নিউইয়র্কের চিঠি
ট্রাম্পের একশ দিন : যে প্রশ্ন তুলেছে মিডিয়া

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
প্রকাশ: ১০ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার মিডিয়াগুলো প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদ এবং দ্বিতীয় মেয়াদের একশ দিনের কার্যক্রমের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে প্রশ্ন তুলেছে, ট্রাম্প কি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে মানসিকভাবে উপযুক্ত? তাদের সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের বিষয় হলো, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও ব্যয়বহুল সামরিক বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ হিসাবে দায়িত্ব পালনের মানসিক ভারসাম্য তার কতটা আছে। এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য মিডিয়াগুলো আমলাতান্ত্রিক রাজনীতির প্রচলিত ও পরিচিত কৌশল ব্যবহার ছাড়াও কিছু অজ্ঞাত উৎসও ব্যবহার করার কথা স্বীকার করেছে। এক্ষেত্রে মিডিয়া যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি, নীতিমালা এবং ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির অতি প্রচারণার দিকগুলোও যাচাই করেছে।
এ প্রশ্ন যে এবারই উঠেছে তা নয়। ২০১৬ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজনৈতিক উত্থানের সময়েও একই প্রশ্ন উঠেছিল। কারণ, এ উত্থান কেবল অপ্রত্যাশিত ছিল না, বিতর্কিতও ছিল, যা আমেরিকান রাজনীতির বৈশিষ্ট্যকে কম্পিত করেছিল এবং তার হোয়াইট হাউজে প্রবেশ আমেরিকান রাজনীতির প্রচলিত ধ্যানধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। ট্রাম্পের প্রতি জনসমর্থনের ঘটনা তার প্রথম মেয়াদের সময় থেকে মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান করে নিয়েছিল। কোন মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা রাজনৈতিক নিয়মগুলো ভেঙে ফেলায় ব্যবসা ও বিনোদন জগতের ব্যক্তিত্ব ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একজন নেতার আমেরিকার ক্ষমতার শীর্ষে আবির্ভাবকে অপরিহার্য করে তুলেছিল, এ সম্পর্কে তাদের পক্ষে উপসংহারে পৌঁছা সহজ ছিল না। তবে তারা স্বীকার করেন, প্রেসিডেন্ট হিসাবে ট্রাম্প যদি কেবল রাষ্ট্রীয় নীতিমালার ভিত্তিতে প্রশাসন পরিচালনা করতেন, তাহলে তার ব্যক্তিগত অনেক কিছু উপেক্ষা করা সম্ভব হতো। কিন্তু তিনি প্রশাসন পরিচালনা করছেন তার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ দ্বারা তাড়িত হয়ে। তার মানসিক বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট প্রভাব ফেলে প্রশাসনে। আমেরিকান সংবিধান যদিও প্রেসিডেন্টকে প্রভূত ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে, তা সত্ত্বেও কোনো আমেরিকান রাজনীতিকের ব্যক্তিত্ব রাষ্ট্রের প্রতিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এককভাবে ভূমিকা পালনের সুযোগ দেয় না। কংগ্রেস ও সর্বোচ্চ আদালত পদে পদে তার সিদ্ধান্ত আটকে দিতে পারে। তা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আধুনিক আমেরিকার সর্বাধিক ব্যক্তিত্বচালিত প্রেসিডেন্ট, যিনি দৃশ্যত কোনোকিছুর তোয়াক্কা করেন না। তিনি তার সমালোচকদের রূঢ়ভাবে আক্রমণ করেন পরিণতি না ভেবেই। