Logo
Logo
×

বাতায়ন

আমাদের শক্তিশালী প্রতিরক্ষা প্রয়োজন

Icon

ড. মাহবুব হাসান

প্রকাশ: ০৪ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আমাদের শক্তিশালী প্রতিরক্ষা প্রয়োজন

আমাদের ছোট দেশ, তাই এর আবার ভূরাজনৈতিক অবস্থান কী-এরকম একটি ধারণা বিদ্বৎসমাজে চালু আছে। ফলে সেই শিক্ষিত, প্রগতিশীল মনে ও মননে কখনোই একথা জাগেনি যে, আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি অবহেলিত হচ্ছে। নিরাপত্তা বলতে তারা মনে করেন, প্রতিবেশী ভারতের মতো একটি দেশের সঙ্গে আমাদের পেরে ওঠা সম্ভব নয়। এ মানসিকতাই মূলত আমাদের হীনবল করে রেখেছে বলে আমার মনে হয়। আমরা সামরিক শক্তিতে দুর্বল বলে কোনো বৈদেশিক আক্রমণ থেকে নিজেদের জনগণ ও সম্পদের নিরাপত্তা দিতে পারব না। এ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই আমাদের প্রধান শত্রু।

১.০

আমাদের মন ও মানসিকতাকে শাসন করছে ঔপনিবেশিক শিক্ষা ও তাদের চাপিয়ে দেওয়া সাংস্কৃতিক আধিপত্য। আমরা চিন্তাক্ষেত্রে যেমন পরাধীন, তেমনি সেই পরাধীনতার শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টাও প্রায় নেই বললেই হয়। কিন্তু তারপরও সমাজের কিছু মানুষ তো নতুন কিছু চিন্তা করে। দেশের কৌশলগত সম্পর্ক ও ভূরাজনৈতিক অবস্থানের ব্যাপারে চিন্তা করে। কী করে দেশের সম্পদ নিরাপদ ও রক্ষা করা যায়, কী করে দেশের সম্পদ জনগণের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নে কাজে লাগিয়ে সামগ্রিক পরিস্থিতি বদলে দেওয়া যায়, সেই চিন্তাও তো করে। এই শ্রেণির মধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আমরা দেখতে পাই মহাসমুদ্রের মধ্যে ভাসমান শৈলখণ্ডের শিখর হিসাবে। তলে যে বিপুল অংশ, যাদেরকে জনগণের সঙ্গে চিহ্নিত করলে তা শ্রেয়তরই হবে।

১.১

আমরা চিন্তাশীল জাতি নই। আমাদের প্রধান শক্তি রাজনৈতিক আবেগ। আমাদের প্রধান শত্রুও রাজনৈতিক আবেগ। এ রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আবেগের ঘাড়ে চেপে আমরা চলেছি ৭৭ বছর (পাকিস্তানি ২৩ বছরসহ) ধরে। এ আবেগেরই প্রাধান্য রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে একটি সংহত অবস্থানে পৌঁছাতে দেয়নি। গত ৫৪ বছরে স্বাধীনতার সূর্য উদিত থাকলেও সেই সার্বিক বিষয়টিকে আমরা কেবল বাউন্ডারি স্বাধীনতা দিয়ে মুড়েছি। বিগত ৫৪ বছরের মধ্যে মাত্র একবার রাষ্ট্রপতি শহিদ জিয়াউর রহমানের সময় দেখেছি। দ্বিতীয়বার দেখেছি বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে, সামান্য একটু। তার পূর্বমুখী দৃষ্টিভঙ্গি পররাষ্ট্রনীতির চেতনায় একটি মাইলফলক গেড়েছিল মাত্র। তা নতুন বিন্যাসে সাজানোর সময় তিনি পাননি। তার চিন্তা-চেতনাই আমাদের উদ্দীপিত করেছিল। পরবর্তী সরকারের নতজানু নীতি আমাদের অন্যতম প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

১.২

১৯৭১ সালে আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধে শামিল হই, তখন ভারত ও রাশিয়া বিপুলভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। প্রায় এক কোটি বাংলাদেশিকে জায়গা দিয়ে ভারত আমাদের মাথার টোপর হয়ে যায়। আর রাশিয়ান অস্ত্র আমাদের স্ট্রাইকিং সামরিক শক্তি হিসাবে সাহস জোগায় মুক্তিযুদ্ধের দিন-রাতগুলোতে। কৃতজ্ঞচিত্তে আমরা তা স্মরণ করি এবং তাদের অবদানকে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে স্বীকার করি। কিন্তু বিগত আওয়ামী সরকার সেই অবদানের স্বীকৃতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে। ফলে গত পনেরো বছরে দেশের জনগণ বোঝে যে, তারা একটি নব্য ভারতপন্থি ফ্যাসিস্টের অধীনে ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদী করদের ভূমিকায় পরিণত হয়েছিল। সেই করদের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছে তরুণ শিক্ষিত ছাত্রসমাজ এবং দ্রোহী চেতনার নিপীড়িত-নির্যাতিত, শোষিত মানবসমাজ। তারা কোটা সংস্কারের আন্দোলন দিয়ে হাসিনার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠলেও ধীরে ধীরে সেই আন্দোলন, গণমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ, চূড়ান্ত গণ-অভ্যুত্থানের রূপ নেয়। সেই উত্তাল গণসুনামির তোড়ে হাসিনা পালিয়ে যান ভারতে এবং সেখানে আশ্রয় পান। এর ভেতর দিয়ে এটাই প্রমাণ হয় যে, তিনি ছিলেন দিল্লির শাসনাধীন এক করদ শাসক।

১.৩

কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মনে ও মননে নেই নতুন চিন্তার স্ফুরণ। তাই তাদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভেদ ও রাজনৈতিক কেওয়াস আমরা লক্ষ করছি। সেই ধারাবাহিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আওয়ামী লীগ সরকার যোগ করে গুম-খুনের ভীতি আর লুটেপুটে দেশকে রিক্ত করার এক আত্মধ্বংসী প্রবণতা, যা অতীতের শাসকদের মধ্যে ছিল না। তাদের মধ্যে ভুলভ্রান্তি ছিল, চিন্তাভাবনায় সীমাবদ্ধতা ছিল, কিন্তু মানুষকে হত্যা করে, গুম-খুন করে ভীতির সাম্রাজ্য কায়েমের প্রবণতা ছিল না। দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থ আর প্রচলিত রাজনৈতিক ধ্যানের বাইরে তারা ছিলেন অনড় প্রতিভাবান। একমাত্র ব্যতিক্রম বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি দেড় বছর আগে, কিংবা তারও আগে ৩১ দফা ঘোষণা করেন। সেই ৩১ দফা রাষ্ট্রযন্ত্র সংস্কারসহ এমন কিছু বিষয়ে, যা প্রকৃত অর্থেই জনগণের মৌলিক আশার প্রতিফলন। এ দলের ভেতরে কিছু চিন্তাশীল মানুষ আছেন, যারা পরিবর্তন ও সংস্কার চান, কিন্তু তাতে রয়েছে তাদেরই গোষ্ঠীস্বার্থ ও প্রচলিত ধ্যান-ধারণা। এই বাধা থেকে বিএনপিকে বেরিয়ে আসতে হবে।

