ঈদ-পূর্ব শ্রমিক অসন্তোষ এড়ানোর কার্যকর উপায়

ড. সোহেল মিয়া
প্রকাশ: ২১ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
-682cfad6a7735.jpg)
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের শ্রমনির্ভর শিল্প খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক ও রপ্তানিমুখী শিল্পে কর্মরত লাখো শ্রমিকের জন্য ঈদ শুধুই একটি ধর্মীয় উৎসব নয়; এটি একটি দীর্ঘ প্রতীক্ষিত প্রত্যাশা, ঘরে ফেরার স্বপ্ন। পবিত্র ঈদুল আজহা বা কুরবানির ঈদ সামনে রেখে বহু শ্রমিক এখন পরিবার-পরিজনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার, প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। এ সময়টিতে শ্রমিকদের স্বাভাবিক ও ন্যায্য প্রত্যাশা থাকে-সঠিক সময়ে বেতন ও ঈদ বোনাসপ্রাপ্তির, পরিবার নিয়ে কিছুদিন স্বস্তিতে কাটানোর এবং সম্মানের সঙ্গে নিজ গ্রামে গিয়ে ঈদ উদযাপনের মতো সামর্থ্য অর্জনের।
কিন্তু বারবারই দেখা যায়, এ প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয় অনেক প্রতিষ্ঠান। বহু প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ হয়। ফলে শ্রমিকদের পথে নামতে হয়, আন্দোলন করতে হয় কিংবা অনিশ্চয়তায় ভুগতে হয়। এ মানবিক সংকট কেবল ব্যক্তি পর্যায়ের সমস্যা নয়, এটি শিল্পের স্থিতিশীলতা ও জাতীয় অর্থনীতির জন্যও বড় ধরনের হুমকি। তাই এখনই সময় পবিত্র ঈদুল আজহা সামনে রেখে শ্রমিক অসন্তোষ রোধে মানবিক, সময়োপযোগী ও সুসংহত উদ্যোগ গ্রহণের।
ঈদকে ঘিরে শ্রমিকদের প্রত্যাশা শুধু সময়মতো বেতন নয়, বরং তার সঙ্গে ঈদ বোনাস, ছুটির নির্ধারিত সময়সূচি এবং নিরাপদে বাড়ি ফেরার নিশ্চয়তা। এসবই একটি সম্মানজনক ও স্বস্তিকর ঈদ উদযাপনের পূর্বশর্ত। বিশেষ করে কুরবানির ঈদে ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের ইচ্ছা শ্রমিকদের মধ্যে প্রবল থাকে, যা শুধু ব্যক্তিগত আবেগ নয়, বরং বিশ্বাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। কিন্তু যদি দেখা যায়, বেতন-ভাতা সময়মতো পরিশোধ করা হয়নি, বোনাস নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে, ছুটির ঘোষণা অনির্দিষ্ট এবং যাতায়াতের ব্যবস্থা অনিশ্চিত, তাহলে তা শ্রমিকদের মনে অসন্তোষ ও ক্ষোভের জন্ম দেয়। এ জমে থাকা ক্ষোভই অনেক সময় হঠাৎ করে বিক্ষোভ, আন্দোলন বা শিল্প এলাকায় সহিংসতার রূপ নেয়, যা শুধু কারখানার পরিবেশ নয়, পুরো শিল্প খাত এবং জাতীয় অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
ঈদ-পূর্ববর্তী শ্রমিক অসন্তোষের মূল কারণ
ঈদ-পূর্ব শ্রমিক অসন্তোষের অন্যতম প্রধান কারণ হলো পরিকল্পনার অভাব। অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান ঈদ বা উৎসবকে ঘিরে আর্থিক ব্যবস্থাপনার জন্য আগেভাগে প্রস্তুতি নেয় না। ফলে শেষ মুহূর্তে তারা অর্থ সংকটে পড়ে এবং সেই অজুহাতে বেতন ও বোনাস দিতে বিলম্ব করে, যা শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে।