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তার মানসিক ভারসাম্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এ প্রশ্ন সহসা ওঠেনি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির প্রথম মেয়াদের ওপর ইতোমধ্যে প্রকাশিত বেশকিছু গ্রন্থে তার অধীনে বিপজ্জনকভাবে ও বিশৃঙ্খল উপায়ে প্রেসিডেন্সি পরিচালনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এসব গ্রন্থের কোনো কোনোটিতে তার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে মানসিক চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন ও উদ্ধৃতি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ‘টু মাচ অ্যান্ড নেভার এনাফ’ নামে একটি বই লিখেছেন স্বয়ং ট্রাম্পের ভাগনি মেরি ট্রাম্প। তিনি তার মামাকে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে বর্ণনা করেছেন। ২০১৮ সালের মধ্যে বেশির ভাগ আমেরিকান মনে করেছে, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পদের জন্য অযোগ্য। যেসব মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ট্রাম্পের মানসিক অবস্থার ওপর কাজ করেছেন, তারা তার আচার-আচরণ, একই কথা বারবার বলা, অসহিষ্ণুতা এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সূচক বিশ্লেষণ করে তার মানসিক ভারসাম্যহীনতা নিয়ে নিশ্চিত উপসংহারে উপনীত হয়েছিলেন।
খ্যাতিমান আমেরিকান সাংবাদিক মাইকেল ওলফ ২০১৮ সালে হোয়াইট হাউজে ট্রাম্পের প্রথম বছরের ওপর ‘ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি অন্যান্য বিষয়ের ওপর ট্রাম্পের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি লিখেছেন, যারা ট্রাম্পের চারপাশে রয়েছেন, তাদের শতভাগ তাকে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য অনুপযুক্ত বলে বিবেচনা করেন। মাইকেল ওলফের মতে, তিনি ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির ওপর একটি গ্রন্থ রচনার বিষয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি তাকে হোয়াইট হাউজে প্রবেশাধিকার দিতে রাজি হন। কারণ, ওলফ ২০১৬ সালে ‘দ্য হলিউড রিপোর্টারে’ তার সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন, যা ট্রাম্পকে মুগ্ধ করেছিল। কিন্তু ‘ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি’ প্রকাশিত হওয়ার পর ট্রাম্প বলেন, তিনি কখনো মাইকেল ওলফকে এ ধরনের অনুমতি দেননি। ওলফ দাবি করেছেন, গ্রন্থটি রচনার জন্য হোয়াইট হাউজের প্রয়োজনীয় দলিলপত্রের সাহায্য গ্রহণ ছাড়াও তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার সহযোগী এবং হোয়াইট হাউজের স্টাফসহ দুইশর বেশি ব্যক্তির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন।
মাইকেল ওলফের রচনাকে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের হোয়াইট হাউজ কর্মকর্তারা ফিকশন, ভিত্তিহীন ও তথ্যভিত্তিক নয় বলে সমালোচনা করলেও তার মূল্যায়ন অযৌক্তিক ছিল না। ফরেনসিক সাইকিয়াট্রিস্টরা ট্রাম্পের মানসিক ভারসাম্যহীনতা নিয়ে নিশ্চিত অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ মেডিসিনের ফরেনসিক সাইকয়াট্রিস্ট ডা. ব্যান্ডি লি’র নেতৃত্বাধীন ‘ন্যাশনাল কোয়ালিশন অফ কনসার্নড মেন্টাল হেলথ এক্সপার্টস’ ২০১৮ সালে এক বিবৃতিতে ট্রাম্পের আচরণ ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর জরুরি মূল্যায়নের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তারা বলেছেন, ট্রাম্প যে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী প্রধানের ভার বহনের যোগ্যতা রাখেন না, ট্রাম্পের ত্রুটিযুক্ত আচরণেই তা ফুটে ওঠে।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের জন্য নির্বাচনি প্রচারণাকালে দাম্ভিকতাপূর্ণ ও অর্থহীন আচরণ এবং তার প্রথম মেয়াদের প্রথম দুই বছরের কর্মকাণ্ডের কারণে নীতিনির্ধারকদের উচিত ছিল তাকে সতর্ক করা; কিন্তু তা না করায় তিনি তার এখতিয়ার চাপিয়ে দিতে উৎসাহী হয়েছিলেন। তখন থেকে সাত বছর কেটে গেছে এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কর্মকাণ্ড ও বক্তব্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর অভ্যন্তরীণ ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, যা বিশ্ব সম্প্রদায় ছাড়াও আমেরিকানরা গ্রহণ করতে পারছে না।
