সামাজিক মিডিয়ায় রাজনৈতিক বর্বরতা: শিষ্টাচারহীন নেতৃত্বের প্রতিফলন
প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২৫, ১০:০৯ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রাজনীতি একটি জাতির বিবেক, একটি রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি। কিন্তু যখন সেই রাজনীতিতে যুক্তির বদলে গালাগালি, মতের জায়গায় অপমান আর ভিন্নমতের প্রতি সম্মানের বদলে হিংসা-বিদ্বেষ জায়গা করে নেয়—তখন রাষ্ট্রব্যবস্থা শুধু দুর্বল হয় না, সমাজ তার নৈতিক ভিত্তিও হারায়। আজকের বাংলাদেশে এই বাস্তবতা সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, যেখানে রাজনৈতিক মত প্রকাশের নামে চলছে এক ধরনের বর্বরতা, অপসংস্কৃতি এবং চরিত্র হননের একধরনের ‘ডিজিটাল হিংসা’।
এই অনিয়ন্ত্রিত আচরণের মূল উৎস খুঁজতে গেলে দেখা যায়—এটি কেবল সাধারণ কর্মীদের আচরণ নয়, বরং একটি বৃহৎ নেতৃত্বগত শিষ্টাচারহীনতার প্রতিফলন। যখন নেতৃত্বই ভাষা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়, ভদ্রতা বা উদারতা প্রকাশ করতে অপারগ হয়—তখন সমর্থকরাও রণনীতি হিসেবে বিদ্বেষ ও সহিংসতা বেচেঁ নেয়।
১. রাজনীতি মানেই কি এখন ট্রল, গালি আর বিদ্বেষ?
সামাজিক মিডিয়া যেমন গণতন্ত্রের এক নতুন রূপ দিয়েছে, তেমনি এ মাধ্যমটিকে আজ রাজনৈতিক সহিংসতার ভার্চুয়াল ক্ষেত্রেও রূপান্তর করা হয়েছে।
এখানে কেউ ভিন্ন মত পোষণ করলেই—তাকে ‘দালাল’, ‘দেশদ্রোহী’, ‘গুপ্তচর’ বলা হয়। তার ব্যক্তিগত জীবন হ্যাক করে অপমানজনক তথ্য ছড়ানো হয়। রাজনৈতিক বা ধর্মীয় অপবাদ দিয়ে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার চেষ্টা হয়। নারী রাজনীতিকদের প্রতি কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করা হয়—যা সভ্য সমাজে কল্পনাও করা যায় না। এই প্রবণতা আজ বাংলাদেশের রাজনীতিকে এক ভয়াবহ জায়গায় নিয়ে গেছে, যেখানে আর যুক্তি নেই, আছে কেবল গালি দিয়ে ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা।
২. নেতৃত্বের ভাষা নির্ধারণ করে রাজনীতির চরিত্র
রাজনীতিতে ভাষার একটি সাংঘর্ষিক শক্তি আছে। একজন নেতা যখন ভদ্রভাষায়, যুক্তিনির্ভরভাবে ভিন্নমতের জবাব দেন, তখন কর্মীরাও সংযত থাকে। কিন্তু যখন একজন নেতা সংবাদ সম্মেলনে, লাইভে বা নিজের ফেসবুক পেইজে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেন—তখন সেটি কর্মীদের জন্য ‘লেজিটিমেট লাইসেন্স’ হয়ে দাঁড়ায়। তখন তারা ভাবেন, ‘যখন আমার নেতা গালি দিচ্ছেন, তখন আমিও পারি।’
এই শিষ্টাচারহীন নেতৃত্ব একধরনের বিষবৃক্ষ, যার ফল আমরা পাচ্ছি রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক মেরুকরণ এবং তরুণদের রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার মধ্যে দিয়ে। এক সময় যে রাজনীতি ছিল আদর্শের, সে এখন হয়ে উঠেছে ট্রলিং আর মিথ্যার প্ল্যাটফর্ম।
৩. জুলাই বিপ্লব: আশার পরে হতাশার অনলাইন বাস্তবতা
২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের এক অনন্য মুহূর্ত ছিল। অনেকেই ভেবেছিলেন, এর মাধ্যমে দেশে একটি সভ্য ও সহনশীল রাজনীতির নতুন সূচনা হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভাষা আরও কড়া, বিদ্বেষপূর্ণ এবং ব্যক্তিগত হয়ে উঠেছে।
ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স (সাবেক টুইটার), এমনকি সংবাদমাধ্যমের কমেন্ট সেকশনেও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি এমন ভাষা প্রয়োগ করা হচ্ছে, যা আমাদের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে হিংস্র করে তুলছে।
যে তরুণরা রাজনীতিকে বদলের হাতিয়ার ভেবেছিল, তারাই এখন সামাজিক মাধ্যমে রাজনীতিকে ট্রল আর কটুক্তির উৎস হিসেবে দেখছে। এটি শুধু রাজনৈতিক ব্যর্থতা নয়—এটি জাতির চারিত্রিক বিপর্যয়।
৪. কেন ভয়াবহ এই প্রবণতা?
