বিশ্ব মা দিবস
জাপানের চিঠি: মায়েদের গুরুত্ব বুঝতে যেন দেরি না হয়

তামিমা জোবায়দা
প্রকাশ: ১১ মে ২০২৫, ০৯:১১ পিএম

বিশ্ব মা দিবস
মা দিবস আসতেই জাপানের শহরগুলো ফুল, উপহার ও হৃদয়গ্রাহী প্রচারণায় প্রাণ ফিরে পায়। শপিং মল থেকে শুরু করে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম পর্যন্ত, পুরো জাতি সম্মানের সাথে মায়েদের শ্রদ্ধা জানায়। সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি সংস্থাগুলো ভালোবাসা ও গভীর শ্রদ্ধাভরে এই উদযাপনে অংশ নেয়। প্রতিটি ফুলের তোড়া ও প্রচারণায় নিহিত থাকে একটি উপলব্ধি—একটি জাতির শক্তি নির্ভর করে তার মায়েদের নিঃশব্দ সহ্যশক্তির ওপর। এই উপলব্ধি একটি সভ্যতাকে জাগিয়ে তোলে—যেখানে প্রজনন ও যত্নের গুরুত্ব স্বীকৃতি পায়, যা এতদিন উপেক্ষিত ছিল।
বর্তমানে আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক জনসংখ্যা সংকটের মুখোমুখি জাপান। ২০২৫ সালের জন্য দেশটির প্রজনন হার ১.৩৮, যা ২.১ রিপ্লেসমেন্ট রেটের অনেক নিচে। ২০২৪ সালে দেশটিতে মাত্র ৭,২০,৯৮৮টি শিশু জন্মগ্রহণ করে, যা টানা নবম বছর কমতির রেকর্ড এবং ১৮৯৯ সাল থেকে হিসেব রাখা শুরু হওয়ার পর সর্বনিম্ন। একই সময়ে শতবর্ষীদের সংখ্যা রেকর্ড ৯৫,১১৯-এ পৌঁছেছে, যা টানা ৫৪ বছর ধরে বার্ষিক বৃদ্ধির ধারাকে অব্যাহত রেখেছে। গ্রামীণ এলাকাগুলো জনশূন্য হয়ে পড়ায় জাপান রেলওয়ে কম চাহিদাসম্পন্ন এলাকায় রুট বন্ধ করে দিচ্ছে। শহুরে জীবনে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ঘাটতি ও প্রবীণ জনগণের বাড়তি চাপ স্পষ্ট। জাপান কেবল ‘বৃদ্ধ’ নয়, তা ‘সঙ্কুচিত’ও হচ্ছে।
এই অবস্থায় জাপান জনসংখ্যা হ্রাসকে ‘জাতীয় জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করেছে। পূর্বের কিশিদা প্রশাসন এই প্রবণতায় যতি টানতে প্রতি বছর ৩.৫ ট্রিলিয়ন ইয়েনের বেশি বাজেট বরাদ্দ করেছে। প্রজনন-বান্ধব নীতিমালা, শিশু-ভাতা, বিনামূল্যে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা, বাড়তি মাতৃত্ব ও পিতৃত্বকালীন ছুটি, কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ সমতা, ভর্তুকিযুক্ত আবাসন এবং বিয়ে সহায়তার মতো নানা পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করেছে তারা। এছাড়া কমিউনিটি চাইল্ডকেয়ার কেন্দ্র, পরিবার-বান্ধব পরিবহণ ব্যবস্থা, অভিভাবকদের সেবা এবং সহায়তার জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তবে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন নীতিতে নয়, দেখা গেছে দৃষ্টিভঙ্গিতে। জাপান এখন বুঝতে শিখেছে—মায়ের গর্ভ শুধু ব্যক্তিগত বিষয় নয়, তা একটি সভ্যতার উৎস।
একজন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ও হবু মা হিসেবে জাপানে আমার এই অধ্যায়টি শুরু হয়েছিল শঙ্কা নিয়ে। পরিবার থেকে দূরে, আমি একাকীত্বের ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু জাপান আমাকে একা সেই পথে হাঁটতে দেয়নি।
সমাজের প্রতিটি স্তর—বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে পরিবহণ, পৌর অফিস থেকে ক্লিনিক—আমাকে শান্ত ও মর্যাদাপূর্ণ যত্নে ঘিরে রেখেছে। ‘নিনশিন মারকো’ (গর্ভধারণ ব্যাজ) হয়ে উঠেছে আমার অন্তর্ভুক্তির প্রতীক; যেখানে যাই, আমাকে শুধু সম্মানসহকারে গ্রহণ করা হয়। আমার অধ্যাপক, সহকর্মী ও সহপাঠীরা অকুণ্ঠ সমর্থন দেখিয়েছেন। আমি যে শহরে বাস করি, তারা আর্থিক ও মানসিক সহায়তা অব্যাহত রেখেছে। এখানে আমি নিরাপদ বোধ করি।
এই স্নেহময় পরিবেশে আমি প্রায়ই বাংলাদেশের নারীদের কথা ভাবি। সেখানে মাতৃত্ব উদযাপন নয়, শুধুই সহ্য করার বিষয়—নীরবভাবে বয়ে চলা এক কঠিন দায়িত্ব। গর্ভধারণ, সন্তান জন্মদান ও লালনপালনের সব ভার নারীদের ও পরিবারের ওপর, রাষ্ট্রের নয়।
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ প্রায় ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে। ফলাফল? ১৯৭১ সালে প্রতি নারী গড়ে প্রায় ৭টি সন্তান জন্ম দিত, যা এখন কমে এসেছে প্রায় ২-এ। তবে এই সাফল্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক আসন্ন সংকট। ২০৪৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি পূর্ণাঙ্গ বার্ধক্যজনিত সমাজে পরিণত হবে বলে পূর্বাভাস রয়েছে।