ট্রাম্পের মারাত্মক আত্মপ্রশংসা ও দাম্ভিকতার মন্দ দিকই বেশি। তার ক্ষেত্রে এ ব্যাধি নিরাময়ের অযোগ্য। তিনি তার প্রথম মেয়াদের পুরো সময়ে দাবি করেছেন, যে কোনো বিষয়ে অন্য যে কারও চেয়ে তিনি বেশি জানেন এবং বেশি বোঝেন। একমাত্র তিনিই পারেন আমেরিকানদের ও বিশ্বের সমস্যার সমাধান করতে। দ্বিতীয় মেয়াদে তার সদম্ভ বক্তব্য ‘আই রান দ্য কান্ট্রি অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড’ (আমি দেশ ও বিশ্বকে পরিচালনা করি) আগের চেয়েও ভয়াবহ বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। গত মেয়াদে কংগ্রেসের দুটি ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব এবং তার বিরুদ্ধে আদালতে দায়েরকৃত অসংখ্য মামলার ফলে তিনি তার কল্পিত শত্রুদের প্রতি দানবীয় ধরনের চেয়েও বেশি হুমকি হয়ে উঠেছেন। নারী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং ইমিগ্রান্টদের প্রতি তার আচরণ অনেকটাই বিকৃত মানসিকতাকে প্রকট করেছে। দেশকে ইমিগ্রান্টমুক্ত করতে এবং নারী ও সংখ্যালঘুদের ফেডারেল চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নের যে উদ্যোগ তিনি গ্রহণ করেছেন, তা নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন, অমানবিক ও কোনো ধরনের সহানুভূতির ঊর্ধ্বে, যা তার আত্মমুগ্ধতা ব্যাধি দ্বারা প্রভাবিত।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের চার বছরের তুলনায় দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম একশ দিনে আমেরিকার অনেক বেশি ক্ষতি হয়েছে। চলতি মেয়াদে কিছু মধ্যপন্থি ট্রাম্পের একগুঁয়েমি ও উসকানিমূলক বক্তব্য নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালন করতে পারবেন বলে মনে হলেও কার্যত তা সম্ভব হয়নি। কিন্তু যারাই ট্রাম্পের কোনো উদ্যোগের সমালোচনা করতে চেষ্টা করেছেন, তাদের পদ হারাতে হয়েছে। দ্বিতীয় মেয়াদে ইতোমধ্যে অনেকে পদ হারানোর ঝুঁকি নেওয়ার পরিবর্তে ট্রাম্প যে উদ্যোগ নিচ্ছেন, তা বাস্তবায়নে মরিয়া হয়ে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। সেক্রেটারি অফ স্টেট মার্কো রুবিও বাংলাদেশি শিক্ষার্থীসহ দেড় হাজারের অধিক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল করেছেন। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডাইরেক্টর ক্রিস্টি নোম বৈধ-অবৈধ নির্বিশেষে ইমিগ্রান্ট বিতাড়নে ট্রাম্পের অন্যতম সহযোগীর ভূমিকা পালন করছেন। ট্রাম্প যাদের নিয়োগ করেছেন, তাদের পক্ষে নিয়োগকারীর সামনে প্রণত হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। অভিযোগ উঠেছে, অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডি বিচার বিভাগকে ধ্বংস করছেন। কারণ, ইমিগ্রান্টদের অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করার ক্ষেত্রে ১৭৯৮ সালের ‘বিদেশি শত্রু আইন’ প্রয়োগ করা হচ্ছে, যা এখন যারা ইমিগ্রান্ট হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন, তাদের ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য আইন নয়। কিন্তু ট্রাম্পের ক্ষোভের শিকার হওয়ার মতো সাহসী কোনো নীতিনির্ধারক না থাকায় যুক্তরাষ্ট্রে স্বাভাবিকভাবে যা ঘটার কথা নয়, তা-ই ঘটে চলেছে। এখনো ট্রাম্পের বর্তমান মেয়াদের পৌনে চার বছর পড়ে আছে। সামনের দিনগুলোর ভয়াবহতার আশঙ্কায় আমেরিকানরা সাধারণভাবে সন্ত্রস্ত। ট্রাম্পের ইমিগ্রেশন নীতি তাদের জন্য বড় কোনো সমস্যা নয়, ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে তারা চরম অর্থনৈতিক সংকটের আশঙ্কার মধ্যে কাটাচ্ছেন।
আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু : নিউইয়র্ক প্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক ও অনুবাদক