যুক্তির অভাব: নেতৃত্বের মধ্যে নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির সংকট তৈরি হয়েছে। তাই তারা যুক্তির বদলে গালি দিয়ে জবাব দিতে অভ্যস্ত হয়েছেন।
ক্ষমতার অহংকার: নেতাদের মধ্যে অনেকেই ক্ষমতাকে দায়বদ্ধতার চেয়ে অধিকারের উৎস ভাবেন। তাই সমালোচনার জবাবে প্রতিহিংসা দেখান।
মিথ্যা ও গুজবের রাজনৈতিক ব্যবহার: অনেকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে গুজব ছড়িয়ে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করতে চান। এ একধরনের ডিজিটাল সহিংসতা।
আইনের প্রয়োগহীনতা: অনলাইন ট্রলিং, কুৎসা রটানো, হুমকি ইত্যাদি অপরাধ হলেও রাজনৈতিক পরিচয়ে অনেকেই পার পেয়ে যান।
৫. সামাজিক মিডিয়ায় রাজনীতি নয়, বর্বরতা
সামাজিক মিডিয়া রাজনীতিকে গণমানুষের কাছে নেয়ার এক অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু এখন সেটি হয়ে উঠেছে একদল 'অভদ্র লড়াকুর' প্ল্যাটফর্ম। যেখানে—যুক্তিপূর্ণ পোস্ট মানে ‘তুমি কোন দলে?’
দলনিরপেক্ষ চিন্তা মানে ‘তুমি সুবিধাবাদী’।
ভিন্নমত মানে ‘তুমি শত্রু’।
নীরবতা মানে ‘তুমি ভীতু’।
এই চিত্র একটি অসুস্থ, বিষাক্ত রাজনীতিরই প্রতিফলন।
৬. করণীয়: রাজনীতিকে সভ্যতার পথে ফেরাতে চাই
১. নেতৃত্বের ভাষা পরিবর্তন: রাজনৈতিক নেতারা তাদের বক্তব্যে সহনশীলতা ও শালীনতা ফিরিয়ে আনতে হবে।
২. দলীয় আচরণবিধি: সামাজিক মাধ্যমে নেতাকর্মীদের আচরণ সম্পর্কিত একটি লিখিত নীতিমালা থাকা উচিত।
৩. আইনি জবাবদিহিতা: অনলাইনে অপপ্রচার, হুমকি ও গালির বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ জরুরি।
৪. রাজনৈতিক শিক্ষা: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক নৈতিকতা ও আচরণভিত্তিক প্রশিক্ষণ থাকা উচিত।
৫. জনগণের দায়বদ্ধতা: নাগরিক হিসেবে আমাদেরও সচেতন থাকতে হবে—আমরা কোন রাজনীতি চাই? গালিমুখর রাজনীতি, না যুক্তিসমৃদ্ধ নেতৃত্ব?
শিষ্টাচার হারানো নেতৃত্ব আমাদের কেবল বর্বর সামাজিক মাধ্যম নয়, বর্বর সমাজ উপহার দেবে। এই সমাজে ভিন্নমত থাকবে না, থাকবে কেবল ভয়, ঘৃণা ও ট্রল। আমরা যদি এই ধারা এখনই না থামাই, তাহলে রাজনীতি ধ্বংস হবে না শুধু—ধ্বংস হবে আমাদের নৈতিকতাবোধ, গণতন্ত্র ও সামাজিক শান্তি।
রাজনীতির দায়িত্ব হচ্ছে মানুষ গড়া, সমাজ গঠন করা—কিন্তু এখন রাজনীতি যদি মানুষ ভাঙার, ভাষা নষ্ট করার ও চরিত্র হননের নাম হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে প্রশ্ন ওঠে—এই রাজনীতি দিয়ে কী আসলে রাষ্ট্র টিকে থাকবে?
এখন সময়, নেতৃত্বের দায় স্বীকার করার। কারণ ভদ্রতা রাজনৈতিক দুর্বলতা নয়, বরং নেতৃত্বের বড় শক্তি। আর সামাজিক মিডিয়ায় রাজনৈতিক বর্বরতা বন্ধ করেই আমরা জাতিকে সভ্যতার পথে ফিরিয়ে আনতে পারি।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিজিডি), পিএইচডি গবেষক

