পেহেলগামে হামলা নিয়ে পাকিস্তানে যেসব আলোচনা হচ্ছে
বিবিসি বাংলা
প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:১৬ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কয়েক দিন আগে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনির বলেছিলেন, বিশ্বের কোনো শক্তি কাশ্মীরকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করতে পারবে না।
জেনারেল মুনির কাশ্মীরকে পাকিস্তানের ‘জাগুলার ভেন’ (যা মস্তিষ্ক, ঘাড়, মুখের একাংশ থেকে রক্ত সংগ্রহ করে হৃৎপিন্ডে পৌঁছে দেয়) বলে অভিহিত করেছিলেন।
ভারতকে নিশানায় রেখে কাশ্মীরের বিষয়ে তার মন্তব্য ঘিরে ভারতে বিতর্কও দেখা গিয়েছিল। সাম্প্রতিক ঘটনায় সেই বিতর্ক আবার উসকে উঠেছে।
এদিকে, পেহেলগামে হামলার খবর প্রকাশ্যে আসার পর থেকে পাকিস্তানের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে এ নিয়ে যেকোনো সন্দেহ খারিজ করে শোক জানিয়েছে পাকিস্তানও।
ভারত শাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় এখন পর্যন্ত ২৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। মূলত পর্যটকদের লক্ষ্য করে চালানো মঙ্গলবারের এই হামলাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনসহ বিশ্বনেতারা হামলার নিন্দা করে ভারতের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। বিবৃতি দিয়েছে পাকিস্তানও।
পাকিস্তানের তরফে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারতের অবৈধভাবে অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলায় হামলায় পর্যটকদের মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। আমরা নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করি।
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খাজা আসিফ পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, এই হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের কোনো সম্পর্ক নেই। এগুলো সবই তাদের দেশীয় বিদ্রোহ। তাদের বিভিন্ন রাজ্যে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চলছে। একটা নয়, দুটো নয় কয়েক ডজন রাজ্যে- নাগাল্যান্ড থেকে কাশ্মীর, দক্ষিণে, ছত্তিশগড়ে, মণিপুরে।
তবে তিনি জানিয়েছেন, পাকিস্তান ‘সন্ত্রাসের’ বিরুদ্ধে। তিনি বলেছেন, পাকিস্তান সব সময় যে কোনো ধরনের সন্ত্রান্সের বিরুদ্ধে।
অন্যদিকে, ভারতে নিযুক্ত পাকিস্তানের সাবেক হাই কমিশনার আব্দুল বাসিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ (সাবেক টুইটার) লিখেছেন, আমি আত্মবিশ্বাসী যে ভারতের যেকোনও ধরনের দুঃসাহসিক কাজ ব্যর্থ করতে পাকিস্তান সবভাবে প্রস্তুত। আমার কোনও সন্দেহ নেই যে এবার পাকিস্তানের তরফে যথাযোগ্য জবাব দেওয়া হবে।
পাকিস্তানে যে ধরনের আলোচনা হচ্ছে
পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা ও সংসদ সদস্য শেরি রহমান এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন , পেহেলগামের মর্মান্তিক সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা করছি। দুর্ভাগ্যবশত, এই হামলার জন্য আগেভাগে পাকিস্তানের দিকে আঙুল তোলা, ভারতের দিক থেকে একটা সাধারণ বিষয়।
এই প্রসঙ্গে ভারতের সমালোচনাও করেছেন তিনি। তার মতে, ভারত নিজেদের ব্যর্থতা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর কৌশলগত স্থিতিশীলতা এবং দায়িত্বশীল সম্পৃক্ততার দাবিতে তোলা বৈধ কণ্ঠস্বরকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। এমন কি তাদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশাও করা হয়।
অনুমান করা যেতে পারে যে কোনোরকম তদন্ত ছাড়াই এখন ভারতের দক্ষিণপন্থী শিবির পাকিস্তানকে ধ্বংসের ডাক দেবে।
উমর আজহার নামে পাকিস্তানের এক নাগরিক এক্স হ্যান্ডেলে জেনারেল মুনিরের দিন কয়েক আগের ওই ভিডিও ক্লিপ শেয়ার করেছেন। ভিডিওতে পাক সেনাপ্রধানকে বলতে শোনা গিয়েছিল, কাশ্মীরি ভাইদের পাকিস্তান একলা ছেড়ে দিতে পারে না।
তার ভাষণের সেই ভিডিও ক্লিপ শেয়ার করে উমর আজহার লিখেছেন, পাঁচ দিন আগে জেনারেল মুনির একটা উন্মত্ত ভাষণ দিয়েছেন। তিনি ঘোষণা করেন, ভারতীয় দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাকিস্তান কাশ্মীরি ভাইদের একা ছেড়ে দিতে পারে না। এখন দেখা যাচ্ছে যে প্রাথমিকভাবে যা ধারণা করা হয়েছিল, এটা তার চাইতেও মন্দ। জেনারেলের এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া উচিৎ হয়নি।
ওমর আজহারের ওই পোস্ট পুনরায় শেয়ার করে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক আয়েশা সিদ্দিকা লিখেছেন , ভারতের কাশ্মীরে হামলার পর এই উৎসাহ কী মনোভাব নেয় তা দেখার বিষয়।
ভারতেও জেনারেল মুনিরের বক্তব্যের সমালোচনা দেখা গেছে।
ভারতের ইংরেজি সংবাদপত্র দ্য হিন্দু’র কূটনৈতিক সম্পাদক সুহাসিনী হায়দার জেনারেল মুনিরের ভাষণ সম্পর্কে নিজের মত প্রকাশ করে বলেছেন, পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের গত সপ্তাহের বক্তব্য এখন আরও বেশি শিরোনামে চলে এসেছে। শুধু কাশ্মীরে হিংসার হুমকি দেওয়ার কারণে নয়, তার ভাষা সাম্প্রদায়িক ও বিভাজনমূলক। দুটোই আজকের সন্ত্রাসী হামলার উদ্দেশ্য ও নৃশংসতার সঙ্গে যুক্ত বলে মনে হচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে নিজের মতামত প্রকাশ করেছেন ব্রিটিশ সাময়িকী 'দ্য ইকোনমিস্ট'-এর প্রতিরক্ষা বিষয়ক সম্পাদক শশাঙ্ক যোশী। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল মুনিরের বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, পাক সেনাপ্রধান যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তা সময়োপযোগী ছিল না। জেনারেল মুনির বলেছিলেন- আমাদের অবস্থান খুব স্পষ্ট। কাশ্মীর আমাদের জাগুলার ভেন, আমরা এটা ভুলতে পারি না। আমরা আমাদের কাশ্মীরি ভাইদের সংগ্রাম ভুলতে পারি না।
যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুসেইন হক্কানি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ একটা পোস্টে উল্লেখ করেছেন,, ২০২৩ সালের সাত অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের সন্ত্রাসী হামলার পর গাজা ভয়াবহ ট্র্যাজেডিতে ডুবে যায়। ২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মীরে হামলাও সম্ভাব্য পরিণতির দিক থেকে সমান ভয়ঙ্কর।
পাশাপাশি, তিনি জানিয়েছেন রাষ্ট্র ব্যতিরেকে সমস্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের এই হামলা কারীদের দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিন্দা করা উচিৎ।
পাকিস্তানের কামার চিইমা আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক। পেহেলগামের হামলা নিয়ে তিনি ‘মুসলিম অফ আমেরিকার’ প্রতিষ্ঠাতা সাজিদ তারারের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। সেই সময় সাজিদ তারার জানিয়েছেন, এই হামলার যে ‘টাইমিং’, তাতে একাধিক বার্তা রয়েছে।
সাজিদ তারার বলেছেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক আরও খারাপ হবে। আন্তর্জাতিক স্তরে ভারত একটা পরিচিতি পেয়েছে। কাশ্মীরের পরিস্থিতি ভালো হচ্ছিল এবং প্রচুর পর্যটক সেখানে যাচ্ছিলেন। কিন্তু আরও একবার সেটা লাইনচ্যুত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ’
ভারতে এই জাতীয় কোনো ঘটনা ঘটলেই পাকিস্তানকে নিশানা করা হয় বলে অভিযোগ তুলেছেন সে দেশের অনেকেই। পাকিস্তানি গণমাধ্যমেও একই কোথা প্রতিফলিত হয়েছে।
সেখানকার নিউজ চ্যানেল ‘সামা টিভি’র উপস্থাপক পেহেলগামে হামলার সম্পর্কে বলেন, ‘ভারতে কোনোরকম সন্ত্রাসী হামলা হলেই সরাসরি পাকিস্তানের দিকে আঙুল তোলা হয়।’
পাকিস্তানি সাংবাদিক সিরিল আলমেইদা এক্স-এ উল্লেখ করেছেন, ভারত যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে যারা এই কাজ করেছে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া দরকার... তাহলে কেউ কি তাদের থামাতে পারবে?
এই প্রসঙ্গে ব্রিটিশ সাময়িকী `দ্য ইকোনমিস্ট'-এর প্রতিরক্ষা বিষয়ক সম্পাদক শশাঙ্ক যোশী বলেছেন, আমি বিশ্বাস করি ভারত আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতে পারে। এই প্রসঙ্গে এক্স হ্যান্ডেলে পোস্টও করেছেন তিনি।
শশাঙ্ক যোশীকে একজন সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এই অনুমান সত্যি হলে তার সম্ভাব্য তারিখ কবে? জবাবে যোশী লিখেছেন, মে মাসের শেষ সপ্তাহে হওয়ার সম্ভাবনা ৬০ শতাংশ। আর আমি এটা নিয়ে মজা করছি না।