২.০

এবার আসা যাক কৌশলগত ভূরাজনৈতিক অবস্থান এবং কূটনৈতিক কৌশলের বিষয়ে। এর প্রধান বিষয় হচ্ছে দেশের মানুষের নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও সম্পদ রক্ষা ও তার নিরাপত্তা বা নিরাপদ রাখার উদ্যোগ আয়োজন। সম্প্রতি ঢাকায় একটি চিন্তক প্রতিষ্ঠান তাদের কার্র্যক্রম পরিচালনার এক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকাশ্যে এসেছে। ফাউন্ডেশন ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ডেভেলপডমেন্ট স্টাডিজ (এফএসডিএস) নামের এ প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসেছিলেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, সাবেক সেনাপ্রধান নূরউদ্দিন খান, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কামরুল আহসান, বিমানবাহিনী প্রধান হাসান মাহমুদ খান, নৌবাহিনী প্রধান নাজমুল হাসান প্রমুখ। সেনাপ্রধান তার বক্তৃতায় বলেছেন, শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে কোন কোন ক্ষেত্রে জোর দেওয়া উচিত, তা গবেষণার মাধ্যমে বের করতে হবে। একইসঙ্গে খাদ্য, পানি, জ্বালানি নিরাপত্তাসহ সব ক্ষেত্রেই গবেষণার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন তিনি। এফএসডিএস প্রতিষ্ঠাকে সময়োপযোগী উদ্যোগ হিসাবে বর্ণনা করেন সেনাপ্রধান। তিনি বলেন, সুশাসন, টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জাতীয় সংহতির জন্য গবেষণাভিত্তিক নীতিকাঠামো দরকার। কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে নতুন এ প্রতিষ্ঠানকে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন সেনাপ্রধান।

২.১

অনুষ্ঠানে এফএসডিএসের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর বলেন, তাদের এ প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য হলো জাতীয় সংহতি ও অগ্রগতির স্বার্থে সবার মধ্যে সহযোগিতা ও সংযোগ বৃদ্ধি করা। তিনি বলেন, একই লক্ষ্য নিয়ে দেশে আরও কিছু চিন্তন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে এফএসডিএসের মূল দৃষ্টিভঙ্গি জাতীয় চেতনার মশাল প্রজ্বলিত করে-‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ নীতি অবলম্বন। এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান মনোযোগ থাকবে জাতীয় নিরাপত্তা, বেসামরিক ও সামরিক খাতের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি ভারসাম্যময় পররাষ্ট্রনীতি বজায় রাখতে সহযোগিতা করা।’ (প্রথম আলো, ২৪.০২.২৫)

জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. কামরুল আহসান বলেছেন, ‘আমি একটি উদাহরণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করছি, যাতে আমরা ইতিহাসের একটি বিশেষ বিষয়ের মাধ্যমে এটা আরও ভালোভাবে বুঝতে পারি। আমার মনে আছে, ১৯৭৮ থেকে ৮১ সালের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আমরা যদি তৎকালীন নীতিমালা পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাব, পররাষ্ট্রনীতি ছিল মূলত একটি শিল্পকর্ম। আমি ডেভিড ফ্রস্টের একটি উক্তি উল্লেখ করছি। তিনি বলেছিলেন, কূটনীতি হলো অন্য কাউকে আপনার পথে নিয়ে আসার শিল্প। আমার শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কথা মনে পড়ছে। তিনি মানুষকে কিভাবে তার কাছে টানতেন এবং তার গন্তব্যে নিয়ে যেতেন।... তিনি প্রতিবেশী দেশ ও বাংলাদেশের মধ্যে কিছু নিরাপত্তা সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমাদের নিশ্চয়ই মোরারজি দেশাইয়ের কথা মনে আছে। দুই রাষ্ট্রপতি মিলে গঙ্গা নদীর পানি সমস্যার সমাধান করতে পেরেছিলেন। আমরা মনে করি বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রতিবেশী দেশের মধ্যে রাজনৈতিক ও ভালো প্রযুক্তিগত সম্পর্ক থাকা জরুরি।’

এফএসডিএস প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আকবর এলাহী বলেন, ‘জাতীয় নিরাপত্তায় বেসামরিক ও সামরিক খাতের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি নির্মাণে যে সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে, তাকে স্বাগত জানাই।’

অন্যান্য আলোচকের মধ্যে অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেছেন, শুল্ক বাধা আরোপের নীতিগুলো আমার মনে হয় বিশ্বায়নের জন্য খুবই ক্ষতিকর। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেছেন, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ আসলে একটি অত্যন্ত ঐতিহাসিক এবং সমালোচনামূলক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. বোরহানউদ্দিন খান বলেছেন, জুলাই বিদ্রোহের অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করে আন্তরিকভাবে আশা করি এফএসডিএস বিভিন্ন শাখার মেধাবী মননকে একত্রিত করবে।

উল্লিখিত প্রাজ্ঞজনদের বক্তব্য থেকে যে আশার স্ফুরণ এসেছে, তার কেন্দ্রে রয়েছে ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ চেতনা। আমরা তো বাংলাদেশকেই সমৃদ্ধির শিখরে নিয়ে যেতে চাই।

২.২

আমাদের ব্লু রিসোর্স ইকোনমিক এরিয়ার নাম বে অব বেঙ্গল বা বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগরে কী পরিমাণ সম্পদ আছে, তা আমরা জানি না। বঙ্গোপসাগরের সম্পদ নিয়ে গবেষণা হয়েছে বলে মনে পড়ে না। স্বাধীনতার পর রাশিয়ার একটি গবেষক দল বঙ্গোপসাগরে খনিজসম্পদ বিষয়ে অনুসন্ধানের কাজ করেছিল। সেই সময় তারা জানিয়েছিল, বহু তেল ও গ্যাসের সন্ধান তারা পেয়েছে। কিন্তু তৎকালীন সরকার সে ব্যাপারে উৎসাহ দেখায়নি। পরে সেই রাশিয়ান গবেষক দলটি ফিরে যায়। ওই সময়ের সংবাদপত্রে এ সংক্রান্ত কিছু তথ্য পাওয়া দুষ্কর হবে না।

এর বাইরে, বঙ্গোপসাগরের খনিজসম্পদ নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা ও তৎপরতা আমরা দেখিনি। বেগম খালেদা জিয়ার সময় ওইসব এলাকার সম্পদ আহরণের জন্য বিভিন্ন দেশের তেল-গ্যাস উত্তোলনকারী কয়েকটি কোম্পানিকে ব্লক চিহ্নিত করে লিজ দেওয়া হয়। তারা কাজ চালাতে থাকলেও ওই সাগরের সম্পদ ব্যবহারের উল্লেখযোগ্য কিছু হয়নি। আজ যে দেশের গ্যাস সংকটের কারণে শিল্প সেক্টর ধুঁকছে, তার জন্য কে বা কারা দায়ী, সেটা আগে দেখতে হবে। পেট্রোবাংলার প্রতিষ্ঠান বাপেক্স বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্রে কূপ খনন করে সম্পদের সন্ধান পেলেও বিগত সরকার সেই আবিষ্কারকে উত্তোলনের দোরগোড়ায় নিয়ে আসেনি। বরং বিগত সরকার ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে ছিল উদগ্রভাবে আগ্রহী। এর পেছনে যে ছিল দুর্নীতি, তা বোঝার জন্য খোলাদৃষ্টিই যথেষ্ট। ফ্যাসিস্ট হাসিনার মানি লন্ডারিংয়ের বিভিন্ন অপতৎপরতার এটিও একটি নালা। এই পথে যে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে, তা দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসবেই।

২.৩

আমরা এতকাল কেবল ইলিশের গল্পই শুনে এসেছি। সাগরের মিনারেলসের সংবাদ তেমন একটা পাই না। ইলিশ আমাদের মৎস্য ইকোনমির একটি সোনার খনি, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু নেই খনিজ সম্পদ আহরণে ইতিবাচক তৎপরতা। ইলিশের প্রজনন ও বৃদ্ধির পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমাদের সরকারি কার্যক্রম তেমন একটা সচল ছিল না। আজও সেই বিষয়ে নতুন গবেষণার ভেতর দিয়ে একে বড় অর্থনৈতিক উৎস করে তোলা হয়নি। কেন হয়নি বা হচ্ছে না, সরকার এবং বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে এর প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করতে হবে। আমরা লক্ষ করেছি, প্রতিবছরই আমাদের মৎস্যসম্পদ লুটে নিয়ে যায় প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের জেলেরা। বিশেষ করে যে সময় ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ। এবারই প্রথম নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে অবকাশকালের ১৫ দিনের ব্যবধানে ভারতীয় চোরা ট্রলারগুলো ইলিশ ধরে নিয়ে যেতে না পারে। তাদের অবৈধ তপরতা বন্ধ করতে হলে কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর শক্তি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। সমুদ্রসম্পদ ও আমাদের সমুদ্রের নিরাপত্তা বিধান, নৌপথের বাণিজ্যিক সুযোগ সৃষ্টি এবং একে ইন্দো-প্যাসিফিকের নৌ-রুটের একটি বহুমুখী উৎসের কথা বিবেচনা করে সেই সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের তলদেশে কী পরিমাণ খনিজ সম্পদ আছে তা নিরীক্ষা করা খুবই জরুরি। আবার এটাও মনে রাখতে হবে, কৌশলগত দিক থেকে বঙ্গোপসাগর বিশ্ব নৌবাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাব হয়ে উঠতে পারে, যদি সময়মতো আমরা প্রস্তুত হই। মনে রাখতে বলি, দক্ষিণ এশিয়া ও ইন্দো-প্যাসিফিক সামদ্রিক অঞ্চলের নৌবাণিজ্যের সহজ ও সুন্দর একটি পথ হতে পারে বঙ্গোপসাগর। বিশ্ববাণিজ্য অধিপতিদের দৃষ্টি পড়ছে আমাদের এ স্ট্র্যাটেজিক অবস্থানের জন্য। নৌবাণিজ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দক্ষিণ চীন সাগর, যার প্রবেশপথ মালাক্কা প্রণালী হয়ে বাণিজ্য জাহাজগুলো চলাচল করে-সেই বাণিজ্যের পরিমাণ বছরে ৫.৩ ট্রিলিয়ন ডলার। কিন্তু সাংবাৎসরিক গোলমাল লেগে থাকে আমেরিকা ও চীনের মধ্যে, এ সাগরের সম্পদ নিয়ে। সেই সঙ্গে আছে তাইওয়ান সমস্যা, যা মূলত চীনকে যেমন খোঁচায়, তেমনি প্রতিবেশী দেশগুলোকেও। ওই সাগরের ৮০ শতাংশই চীন ব্যবহার করছে। এই বাণিজ্য নৌ-রুটটি বহু বাণিজ্য-অধিপতিরাই এড়াতে চায়। সেক্ষেত্রে বঙ্গোপসাগর হতে পারে তাদের সহজ নৌরুট। এ রুট নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে যদি বঙ্গোপসাগর নিরাপদ করে তোলা যায়। এক্ষেত্রে আমাদের নৌবাহিনী বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। ঠিক এ কথাটিই সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার বলেছেন সুস্পষ্টভাবে। সেটা আজ সরকারকে বুঝতে হবে। আমাদের দুশ মাইল দীর্ঘ সমুদ্রের সামগ্রিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।

মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর সচল হলে সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, আমাদের অর্থনৈতিক সাফল্য আসবেই। আর সামরিক দিকটি যদি বিবেচনায় নেই, তাহলে বিবদমান ভারত ও চীনের মাঝখানে বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে ট্যাগ অব ওয়্যারের মধ্যে শান্তির সেতু নির্মাতা দেশ। আমরা ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতিই কেবল আবাহন করি না, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে শান্তিপূর্ণ ও শক্তিশালী সহাবস্থান। আমরা লাভবান হতে পারি আরও বহু বিষয়ে, যদি দেশের সরকারকে চিন্তক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের গবেষণার মাধ্যমে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারে। জেনারেল ফজলে এলাহী আকবর, সেই সুযোগ সৃষ্টির কথাই বলেছেন। আর জেনারেল ওয়াকার চান এ প্রতিষ্ঠানটি যেন সামরিক বাহিনীকেও সহায়তা করে। ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ যদি হয় চিন্তাগত ক্ষেত্র, তাহলে এফএসডিএস হতে পারে একটি ভারসামপূর্ণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান। আমরা কি এরকম আশা করতে পারি না?

ড. মাহবুব হাসান : গবেষক, কবি ও সাংবাদিক

ড. মাহবুব হাসান জাতীয় নিরাপত্তা

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম