভার আয়োজন হবে আশা করছি। চট্টগ্রাম কলেজের সাবেক ছাত্র হামিদ রেজা খান এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, আব্দুল্লাহ আল নোমান ছিলেন একজন পরিশীলিত মার্জিত চিন্তাশীল রাজনীতিবিদ। আর যারা রাজনৈতিক অঙ্গনের সীমা পেরিয়ে ব্যক্তি নোমানের সান্নিধ্য ও সাহচর্য উপভোগের সুযোগ পেয়েছেন, তারা জানেন যে আব্দুল্লাহ আল নোমান একজন অতীব ভালো মানুষ ছিলেন। আমার সৌভাগ্য, আমি তাদের মধ্যে একজন, যে তার স্নেহধন্য হতে পেরেছিলাম। নোমান ভাইয়ের অভাব পূরণীয় হওয়ার নয়।

দীর্ঘদিন তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। অসুস্থতার সংবাদ শুনে নিজের শারীরিক নানাবিধ অসুবিধার কারণে তাকে আর দেখতে যাওয়া হয়নি। তাই সেই অর্থে কোনো বিদায় জানাইনি তাকে। তার কাছ থেকেও বিদায় নেওয়া হয়নি। একদিক থেকে ভালো হয়েছে। তিনি আমার কাছে এখনো চলমান ব্যক্তি। তিনি মৃত এমন কোনো দৃশ্য আমার চোখে ভাসে না। তার সেই বড় বড় চোখ আর হাসিমাখা মুখ এখনো আমার কাছে উজ্জ্বল হয়ে আছে, থাকবে আগামীতেও। তিনি তো আছেন আমাদের মাঝে। সাধারণ মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য যখন নতুন প্রজন্ম মিছিল নিয়ে রাজপথ প্রকম্পিত করে, তখন সেখানেই দেখি নোমান ভাই আছেন। তাই ১৯৬৮ সালের মতো আবার বলি, নোমান ভাই লাল সালাম।

চিন্ময় মুৎসুদ্দী : সিনিয়র সাংবাদিক

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম