Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্ন্যাপব্যাক মেকানিজম নাকি ইরানে আবারও হামলা

নাসির মাহমুদ

নাসির মাহমুদ

প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২৫, ১০:৩৫ পিএম

স্ন্যাপব্যাক মেকানিজম নাকি ইরানে আবারও হামলা

গত শনিবার (২৬ জুলাই) দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় ইরানের সিস্তান ও বেলুচিস্তান প্রদেশের একটি আদালত ভবনে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। হামলায় শিশুসহ অন্তত আট বেসামরিক নাগরিক মারা গেছে। এই ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে মিডিয়া জগতে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। সবারই ভাষ্যইরানে আবারও হামলা করেছে ইসরাইল। আসলে কি তাই? সন্ত্রাসী হামলাগুলোর সুনির্দিষ্ট জবাব কি এক শব্দে দেওয়া যায়?

যদি বলি ঘটনা আসলেই সত্য। কারণ এরই মধ্যে চাউর হয়ে গেছে যে ইরানে আবারও হামলা করার সুযোগ খুঁজছেন বিবি মানে নেতানিয়াহু। কিন্তু তিনি কি আমেরিকার অনুমতি ছাড়া নিজের সিদ্ধান্তে কিছু করতে পারেন কিংবা জানেন? জবাব এককথায় নেতিবাচক। ইসরাইলের নিজস্ব কোনো সত্ত্বা কিংবা অস্তিত্ব নেই। কথাটা আমার নয়। আমেরিকার প্রভাবশালী দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলেছে: বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নিজেই মনে করেন তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে একমাত্র আমেরিকা। তার মানে গুরুর আকার-ইঙ্গিত ছাড়া ক্রীড়ণক নড়তে-চড়তে পারে না। যদিও গুরু কখোন কী বলেন-খেয়াল করেন না। ইরানে বারো দিনের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে অস্তিত্ব বিলীনপ্রায় ইসরাইল কি পুনরায় হামলা করার শক্তি বা ক্ষমতা রাখে? গুরু তো জানেন কাতারে তাদের ঘাঁটিতে কীরকম হামলাটাই না চালালো ইরান। হ্যাঁ! বিশ্বের একমাত্র শক্তি ইরানই ইসরাইলের অভ্যন্তরে এবং আমেরিকার ঘাঁটিতে হামলা চালানোর শক্তি ও সাহস দেখাতে পেরেছে। জয়-পরাজয়ের হিসেব-নিকেশ পরের কথা। ইসরাইলের দিকে তাকালে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখে সনাক্ত করতে হয়-এটা গাজা নাকি ইসরাইল। এইরকম অহংকার ধূলোয় মিশে যাওয়া কাগুজে বাঘ কি হাঁক দেওয়ার শক্তি রাখে? আক্রমণ করা তো পরের বিষয়। সুত

বারো দিনের যুদ্ধের পর এখন আবারও হামলা চালানোর প্রশ্নটা কেন আসছে? এতে কি প্রমাণ হয় না-যে লক্ষ্যে ইরানে উন্মাদের মতো হামলা চালানোর মাধ্যমে ইসরাইলের লক্ষ্য অর্জিত হয় নি উল্টো বরং পিরানহা মাছের খাবারে পরিণত হয়েছে শিকারী নিজেই?

বেড়াল নাকি কম দু:খে গাছে ওঠে না, বিশেষ চাপে পড়লেই তারা গাছে ওঠে। ইরান তো যুদ্ধবিরতি চায় নি। কতোটা বিপদে পড়লে আমেরিকার মতো সন্ত্রাসী দেশ ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি করার জন্য কাকুতি মিনতি করে-তা বুদ্ধিমান বিবেকবান মানুষ ঠিকই বোঝে, বোঝে না শুধু পশ্চিমা মিডিয়া আক্রান্ত মেধাগুলো। আর মাত্র ক'টা দিন যদি যুদ্ধ চলতো তাহলে বিশ্ব নতুন একটা মানচিত্র দেখতে পেত। এই বাস্তবতা উপলব্ধি করেই ইরানের শত্রুপক্ষ যুদ্ধবিরতিতে গেছে। বিশ্ববাসী কিন্তু জানে ইসরাইল যুদ্ধবিরতি কিংবা আন্তর্জাতিক রীতিনীতির প্রতি কতোটা শ্রদ্ধাশীল। সে বিষয়টি ইরানের মাথায় যে নেই, তা কিন্তু নয়। ইরানের প্রেসিডেন্ট ডা. পেজেশকিয়ান সম্প্রতি বলেছেন: নতুন করে কেউ যদি সামরিক আগ্রাসন চালায় আমরা সেটা প্রতিহত করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছি। এবার কেবল প্রতিহত করাই নয় বরং ইসরাইলের ভেতরে গভীরভাবে আঘাত হানার ইঙ্গিতও দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান। ইরানের হুমকি যে ইরাকের সাদ্দাম সরকারের মন্ত্রী সাইদ-আস-সাহাফের মতো নয়, সেটা ভালো করেই জানে সামরিক বিশেষজ্ঞরা। সুতরাং পুনরায় হামলা করার আগে প্রচুর অংক কষতে হবে ইসরাইলকে।

