এনসিপি ও গণঅধিকার কীভাবে, কেন একীভূত হতে চাইছে?
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০২:২৫ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাংলাদেশের তরুণদের নিয়ে গঠিত দুইটি দল গণঅধিকার পরিষদ ও জাতীয় নাগরিক পার্টি একীভূত হওয়ার বিষয়ে আলোচনা করছে বলে জানা যাচ্ছে, যা রাজনৈতিক মহলে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এ বিষয়ে দলীয় পর্যায়ে কয়েক দফা আলোচনা হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও ঘোষণা দেওয়া হয়নি।
দুই দলের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত তিন সপ্তাহে বেশ কয়েকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুই দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যেমন হয়েছে, তেমনি দলীয় পর্যায়েও বৈঠক হয়েছে।
সেখানে দুই দলের একীভূত হওয়ার বিষয়ে বেশ কিছু আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে দলগুলোর নেতারা জানিয়েছেন। তবে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি। বিশেষ করে একটি নিবন্ধিত দলের সঙ্গে আরেকটি অনিবন্ধিত দল কীভাবে এক হবে, দলের নেতৃত্ব কাঠামো কি হবে, ইত্যাদি বিষয়ে এখনো আলোচনা চলছে।
২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে গণঅধিকার পরিষদের নেতারা এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময়ে এনসিপির নেতাদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। মূলত তরুণদের নিয়েই এই দল দুটি গঠিত হয়েছে।
দুই দলের একীভূত হওয়ার এসব তথ্য এমন সময়ে জানা যাচ্ছে, যখন বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে।
তার আগে হঠাৎ করে কেন একীভূতকরণের বিষয়ে ভাবছেন এই দুই দলের নেতারা? আসলে ঠিক কী ঘটছে দল দুটিতে? কিভাবে ও কোন প্রেক্ষাপটে হবে এই একীভূতকরণ? এমন প্রশ্ন সামনে এসেছে।
কেন দুই দলের একীভূত হওয়ার উদ্যোগ
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও গণঅধিকার পরিষদ দুই দলেরই প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট প্রায় একই রকম। কোটা সংস্কার আন্দোলনের ভিত্তি ধরে দুই দলেরই যাত্রা শুরু।
২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গঠিত হয় বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। পরবর্তীতে ২০২১ সালে ওই আন্দোলনের নেতারা মিলে গণঅধিকার পরিষদে নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন।
এর আগে, ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে একই প্যানেল থেকে ভিপি প্রার্থী হিসেবে নুরুল হক নুর, জিএস ক্যান্ডিডেট হিসেবে রাশেদ খান এবং নাহিদ ইসলাম ও আখতার হোসেনও এই প্যানেল থেকে নির্বাচন করেছিলেন।
পরে ২০২১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে যখন আন্দোলন-বিক্ষোভ হয় তখনও এই নেতাদের মাঠে একসাথে দেখা যায়। পরে ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে গড়ে ওঠে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
এই প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে জড়িতরাই আওয়ামী লীগ সরকার পতনের কিছুদিন পর গড়ে তোলেন জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি। ২০১৮ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই দুই দলের নেতাদেরই আন্দোলনের মাঠে একসঙ্গে দেখা যায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নুরুল হক নুরের সঙ্গেই এনসিপির অনেক নেতার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছিল।
