
‘বাংলাদেশ ভালো থাকলে, আমি ভালো থাকি। এ দেশের বাহিরে আমার কোনো ঠিকানা নেই, এ দেশই আমার ঠিকানা।’-খালেদা জিয়া
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা কেবল একটি রাজনৈতিক ঘটনা নয়, এটি ছিল কোটি মানুষের মনে জেগে ওঠা নতুন আশার প্রতীক। বহুদিন ধরে হুইলচেয়ারে আবদ্ধ থাকা এই সংগ্রামী নেত্রী যখন সবাইকে চমকে দিয়ে নিজে হেঁটে ‘ফিরোজা’য় প্রবেশ করেন, তখন শুধু তার পরিবার বা দলের নেতাকর্মী নয়, গোটা দেশ যেন নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে ছিল সেই দৃশ্যের দিকে। পুত্রবধূদের সহায়তায় তার দৃপ্ত পদক্ষেপ যেন একটি অবিচল বার্তা-বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখনো নিভে যায়নি, প্রতিরোধের আগুন এখনো জ্বলছে। এ ঘটনা যেন অবচেতনভাবে জাতিকে স্মরণ করিয়ে দেয়, সত্যিকারের নেতৃত্ব দুর্বল হয় না-অন্তরালে থাকলেও তা জেগে থাকে জনগণের বিশ্বাস ও ভালোবাসায়। খালেদা জিয়ার এই অসাধারণ প্রত্যাবর্তন আজ হতাশার রাজনীতিতে আশার নতুন আলো জ্বালিয়েছে। মানুষের মনে বিশ্বাস জন্মেছে-বাধা যতই আসুক, প্রতিরোধের পথ বন্ধ হয় না। তার ফিরে আসা মানুষকে আবার মনে করিয়ে দিয়েছে, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও অধিকার কখনো কারও দয়ায় আসে না-আসে দৃঢ় সংকল্প, ত্যাগ আর আপসহীন চেতনায়।
মহান মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় খালেদা জিয়া এক উজ্জ্বল অধ্যায়। তিনি শুধু একজন রাজনৈতিক নেত্রী নন, বরং একজন আপসহীন সংগ্রামী, যিনি প্রতিকূল সময়েও গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন অকুণ্ঠ সাহসে। রাজনীতিতে তার প্রবেশ ঘটে এক সংকটময় মুহূর্তে-যখন স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলাই ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু সেই শুরুতেই তিনি প্রমাণ করেন, তিনি কেবল প্রতীক নন, বরং গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে হয়ে ওঠেন আশার বাতিঘর। অন্যায় ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান, নির্ভীক উচ্চারণ এবং গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্য নিরন্তর লড়াই তাকে জনগণের হৃদয়ে স্থায়ী আসন দিয়েছে। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি জাতীয় রাজনীতিতে অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। পাঁচটি জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে চারবার পাঁচটি করে এবং একবার তিনটি আসনে বিজয় অর্জন করেন-যা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বিরল একটি রেকর্ড। তিনি যে নির্বাচনি আসন থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, কখনো পরাজিত হননি-এটাই প্রমাণ করে জনগণের সঙ্গে তার আত্মিক সম্পর্ক কতটা গভীর।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, যিনি সততা, দেশপ্রেম ও কৃষিনির্ভর উন্নয়নের দর্শন দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করেন। তার সেই রাজনীতির উত্তরাধিকার খালেদা জিয়া সাহসিকতার সঙ্গে ধারণ করেন এবং কঠিন বাস্তবতায় নিজেকে গড়ে তোলেন একজন আপসহীন নেতৃত্বে। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তিনি শুধু ক্ষমতার পালাবদলের অংশ ছিলেন না, বরং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকারের সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সংগ্রামী নেত্রীর ভূমিকা পালন করেছেন। কারাবরণ, গৃহবন্দিত্ব, সন্তানহারার বেদনা, আরেক সন্তানের নির্বাসনের শোক সত্ত্বেও তিনি কখনো জনগণের স্বার্থ থেকে সরে আসেননি। তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ই সাক্ষ্য দেয়-গণতন্ত্রের প্রশ্নে তিনি আপসহীন। কবি আল মাহমুদ যথার্থই বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট জিয়া যেমন ছিলেন চারণের মতো সারা দেশব্যাপী গণভিত্তি গড়ার রাজনীতিক, সেই গুণই খালেদা জিয়ার মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছে।’ এ গুণই তাকে রূপান্তর করেছে রাজপাটহীন এক রাজকন্যায়-যিনি মানুষের ভালোবাসা আর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই গড়ে তুলেছেন তার অবস্থান।
জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান-এ তিনজনই তাদের নিজস্ব নেতৃত্বগুণ, চিন্তাশক্তি ও দূরদর্শিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছেন। তারা পরিবারতন্ত্রের সীমায় আটকে না থেকে গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে রেখেছেন গঠনমূলক অবদান।
১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরশাসক এরশাদের পদত্যাগের পর প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দেশের প্রথম গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। বিএনপি ১৪০টি আসনে জয়ী হয়ে জামায়াতের সমর্থনে সরকার গঠন করে। খালেদা জিয়া পাঁচটি আসনে জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং ৩২ সদস্যের মন্ত্রিসভা গঠন করেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরদিন তিনি নিজের গাড়িতে স্মৃতিসৌধে যান, যা ছিল এক অনাড়ম্বর বার্তা। প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম মাসেই চট্টগ্রামে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের সময় তিনি চারদিন চট্টগ্রামে দপ্তর স্থানান্তর করে সরাসরি ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম তদারকি করেন।
১৯৯১ সালে তার সরকারের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান ছিল দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন ও প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির অবসান। একই সঙ্গে একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সব সিদ্ধান্তকে বৈধতা দেওয়া হয়। এ দুটি সংশোধনী সরকার ও বিরোধী দলের সম্মিলিত সমর্থনে পাশ হয়।
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দেশে গণতন্ত্রায়ণের প্রক্রিয়া জোরদার হয়। তিনি নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে রক্ষণশীল সমাজে নারীর অগ্রযাত্রার নতুন পথ উন্মোচন করেন। তার শাসনামলে রাষ্ট্র পরিচালনায় ৬০টি সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়, যাতে বিরোধীদলীয় সদস্যদের কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করা হয়। ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তনের জন্য ত্রয়োদশ সংশোধনী পাশ করে পদত্যাগ করেন। ২০০১ সালে তৃতীয়বারের মতো তিনি প্রধানমন্ত্রী হন এবং ২০০৬ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তার সরকারের সময় কর্মসংস্থানের হার বৃদ্ধি পায়, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ে।
সরকার বিএনপিকে বিভক্ত করতে তৎকালীন মহাসচিব মান্নান ভূঁইয়াকে ব্যবহার করে ষড়যন্ত্র শুরু করে। খালেদা জিয়া এ ষড়যন্ত্রের জবাবে মান্নান ভূঁইয়া ও আশরাফ হোসেনকে বহিষ্কার করে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে মহাসচিব নিয়োগ দেন। ২ সেপ্টেম্বর তাকে ও কোকোকে গ্রেফতার করা হয়। কারাগার থেকেই তিনি আইনজীবীদের মাধ্যমে দল পরিচালনার নির্দেশ দেন। সরকারপন্থি একটি কমিটি গঠন করে সিইসি এটিএম শামছুল হুদার স্বীকৃতি আদায় করা হয়। খালেদা জিয়া ৫ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়ে বৈধ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের অনুরোধ জানান। ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে মায়ের মৃত্যুর কারণে তিনি, তারেক ও কোকো প্যারোলে মুক্তি পান। তিনি মুক্তির জন্য অবৈধ সরকারের কাছে কোনো আবেদন না করার ঘোষণা দেন এবং ভোটার তালিকায় নাম ওঠাতেও অস্বীকৃতি জানান। অবশেষে ১১ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের আদেশে মুক্তি পান। সরকারের পক্ষ থেকে গোপনে ক্ষমতায় বসানোর প্রস্তাব এলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। নেতাকর্মীরা বন্দি বা পলাতক থাকলেও, গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন এবং সারা দেশে প্রচারণা চালান। তবে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের একতরফা ও কারচুপির নির্বাচনে বিএনপি ৩৩ শতাংশ ভোট পেয়েও মাত্র ২৯টি আসন পায়।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে কারাগারে যাওয়ার সময় তিনি শেষবারের মতো হেঁটে চলাফেরা করেছিলেন। ২০২০ সালের মার্চে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। ফ্যাসিবাদী দমন-পীড়নের শিকার হয়ে বন্দিজীবনে বারবার মৃত্যুর মুখোমুখি হন তিনি। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একাধিকবার মৃত্যুর গুজবও ছড়ায়।
করোনার শুরুতে নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পেলেও ছিলেন কার্যত গৃহবন্দি। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মুক্ত হন তিনি। মামলা থেকেও খালাস পান, ফলে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এরপর ৮ জানুয়ারি কাতারের আমিরের পাঠানো এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে লন্ডনে যান তিনি। চিকিৎসা শেষে ৬ মে সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে দেশে ফেরেন বিএনপি চেয়ারপারসন। ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া শেষে ১১টা ২০ মিনিটে বিমানবন্দর ত্যাগ করে তার গাড়িবহর। তাকে একনজর দেখতে এবং শুভেচ্ছা জানাতে রাস্তায় নেমে আসেন লাখো নেতাকর্মী। মানুষের ঢল এবং জনসমাগমে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লেগে যায় ফিরোজায় পৌঁছাতে। দুপুর ১টা ২৫ মিনিটে তিনি পৌঁছান বাসায়।
সাঈদ খান : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংগঠনিক সম্পাদক, ডিইউজে