সুবিন্যস্ত নীতির ঘাটতি এবং তার যথাযথ বাস্তবায়নের অভাব এর একটি বড় কারণ। দেশের বিদ্যমান শ্রম আইন ও নীতিমালায় বেতন-বোনাস প্রদানের নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারিত থাকলেও তা অনেক সময় কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও শ্রম সংগঠনগুলো পর্যাপ্ত তদারকি ও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হলে কিছু মালিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ম লঙ্ঘনে উৎসাহী হয়ে ওঠে। এ কারণে তারা শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে এবং তাদের মধ্যে গভীর অসন্তোষ সৃষ্টি করে। ফলে ঈদের মতো সংবেদনশীল সময়ে পরিস্থিতি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
সঠিক সময়ে এবং স্বচ্ছ যোগাযোগ না হলে শ্রমিকদের মধ্যে অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগ তৈরি হয়। বিশেষ করে ঈদের সময় বেতন-বোনাস, ছুটি এবং অন্যান্য সুবিধা নিয়ে পরিষ্কার তথ্য না দিলে শ্রমিকরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, যা পরবর্তীকালে পরিস্থিতিকে অসন্তোষ ও আন্দোলনের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
এছাড়া কোনো কোনো মালিকপক্ষের মানবিক সংবেদনশীলতার অভাবও শ্রমিক অসন্তোষের একটি বড় কারণ। শ্রমিকরাও মানুষ, তাদের পরিবার আছে, সন্তান আছে, স্বপ্ন আছে। ঈদের সময় তাদের আনন্দ ও প্রয়োজনকে মূল্য না দিলে, কেবল উৎপাদন বৃদ্ধির কথা চিন্তা করে অতিরিক্ত কাজ করালে এবং সে অনুযায়ী প্রণোদনা না দিলে তা তাদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
ঈদ বা অন্যান্য উৎসবের আগে উৎপাদন বৃদ্ধি বা বিশেষ কাজের চাপের কারণে অনেক সময় শ্রমিকদের অতিরিক্ত কাজ করতে হয়। এ অতিরিক্ত কাজের চাপের মধ্যে যদি বেতন ও বোনাস প্রদান না করা হয়, তাহলে শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ তৈরি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
নেতিবাচক প্রভাব
শ্রমিক অসন্তোষের ফলে শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা সৃষ্টি হয় এবং উৎপাদন ব্যাহত হয়। বিশেষ করে ঈদের আগের ৭ থেকে ১০ দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় অসন্তোষ দেখা দিলে অর্ডার বাতিল, ডেলিভারি বিলম্ব এবং বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি হয়ে যায়। এতে ব্যবসার সুনাম ও গ্রাহকের আস্থা দুই-ই হুমকির মুখে পড়ে।
যদি শ্রম পরিবেশ স্থিতিশীল না থাকে, তাহলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ব্যবসার প্রতি আগ্রহ হারায়। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হলে শিল্প খাতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হতে পারে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য নেতিবাচক হতে পারে।
শ্রমিক অসন্তোষের ফলে বাড়ে সামাজিক অস্থিরতা। রাস্তা অবরোধ, সংঘর্ষ, কর্মবিরতি ও সহিংসতার ঘটনা ঘটলে শুধু শিল্পাঞ্চল নয়, আশপাশের এলাকাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে এবং সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, যা সামগ্রিক স্থিতিশীলতা ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
যখন শ্রমিকরা ঈদের আগে আন্দোলনে অংশ নেয় এবং তা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তখন বিদেশি ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশকে এক অস্থির ও অনির্ভরযোগ্য উৎপাদন কেন্দ্র হিসাবে দেখে, যার ফলে দেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।
সমাধানে করণীয়
বর্তমানে বাংলাদেশের শিল্প খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্প বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা, অর্থনৈতিক চাপ এবং শ্রমবাজারের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এর সঙ্গে যখন ঈদের মতো উৎসব সামনে আসে, তখন শ্রমিকদের ন্যায্য প্রাপ্য বেতন-বোনাস সময়মতো পরিশোধ করা না হলে তা শ্রম অস্থিরতায় রূপ নেয়। ফলে এখন সময় এসেছে এ সমস্যাকে কেবল মোকাবিলা নয়, এর পূর্বাভাস, প্রতিরোধ ও প্রশমন-এ তিনটি স্তরে সমাধান কাঠামো গড়ে তোলার।
পূর্বাভাস : শ্রমিক অসন্তোষ প্রতিরোধে সমস্যার সূচনাবিন্দু আগেভাগে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। এজন্য কারখানাভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ, বেতন-বোনাস পরিশোধের সময়সূচি পর্যবেক্ষণ এবং শ্রমিক সংগঠন থেকে নিয়মিত ফিডব্যাক গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। এসব কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, শিল্প পুলিশ ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি ডিজিটাল রিপোর্টিং সিস্টেম চালু করা যেতে পারে।
প্রতিরোধ : সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার আগেই প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এজন্য ‘ঈদ প্রস্তুতি কমিটি’ গঠন করে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বেতন ও বোনাস পরিশোধ নিশ্চিত করতে হবে।
প্রশমন : যদি কোনো কারণে সমস্যা শুরু হয়েও যায়, তাহলে তাৎক্ষণিক প্রশমন কৌশল নিতে হবে। শিল্পাঞ্চলে নির্দিষ্ট ‘শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ এলাকা’ নির্ধারণ এবং শ্রমিকদের জন্য হটলাইন চালু করে দ্রুত অভিযোগ গ্রহণ ও সমাধান কার্যকর করতে হবে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নেতৃত্বে সক্রিয় অভিজ্ঞ টিমকে ঘটনাস্থলে পৌঁছে দ্রুত সমস্যার সমাধান করতে হবে। যেসব মালিক নিয়ম লঙ্ঘন করবেন, তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী জরিমানা বা শাস্তির বিধান নিশ্চিত করলে অন্যদের জন্য তা একটি বার্তা হিসাবে কাজ করবে।
মালিকের দায়বদ্ধতা ও মানবিকতা : শ্রমিক অসন্তোষ কেবল আইন বা প্রশাসনিক বিষয় নয়, বরং এটি একটি মানবিক ও নৈতিক সংকটও বটে। একজন মালিক যখন শ্রমিকের ঘাম ঝরানো পরিশ্রমে গড়া মুনাফা উপভোগ করেন, তখন শ্রমিকের পরিবারে ঈদের আনন্দ নিশ্চিত করা তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ঈদের আগে বেতন, বোনাস ও ছুটি নিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করে ভুল বোঝাবুঝি ও উত্তেজনার পথ অনেকটাই রুদ্ধ করা সম্ভব।
একটি উৎসব তখনই সম্পূর্ণ হয়, যখন সব শ্রেণির মানুষ তাতে অংশ নিতে পারে। শ্রমিক শ্রেণি যদি ঈদের আগে আন্দোলন করতে বাধ্য হয়, তবে তা শুধু অর্থনৈতিক ব্যর্থতা নয়, এটি নৈতিক ও সামাজিক ব্যর্থতাও বটে। তাই কুরবানির ঈদের আগে আমরা যেন সেই চিরচেনা দৃশ্য-সড়কে বিক্ষোভরত শ্রমিক, বেতন-বোনাসের দাবিতে উত্তপ্ত পরিস্থিতি আর দেখতে না পাই। সময়মতো পদক্ষেপ, আন্তরিকতা ও অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ ঈদ ও সন্তুষ্ট শ্রমিক শ্রেণি এবং স্থিতিশীল শিল্প খাত গড়ে তোলাই হোক আমাদের অঙ্গীকার। এই ঈদ হোক একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত; যেখানে অসন্তোষ নয়, থাকবে ঐক্য, সহযোগিতা ও সন্তুষ্টির আলোকচ্ছটা।
ড. সোহেল মিয়া : শ্রম সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