এদিকে, গণঅধিকার পরিষদ গত বছর নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেলেও, এ বছর প্রতিষ্ঠিত এনসিপি এখনো নিবন্ধন পায়নি। প্রতিষ্ঠার অল্প দিন হলেও সমালোচনা ছাড়ছে না দলটির নেতা-কর্মীদের।
তরুণদের নিয়ে গঠিত হলেও সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে উভয় দলের সমর্থিত প্যানেলের ভরাডুবি হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে চলছে দুই দলের একীভূতকরণের প্রসঙ্গ।
গত ২৯শে অগাস্ট দলটির সভাপতি নুরুল হক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লাঠিপেটায় আহত হওয়ার পর থেকে এই আলোচনা আরও জোরালো হয়।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত অনানুষ্ঠানিভাবে দুই দলের যে আলোচনা হয়েছে, সেটা ইতিবাচক ও ফলপ্রসু হয়েছে। দুটি দল কিভাবে একসঙ্গে কাজ করতে পারে সে বিষয়ে কথা হয়েছে।’
দলটির সাধারণ সম্পাদক দুই দলের একসঙ্গে পথ চলার ব্যাপারে আশা প্রকাশ করেন।
ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ভরাডুবি এই সিদ্ধান্তের কারণ কিনা এমন প্রশ্নে রাশেদ খান জানান, তরুণদের বিভাজনের কারণে সেখানে ফল খারাপ হয়েছিল। তাই এই বিভাজনের সুযোগ অন্য কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি ব্যবহার করেছে।
রাশেদ বলেন, তরুণরা যখন বিভাজিত থাকবে তখন তারা সফল হতে পারবে না। গণ-অভ্যুত্থান সফল হয়েছে কারণ আমরা সবাই মিলে একসাথে কাজ করেছি।
‘ঠিক একইভাবে গণঅধিকার পরিষদ ও এনসিপি একসঙ্গে কাজ করতে পারে এবং আমাদের যে ছাত্র সংগঠন ছাত্র অধিকার পরিষদ বা বাগছাস তারাও একসঙ্গে যদি কাজ করতো তাহলে মানুষ ভোট দিতো। কেন মানুষ ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে পিছপা হয়েছে? কারণ মানুষ দেখেছে তরুনরা বিভাজিত। ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ফল খারাপ হওয়া অবশ্যই একটা ব্যাপার।’
দুই দলেরই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একই রকম হওয়াটাও এই একীভূতকরণের কাজে লেগেছে বলে জানান তিনি।
তবে দুই দল একীভূত হলে শীর্ষ নেতৃত্বে কারা থাকবেন এমন প্রশ্নে তিনি জানান এখনও পর্যন্ত এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে, নাহিদ ইসলাম ও নুরুল হক নূর নেতৃত্বের শীর্ষে এগিয়ে থাকবেন বলেও মন্তব্য করেন রাশেদ।
এছাড়াও আখতার হোসেনসহ এমন গ্রহণযোগ্য নেতৃত্বকেই সামনে রাখা হবে বলেও জানান তিনি।
দলের নাম কি হবে এমন প্রশ্নে রাশেদ জানান, দুই দলের যে কোনো এক নাম অথবা নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করতে পারে দলটি।
নতুন হতে যাওয়া দলটির উদ্দেশ্য হবে নতুন বাংলাদেশ গঠনে একসঙ্গে কাজ করা, মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি (সাম্য ও মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার) প্রতিষ্ঠা করা এবং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে একসঙ্গে কাজ করা।
গত একমাসে এই বিষয়ে আলোচনার জন্য বেশ কয়েকটি বৈঠক হয়েছে। এর মধ্যে ব্যক্তি পর্যায় ও দলীয় পর্যায়ে বৈঠক হয়েছে।
একইসঙ্গে দুই দলের শীর্ষ নেতারা একটি বৈঠকও করেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
কয়েক দফা বৈঠক, বেশ কিছু সিদ্ধান্ত
গণঅধিকার পরিষদ একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল এবং সারা দেশে দলটির অসংখ্য নেতাকর্মী রয়েছে। ফলে কী প্রক্রিয়ায় এই দুই দল একীভূত হবে সে বিষয়ে আলোচনা এখনো চলছে বলে জানিয়েছেন দল দুটির নেতারা।
জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, যেহেতু দলটির সারা দেশে অসংখ্য নেতাকর্মী রয়েছে এবং নিবন্ধিত দল। তাই কী প্রক্রিয়ায় একীভূত হবে সে বিষয়ে এখনো আলোচনা চলছে।
গণঅধিকার পরিষদের ব্যানার ও অন্যান্য সবকিছু ‘ডিজলভ’ করার বিষয়েও দলটি সম্মত হয়েছে বলে জানান তিনি।
এরই মধ্যে কয়েক দফা বৈঠকে দল দুইটি বেশ কিছু সিদ্ধান্তে পৌঁছুছে বলে জানিয়েছেন পাটওয়ারী।
তবে, প্রাথমিকভাবে দুই দলের এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলেও গণমাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়নি।
যদিও তিনি দাবি করেন, একীভূত নয় বরং গণঅধিকার পরিষদ তাদের দলে যোগ দেবেন।
‘একীভূত হওয়া না, তাদের যোগ দেওয়ার বিষয়টি আমরা কনসিডারেশনে নিয়েছি। এনসিপির যে নামটা আছে সেইটাই থাকবে। ওইখান থেকে যারা নেতারা রয়েছেন, তারা এখানে এসে যোগ দেবেন।’
দুই দলই নেতৃত্ব নিয়ে একমত হয়েছে জানিয়ে পাটওয়ারী বলেন, নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন নেই। অর্থাৎ এখানে কালেক্টিভ লিডারশিপে যেহেতু চলে আসছে এতোদিন। হয়তো আমাদের আহ্বায়ক বা সদস্য সচিব কেউ তাদের রোলটা প্লে করতেছে। তারা আসলেও কালেক্টিভ লিডারশিপ ডিসিশন মেকিং এই জায়গাটা একীভূত হবে।
এরপর দক্ষতা অনুযায়ী দলে পদ বন্টন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলেও জানান তিনি।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির আরেকজন নেতা জানান, নতুন দলের প্রধান হিসেবে নাহিদ ইসলামের নাম বিভিন্ন বৈঠকে আলোচিত হয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক কলাকৌশল নিয়ে এই দল দুইটি রাজনীতির মাঠে নেমেছে বলে দাবি করেন নেতারা। পুরোনো রাজনৈতিক জোট বা দলে এই জেনারেশন যাচ্ছে না।
এখন যেহেতু আমাদের দুইটা পার্টি হয়েছে তাই এখন সময় হয়েছে একসাথে কাজ করার। এজন্যই একসাথে ফাইটিং এ যাওয়ার বিষয়টা এসেছে। আমাদের জেনারেশনের যারা তাদের এই পলিটিক্সটা দিতে হবে। এটা আমাদের রেসপনসিবিলিটি বলেন এনসিপির এই নেতা। এছাড়াও ধর্মীয় রাজনীতিও ‘অ্যালাউ করবো না’ বলেন পাটওয়ারী।
এক হওয়ার পেছনে দুই দলের নানা হিসাবনিকাশ
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ মনে করেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ ধরনের জোট করা বা দল করা খুব স্বাভাবিক।
এছাড়া দুই দলের নেতারাই চিন্তার দিক থেকে একই ঘরানার। ২০১৮ সাল থেকেই তাদের চিন্তার ঐক্য রয়েছে।
গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে আত্মপ্রকাশ করে। বেশ আশাভরসা নিয়েই রাজনীতির মাঠে আসে দলটি।
সাব্বির আহমেদ মনে করেন, দলটির সদস্যদের নানা ধরনের দুর্নীতি, স্ক্যান্ডালের কারণে সেই আশা হতাশায় পরিণত হয়েছে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে গেলে এনসিপির সঙ্গে অধ্যাপক মো. ইউনূসের দূরত্ব তৈরি হয়ে যাবে বলে মনে করেন সাব্বিন আহমেদ।
এনসিপি হয়তো বুঝতে পারছে তার নিজের মাটি শক্ত করা খুব জরুরি। কারণ ইউনূসের সঙ্গে তাদের একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে যাবেই। এটা হতে বাধ্য। কারণ নির্বাচন হয়ে গেলে ইউনূস অটোমেটিক চলে যাবেন বলেন এই শিক্ষক।
এছাড়া নেতা হিসেবে তরুণদের মধ্যে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূরের ইমেজ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যা এনসিপি কাজে লাগাতে চাইছে বলেও মনে করেন তিনি।
একইসঙ্গে নুরুল হক নূরেরও এক্ষেত্রে দলীয় হিসাব-নিকাশ রয়েছে বলে জানান তিনি।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসন পাওয়ার হিসাবে গণঅধিকার পরিষদ বা এনসিপি এখনো পৌঁছায়নি বলে মনে করেন সাব্বির আহমেদ। তবে, নির্বাচনের আগে বড় দলের সঙ্গে সমঝোতা বা জোট হলে দুই - একটা আসন পাওয়া নিশ্চিত হতেই পারে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক।
সূত্র: বিবিসি বাংলা।




