সিলেট বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায় প্রবাসীদের দাপট
উদ্বেগে মাঠের সম্ভাব্য প্রার্থীরা
সিলেট ব্যুরো
প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:৪৭ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সিলেটে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকায় এবারো প্রবাসীদের দাপট দৃশ্যমান। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের কেন্দ্রীয় দপ্তরে জমা পড়া প্রাথমিক তালিকার প্রায় অর্ধেকই প্রবাসী।
মাঠপর্যায়ের অনুসন্ধানে দেখা গেছে- মনোনয়ন প্রত্যাশীদের বড় একটা অংশ যুক্তরাজ্য, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসরত বিএনপি নেতাকর্মী। নির্বাচনি মাঠে তাদের এই হঠাৎ সক্রিয়তায় স্থানীয় বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা উদ্বেগে।
রোববার সিলেটের সব মনোনয়ন প্রত্যাশীকে তলব করেছে কেন্দ্র। সেখানেই প্রার্থীদের আমলনামা বিবেচনা করে মনোনয়নের ফয়সালা করে দেওয়া হবে- এমন প্রত্যাশা নিয়ে কেন্দ্রের দিকে তাকিয়ে সিলেটের নেতাকর্মীরা।
এদিকে প্রবাসীরা সম্প্রতি দেশে ফিরে বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ, উঠান বৈঠক ও ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। অন্যদিকে মাঠে থাকা স্থানীয় নেতারা বলছেন, দীর্ঘ অনুপস্থিতি ও জনসম্পৃক্ততার অভাব প্রবাসী প্রার্থীদের জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দল, আশঙ্কা রয়েছে বিএনপির নিশ্চিত-সম্ভাবনার আসন হারানোর।
সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনের মধ্যে সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলায় শুধু বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রায় একশ নেতা। এসব আসনের মধ্যে সিলেট-২, সিলেট-৩, সিলেট-৪, মৌলভীবাজার-১ এবং হবিগঞ্জ-২ আসনে প্রবাসী প্রার্থীর সংখ্যা বেশি।
সিলেট-২ আসনে যুক্তরাজ্য বিএনপি নেতা হুমায়ুন কবির ও নিখোঁজ বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনার মনোনয়নের লড়াই ইতোমধ্যে বাস্তব লড়াইয়ে রূপ নিয়েছে। দুই পক্ষের কর্মী-সমর্থকদের লড়াইয়ে পুরো সংসদীয় আসনের বিএনপি এখন প্রকাশ্যে দ্বিধাবিভক্ত। এ বিভক্তি ভেতরে ভেতরে চিড় ধরিয়েছে সিলেট জেলা-মহানগর বিএনপিতেও।
সিলেট-২ আসনের মতো সিলেট-৩ আসনেও চলছে মনোনয়নের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি, মাঠের নেতা আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী, ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি, সিলেট জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। এখন সিলেট জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক
আব্দুল আহাদ খান জামালের বিপরীতে মাথার উপর খাড়া কয়েক প্রভাবশালী প্রবাসী।
এর মধ্যে দুজন বেশ প্রভাবশালী ও ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী। তাদের দুজনের ক্ষমতা কারো থেকে কারো কমও নয়। সিলেটে চাউর, তাদের দুজনেরই হট কানেকশন আছে লন্ডনে!
এই দুই প্রভাবশালী মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রবাসী হলেন- কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক এমএ সালাম ও যুক্তরাজ্য বিএনপি নেতা এমএ মালিক। এছাড়াও মনোনয়নের দৌড়ে আছেন যুক্তরাজ্য বিএনপির উপদেষ্টা মশাহিদ হোসাইন ও যুক্তরাজ্য বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবেদ রাজা।
এর মধ্যে ব্যারিস্টার সালাম ও এমএ মালিক তারা দুজনই মনোনয়নের জন্য মরিয়া। ইদানীং মনোনয়ন লড়াইয়ের তৎপরতায় সবাইকে ছাড়িয়ে এগিয়ে আছেন এমএ মালিক। গণমাধ্যমপাড়ায়ও ঘন ঘন যোগাযোগ রাখছেন। এতে দীর্ঘদিনের চষে রাখা মাঠ অরণ্যে রোদন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে কাইয়ুম চৌধুরী ছাড়াও বিএনপির আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী ছাত্রদলের রাজনীতির কারণে আজীবন শরীরে গুরুতর ক্ষত বয়ে বেড়ানো আব্দুল আহাদ খান জামালের মধ্যে।
সিলেট-৪ আসনে বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ সিদ্দিকী ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল হেকিম মনোনয়নের প্রত্যাশায় মাঠে। তারা মাঠে থাকা অবস্থাতেই মনোনয়ন যুদ্ধে নাজিল হয়েছেন আরও দুই প্রবাসী নেতা। এই আসনে জেলা বিএনপির উপদেষ্টা ও যুক্তরাজ্যপ্রবাসী হেলাল উদ্দিন আহমদ ও মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকলেও এখন মনোনয়নের দৌড়ে।
এছাড়া বিএনপি থেকে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নেওয়া সিলেটের রাজনীতিতে বহুল আলোচিত ‘জামান গ্রুপ’ এর খোদ কর্ণধার অ্যাডভোকেট শামসুজ্জামান জামানও বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী।
সিলেট-৫ আসনে মাঠের নেতা হিসেবে মনোনয়ন চান জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি, চাকসুর সাবেক নেতা মামুনুর রশীদ মামুন, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির উপদেষ্টা আশিক উদ্দিন চৌধুরী ও জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ছাত্রদলের এককালের তুখোড় নেতা সিদ্দিকুর রহমান পাপলু।
অথচ এ আসনেই বিএনপির রহস্যময় নেতা প্রয়াত হারিছ চৌধুরীর মেয়ে যুক্তরাজ্য প্রবাসী সামিরা তানজিম চৌধুরী, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সহ-সভাপতি শরীফ আহমদ লস্কর, অস্ট্রেলিয়া স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব জাহিদুর রহমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত বিএনপির আহ্বায়ক মো. জাকির হোসাইন, যুক্তরাজ্য প্রবাসী ফাহিম আলম ইসহাক চৌধুরী, যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সাবেক ছাত্রদল নেতা মো. নূরুজ্জামান বিএনপির মনোনয়ন চান। দলে মনোনয়ন মনোনয়ন যুদ্ধ পর্যবেক্ষণের পর কেন্দ্র কৌশলী ভূমিকা নিয়েছে বলে জানা গেছে।
সিলেট-৬ আসনে বিএনপির সাবেক মনোনীত বিএনপি প্রার্থী ফয়সল আহমদ চৌধুরী, বর্ষীয়ান রাজনীতিক আবুল কাহের শামীম, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এমরান আহমদ চৌধুরী, জেলা বিএনপির আইন সম্পাদক অ্যাডভোকেট মুজিবুর রহমান মনোনয়ন যুদ্ধে আছেন। তাদের সঙ্গে এই যুদ্ধে যুক্ত হয়েছেন একঝাঁক প্রবাসী। এর মধ্যে আছেন যুক্তরাজ্যের টাওয়ার হেমলেটসের সাবেক ডেপুটি মেয়র এএনএম ওহিদ আহমেদ, যুক্তরাজ্যের টাওয়ার হেমলেটসের কাউন্সিলর সাবিনা খান ও যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি আনোয়ার হোসেন।
সিলেট-৪ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী ও সিলেট বিভাগে দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ সিদ্দিকী বলেন, মনোনয়ন চাওয়ার অধিকার সবারই আছে। এ কারণে প্রায় প্রত্যেক আসনেই মনোনয়ন প্রত্যাশীর ভিড়। এর মধ্য থেকেই দল প্রার্থী বেছে নেবে। প্রার্থী ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে মনোনয়ন যুদ্ধের কথা ভুলে সবাই ধানের শীষের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বেন এটাই প্রত্যাশা।
ছাত্রদলের রাজনীতি করতে গিয়ে চিহ্নিত প্রতিপক্ষের হামলায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন আব্দুল আহাদ খান জামাল। এখনো তার শরীরে বিরাট ক্ষত। তিনি ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি, সিলেট জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। এখন সিলেট জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক পদে আছেন।
সিলেট-৩ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী আব্দুল আহাদ খান জামাল জানান, মনোনয়ন প্রদানে প্রযুক্তির সহায়তা থাকবে বিধায় মাঠের নেতা কারা, কে কী করে গেছেন আশাকরি সব খতিয়ান কেন্দ্রের হাতে আছে। আর দলের জন্য কার কত ত্যাগ, কে কতটি মামলার আসামি ছিলেন সব কিছুই বিবেচনায় আসবে। তবে দলের মনোনয়ন চাওয়ার অধিকার আছে। প্রবাসীদের অবদানও অবশ্যই বিবেচনার।
দলের বৈঠকে প্রবাসী ও স্থানীয় উভয়পক্ষের মতামত নেওয়া হবে, তবে মনোনয়ন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ রাখতে কেন্দ্রীয় নেতারা প্রযুক্তিনির্ভর যাচাই চালাচ্ছেন।
একাধিক প্রবাসী প্রার্থী জানিয়েছেন, তারা প্রবাসে থেকেও দলের প্রতিটি আন্দোলনে অর্থ ও কৌশলগত সহায়তা দিয়েছেন, তাই মনোনয়ন চাওয়াটা তাদের সাংগঠনিক অধিকার। অন্যদিকে মাঠের সম্ভাব্য প্রার্থীরা বলছেন, হঠাৎ দেশে ফিরে প্রচারণা চালিয়ে প্রবাসীরা বাস্তবতাকে না জেনে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করছেন।
তবে দলীয় নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, মনোনয়নের জন্য হঠাৎ তৎপর, মাঠে ‘মৌসুমি নেতা’ হিসেবে গুঞ্জন আছে এমন কারো ভাগ্যেই দলীয় মনোনয়ন জুটার সম্ভাবনা নেই। মনোনয়ন নিয়ে আশঙ্কা নেই দীর্ঘদিন মাঠের আন্দোলনে থাকা তৃণমূলের পরিচিত নেতাদের। কারণ বিএনপি এবার প্রার্থী বাছাইয়ে ডিজিটাল ডাটাবেজ ও অনলাইন স্ক্রুটিনির মাধ্যমে প্রার্থীদের তথ্য যাচাই করছে। ডিজিটাল জরিপেই মাঠে কার কত দৌড় ছিল মোটামুটি উঠে আসছে। এতে প্রবাসীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয়তা, স্থানীয় সংযোগ ও সাংগঠনিক অবস্থান সহজেই যাচাই করা যাচ্ছে।
ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে সিলেট বিভাগের মনোনয়ন প্রক্রিয়া তদারকি করছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। কেন্দ্রীয় দপ্তরের বৈঠকে প্রতিটি আসনের প্রার্থীদের মাঠপর্যায়ের প্রভাব, জনসম্পৃক্ততা ও সাংগঠনিক অবস্থা পর্যালোচনা করা হবে, এরপর প্রাথমিক তালিকা চূড়ান্ত হবে।
স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সিলেটে প্রবাসীরা দলের আর্থিক ভিত্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ এটা শতভাগ সত্য। তবে তারা অনেকে দীর্ঘদিন মাঠে না থাকায় তাদের সঙ্গে মাঠের ভোটার সংযোগ অনেক দুর্বল। আর ত্যাগীদের বঞ্চিত করে মনোনয়ন দেওয়া নির্বাচনের আগেই মাঠে বিএনপি-বিএনপির প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ানোর সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।