জাপানের শিক্ষা স্পষ্ট। ধ্বংস নামার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করলে অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ থেকে জনসংখ্যা যেন সঠিক যত্ন পায়, সেভাবে নিজেদের পলিসিগুলোকে তৈরি করতে হবে। বিশেষত সেইসব নারীর প্রতি যত্নবান হতে হবে, যারা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলে। রাষ্ট্রকে গর্ভবতী নারীদের চিকিৎসা, পুষ্টি, যাতায়াত ও অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে। প্রত্যেক গর্ভবতী নারীকে মাসিক ভাতা, বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা, যাতায়াত পাস ও রেশনকৃত পুষ্টি সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। কর্মরত মায়েদের জন্য অন্তত ৬ মাস থেকে এক বছরের বেতনসহ মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং বাবাদের জন্যও পিতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে যত্ন নেওয়া একটি পারিবারিক প্র্যাকটিসে পরিণত হয়।
নারীদের জন্য পাবলিক স্পেসে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জাতীয় অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। বর্তমান প্রযুক্তির মাধ্যমে একটি মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে নারীরা জিপিএস সংযোগে তাৎক্ষণিক সাহায্য চাইতে পারবে। কর্মক্ষেত্র, রাস্তা ও গণপরিবহনকে ‘নিরাপদ অঞ্চল’ ঘোষণা করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে বিচার বিভাগকে দ্রুত ও ন্যায্য পদক্ষেপ নিতে হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মাতৃত্বকালীন ছুটি, দম্পতির হোস্টেল এবং ক্যাম্পাসে চাইল্ডকেয়ার চালু করতে হবে। মাধ্যমিক শ্রেণি থেকেই পাঠ্যসূচিতে মাতৃত্ব, প্রজনন ও লিঙ্গসমতা বিষয়ক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে স্তন ও জরায়ু ক্যানসার শনাক্তের বার্ষিক বিনামূল্যে স্ক্রিনিং চালু করতে হবে। গণপরিবহনে মায়েদের ও শিশুদের অগ্রাধিকার দিতে হবে, কমপক্ষে অর্ধেক আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখতে হবে। মসজিদ, পার্ক, রেস্টুরেন্ট ও স্টেশনসহ পাবলিক স্থাপনায় নার্সিং কর্নার থাকতে হবে। নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নারী-নির্দিষ্ট জিম, স্টেডিয়াম ও খেলার মাঠ থাকা উচিত।
পেশাগতভাবে নারীদের শ্রমনির্ভর নয়, সেবামুখী ও নেতৃত্বময় পেশায় অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান, ব্যবসা ও গবেষণায় নেতৃত্বে উৎসাহিত করতে হবে—যেখানে বুদ্ধিবৃত্তিক ও আবেগমূলক সক্ষমতার প্রয়োগ থাকে এবং মাতৃত্বের জন্য সুবিধাজনক সময়সূচি বজায় থাকে।
এই পরিবর্তনগুলোকে সাংস্কৃতিক সততার ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হবে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে, বাংলাদেশকে অবশ্যই নীতিমালাগুলোতে ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে হবে। ইসলাম মাতৃত্বকে সর্বোচ্চ সম্মান দেয়—মায়ের পায়ের নিচে জান্নাত ঘোষিত হয়েছে, তাকে পিতার তুলনায় তিনগুণ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে এবং কন্যা সন্তানদের ভালোবাসায় লালন করলে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। বিদেশি নারীবাদী মডেল অনুকরণ না করে বাংলাদেশকে তার নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের ভিত্তিতে নীতি গড়তে হবে।
কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন: এত কিছুর অর্থায়ন কীভাবে সম্ভব? উত্তর লুকিয়ে আছে রাজনৈতিক সদিচ্ছায়। দুর্নীতি দমন করে এবং উন্নয়ন বাজেটের ৪০-৫০% সঠিকভাবে পুনর্বিন্যাস করে বাংলাদেশ একটি প্রজনন ও মাতৃত্বের মর্যাদাভিত্তিক ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারে।
এই মা দিবসে আমি পৃথিবীর সব মায়েদের প্রতি আমার গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি—তাদের ধৈর্য, যন্ত্রণা ও অধ্যবসায়ের জন্য। কিন্তু একইসাথে, একজন হবু মা হিসেবে আমি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলবমায়েদের মর্যাদা দিতে বাংলাদেশ যেন জনসংখ্যা সংকটের জন্য অপেক্ষা না করে। আসুন, জাপানের কাছ থেকে শুধু পুনরুদ্ধার নয়—ধ্বংসের আগেই প্রতিরোধ করাও শিখি। আসুন এমন এক সভ্যতা গড়ে তুলি যেখানে মাতৃত্ব শুধু ত্যাগ নয়, এক শক্তির নাম।
টোকিও থেকে ঢাকা পর্যন্ত, এই মা দিবস হোক পরিবর্তনের সূচনা।
শুভ মা দিবস ২০২৫।
লেখক: ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক, টোকিও, জাপান