মনের গহীনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে তাহলে ইরানের দক্ষিণাঞ্চলের সুন্নি এলাকায় সন্ত্রাসী হামলা কেন হলো! জবাবে যুদ্ধকালীন বাস্তবতায় ফিরে যেতে হবে। একথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে গোয়েন্দা ব্যর্থতা ইরানে ইসরাইলি হামলায় ক্ষয়ক্ষতির অন্যতম কারণ। এই সত্য সামরিক কর্মকর্তাদের হারানো ইরানের অজানা নয়। ইরানের অভ্যন্তরেই শত্রুপক্ষের ব্যাপক গোয়েন্দা তৎপরতা ছিল। এমনকি বলতে দ্বিধা নেই যে তাদের গুপ্তচররাই ইরানের বিভিন্ন গোপন স্থান থেকে স্বদেশের স্বার্থের ওপর ড্রোন হামলা চালিয়েছে। ইরান হতবাক হয়ে সেই সত্যকে মেনে নিয়েই গোয়েন্দা বৃক্ষের শেকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলার অভিযানে নেমেছে। পঁয়ত্রিশটির মতো গোয়েন্দা ইউনিট পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়েছে ইরান এবং এই অভিযান চলছে, চলবে। চলতি জুলাই মাসের শুরুতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকে তাঁরা একমত হয়েছেন যে আগামী আগস্টের মধ্যে নতুন কোনো পরমাণু চুক্তি না হলে ইরানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের নিষেধাজ্ঞাগুলো পুনর্বহাল করা হবে। এটাকে বলে 'স্ন্যাপব্যাক ম্যাকানিজম'। এটা যেমন একটা অবৈধ হুমকি তেমনি ইর

ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফের সিনিয়র মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল ফজল শেকারচি সম্প্রতি বলেছেন: জনতার ঐক্য, নেতৃত্বের বিচক্ষণতা এবং জাতির দৃঢ় মনোবল ছিল বারো দিনের যুদ্ধে ইরানের জয়ের প্রধান কারণ। অপরদিকে, পরাজয়ের গ্লানি মেনে নিয়ে লেজ গুটিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে তারা। সুতরাং এই ঐক্য ভেঙ্গে দিতে হবে-এটা এখন ইরানের শত্রুদের পরিকল্পনার শীর্ষে রয়েছে। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ ইরানে দুটো মাজহাব বেশ গুরুত্বপূর্ণ-শিয়া এবং সুন্নি। 'মিলে-মিশে থাকি মোরা আত্মীয় হেন'-রকমে সহাবস্থান করে তারা। বিভিন্ন বিষয়ে দাবি-দাওয়া থাকলেও দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে তাদের মাঝে কোনোরকম অনৈক্য কিংবা বিরোধ আপাত দৃষ্টিতে দেখা যায় না। এই আত্মীয়তার বন্ধন শত্রুদের পছন্দ নয়। তাই সুন্নি এলাকায় পুরোণো সন্ত্রাসীদের ইন্ধন জুগিয়ে হামলা চালানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাতে ঐক্যে ফাটল ধরানো যায়। কিন্তু বিচক্ষণ জনগণ খুব সহজেই শত্রুদের এই পরিকল্পনা ধরে ফেলে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়। কী করে বোঝা গেল যে এটা ইসরাইলের কাজ? কারণ শিশু ও নিরীহ মানুষ হত্যা। গাজায় যারা প্রতিদিনই এ কাজটি করছে ইরানেও সেই একই দৃশ্যপট। সুতরাং সহজেই অনুমেয়। তো হামলা চালিয়ে কি

প্রথমত, যে অজুহাতে ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলা করা হলো সেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পক্ষে কি কোনো প্রমাণ পাওয়া গেছে? ইরান তো অবহমান কাল ধরেই বলে আসছে তাদের পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ। এ দাবির কোনো ব্যত্যয় কি প্রমাণ করতে পেরেছে আইএইএ? যারা সকাল-বিকাল মিথ্যাচার করে তাদের ভিত্তিহীন দাবি বিশ্বাস করে কি আইএইএ কোনো সিদ্ধান্তে যেতে পারে?

দ্বিতীয়ত, ২০১৫ সালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫ স্থায়ী সদেস্য দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন ও রাশিয়াসহ জার্মানির সঙ্গে ইরানের সাথে জয়েন্ট কম্প্রিহেন্সিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন সংক্ষেপে 'জেসিপিওএ' নামে একটি পরমাণু চুক্তি হয়েছিল। ওই চুক্তি অনুযায়ী ইরান তাদের পরমাণু কর্মসূচি একটা পর্যায়ে নামিয়ে আনবে। অপরদিকে জাতিসংঘের দেওয়া সকল নিষেধাজ্ঞা ইরানের ওপর থেকে তুলে নেওয়া হবে। কিন্তু যদি জেসিপিওএ যথাযথভাবে মানা না হয়? তখন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যরা অভিযোগ উত্থাপন করতে পারবে এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে নিষেধাজ্ঞা আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। তবে এখানে একটা লাল রঙের কিন্তু রয়েছে। তা হলো জেসিপিওএ-তে স্বাক্ষরকারী কোনো দেশ যদি নিজেদেরকে চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করে নেয় তাহলে 'স্ন্যাপব্যাক ম্যাকানিজম' তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। আমেরিকা যেহেতু দুই হাজার আঠারো সালেই এই চুক্তি থেকে একততফাভাবে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে, তাই তারা চুক্তি অনুযায়ী স্ন্যাপব্যাক ম্যাকানিজম ব্যবহার করার অধিকার রাখে না। আইএইএ কি বিষয়টা নিয়ে পক্ষপাতিত্ব করবে? এই 'কিন্তু'র সমাধানের জন্য অপেক্ষা করার কোনো বিকল্প দেখি না।

বিশ্বের চিন্তাশীল মানুষেরা যখন এসব নিয়ে বিশ্লেষণ করছে সে সময় ইরানের বেলুচিস্তানে কাপুরুষোচিত হামলার ঘটনা আগের মতো পাশবিকতার পরিচায়ক। তবে আগের চেয়ে একটু পার্থক্য রয়েছে বর্তমান পরিস্থিতিতে। সেটা হলো ইরান এখন আর শিষ্টাচার কিংবা নিয়ম-নীতির বৃত্তে শত্রুদের ভাববে না। তারা এখন মাটির গভীর থেকে হলেও খুঁড়ে গুপ্তচরদের বের করে আনতে বদ্ধপরিকর। সামরিক প্রস্তুতির কথা না হয় না-ই বা বললাম।

নেতানিয়াহু নিজের পদ টিকিয়ে রাখতেই হিমশিম খাচ্ছে। ইসরাইলের অভ্যন্তরে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ চলছে। ইরানে কিংবা গাজা, লেবানন, সিরিয়ায় উন্মাদের মতো হামলা চালিয়ে নিজেদের পদ-পদবী রক্ষার চেষ্টায় সফল হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কারণ ইসরাইলিদের দৃষ্টি এখন খুলে গেছে। তারা জানে ইরানের মিসাইলের কাছে তাদের জীবন আর নিরাপদ নয়। তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে নিজেদের বসতিকে যেভাবে টার্গেট করেছে ইরান-তা এক কথায় দু:স্বপ্ন।

এই বাস্তবতা যদি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিন্দুমাত্র উপলব্ধি করেন তাহলে ইরানে পুনরায় হামলা চালানোর মতো বেল তলায় টাক মাথায় দ্বিতীয়বার যাবেন না বলেই মনে করি।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম