হাদির সঙ্গেই ছিলেন আততায়ী ‘পেশাদার শ্যুটার’?
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:৩২ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান বিন হাদির ওপর গুলি চালানোর ঘটনায় হামলাকারীদের পরিচয় ও উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। কারা এই হামলা চালিয়েছে, তারা আদৌ শনাক্ত হয়েছে কি না—এ বিষয়ে ঘটনার পর কয়েক ঘণ্টা পার হলেও পুলিশ আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো তথ্য জানায়নি।
তবে হাদির ঘনিষ্ঠরা ধারণা করছেন, হামলাকারী তার নির্বাচনী প্রচারণার সময় তার সঙ্গেই ছিলেন। প্রচারের সময় তোলা কিছু ছবিতে থাকা দুজন তরুণকে তারা সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করছেন।
শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) রাতে পুলিশের মহাপরিদর্শক মো. বাহারুল আলম জানান, তার মতে আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই এ হামলা হতে পারে। তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অগ্রগতি আমরা এই মুহূর্তে বলছি না। আমরা কাজ করছি। এবং বিফল হবো না।’
আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি ভোটগ্রহণের দিন রেখে বৃহস্পতিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণা করেন। এর পরদিনই সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে আলোচিত জুলাই আন্দোলন ও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে সোচ্চার মুখ ওসমান হাদির ওপর গুলি চালানো হয়।
আগেই তিনি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মতিঝিল, শাহজাহানপুর, পল্টন, রমনা ও শাহবাগ থানার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে লক্ষ্যে প্রতি শুক্রবার তিনি জনসংযোগ চালিয়ে আসছিলেন।
শুক্রবার দুপুরে মতিঝিলের একটি মসজিদে লিফলেট বিতরণ শেষে সতীর্থদের সঙ্গে ব্যাটারিচালিত রিকশায় করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে যাচ্ছিলেন হাদি। মধ্যাহ্নভোজ ও আলোচনার পরিকল্পনা ছিল সেখানে।
রিকশাটি চলন্ত অবস্থায় থাকতেই একটি মোটরসাইকেলের পেছনে বসা ব্যক্তি হাদিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। গুলিটি তার মাথায় লাগে। আহত অবস্থায় প্রথমে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করে খুলি খুলে রাখা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। চিকিৎসকদের ভাষ্য অনুযায়ী, তার অবস্থা আশঙ্কাজনক।
ডিএমপির জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, জুমার নামাজের পর বেলা ২টা ২৫ মিনিটে বিজয়নগর বক্স কালভার্ট এলাকায় মোটরসাইকেলে আসা হামলাকারীরা গুলি করে দ্রুত পালিয়ে যায়।
হাদির এক সহযোগী জানান, লিফলেট বিতরণ শেষে সবাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একত্র হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই হামলার খবর ছড়িয়ে পড়ে।
হাদির সঙ্গে থাকা একজন বলেন, বিজয়নগরে পৌঁছালে ডান পাশ থেকে মোটরসাইকেলের পেছনে বসা ব্যক্তি গুলি চালায়। গুলির আঘাতে হাদি রিকশা থেকে পড়ে যান। এরপর দ্রুত তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়।
চলন্ত যান থেকে নিখুঁত লক্ষ্যভেদ
ঘটনার একটি ভিডিওতে দেখা যায়, বক্স কালভার্ট সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশাটির একেবারে পাশে একটি হোন্ডা হর্নেট (১৬০ সিবিএস) মোটরসাইকেল চলছিল। কাছাকাছি এসে আরোহী অস্ত্র বের করে গুলি ছোড়ে। ভিডিওতে মোটরসাইকেলের নম্বর শনাক্ত করা যায়নি।
ছুটির দিনের দুপুর হওয়ায় রাস্তায় যান চলাচল তুলনামূলক কম ছিল। ফাঁকা সড়ক দিয়ে হামলাকারীরা দ্রুত পালিয়ে যায়।
ঢাকা মেডিকেলে উপস্থিত হাদির স্বজন ও সমর্থকেরা জানান, একটি মাত্র গুলি করা হয়েছে এবং সেটিই তার মাথায় লাগে।
মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেন, পল্টন থানার বক্স কালভার্ট রোডের ডিআর টাওয়ারের সামনে গুলির ঘটনা ঘটে। কী কারণে এবং কারা হামলা চালিয়েছে, তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। তবে অপরাধীদের শনাক্তে কাজ চলছে।
পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনাস্থল থেকে একটি গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়েছে।
ডিআর টাওয়ারের আনসার সদস্য ইমরান হোসেন হৃদয় বলেন, তিনি প্রথমে চাকা ফেটে যাওয়ার মতো শব্দ শুনে বাইরে এসে দেখেন রিকশার ওপর একজন আহত অবস্থায় পড়ে আছেন। অন্যরা তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
হাসপাতালে নেওয়া এক ব্যক্তি জানান, হাদির কানের পাশ দিয়ে গুলি প্রবেশ করে। একই তথ্য নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই শরীফুল ইসলাম।
চার দশকের বেশি সময় ধরে অপরাধ বিষয়ক সাংবাদিকতা করা পারভেজ খান ঘটনাটিকে পেশাদার শ্যুটারের কাজ হিসেবে দেখছেন। তার ভাষায়, ‘একটি চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে আরেকটি চলন্ত যানে থাকা টার্গেটকে এক গুলিতে আঘাত করা অত্যন্ত কঠিন। এটি শুধুই পেশাদার শ্যুটারের পক্ষেই সম্ভব।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটি কোনো আকস্মিক বা নবিস অপরাধীর ভুল কাজ নয়। এখানে পরিকল্পনা ও দক্ষতার স্পষ্ট ছাপ রয়েছে।’
সন্দেহের তালিকায় হাদির সঙ্গীরাই
ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার পর থেকেই হাদির সহযোগীরা দাবি করছেন, হামলাকারীদের ছবি তাদের কাছে রয়েছে। বিকেলে তারা দুটি ছবি প্রকাশ করেন, যা মতিঝিল ওয়াপদা মসজিদ ও মাদ্রাসা এলাকায় লিফলেট বিতরণের সময় তোলা। একটি ছবিতে মাস্ক পরিহিত একজনকে হাদির পাশে বসে থাকতে দেখা যায়, অন্যটিতে স্যুট ও চাদর পরা আরেকজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
এই দুজনকেই সিসিটিভি ফুটেজের সঙ্গে মিলিয়ে হামলাকারী হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবিগুলো ছড়িয়ে পড়েছে এবং কেউ কেউ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে সম্ভাব্য মুখাবয়ব তৈরির চেষ্টা করছেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশ জানায়, ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। থানা পুলিশ ও ডিবি যৌথভাবে সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও স্থানে অভিযান চালাচ্ছে।
ডিএমপি নগরবাসীকে আতঙ্কিত না হয়ে ঘটনায় জড়িতদের বিষয়ে তথ্য থাকলে নিকটস্থ থানা বা ৯৯৯-এ জানাতে অনুরোধ জানিয়েছে।
হাসপাতালে জনসমাগম
গুলিবিদ্ধ হওয়ার ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে হাদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই সেখানে ভিড় করেন তার কর্মী, সমর্থক, শুভানুধ্যায়ী ও সাংবাদিকরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে সেনাবাহিনীকে মোতায়েন করা হয়।
সন্ধ্যা ৭টা ৩৫ মিনিটে আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে পাঠানো হয়।
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে
ঢাকা মেডিকেলে অস্ত্রোপচার করা চিকিৎসক অধ্যাপক জাহিদ রায়হান জানান, গুলিটি মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তার ভাষায়, ‘তার অবস্থা খুবই খারাপ। আমরা আশাব্যঞ্জক কিছু বলতে পারছি না।’
এভারকেয়ার হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, হাদিকে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসে রাখা হয়েছে।
কাউকেই বাদ দিচ্ছে না ইনকিলাব মঞ্চ
হামলার ঘটনায় ভোটের প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে শুরু করে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ—কাউকেই সন্দেহের বাইরে রাখছে না ইনকিলাব মঞ্চ।
শুক্রবার রাতে এক ব্রিফিংয়ে সংগঠনের সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল জাবির বলেন, ‘আমরা কাউকে সন্দেহের বাইরে রাখছি না। ভোটের রাজনীতিতে অনেকেই ওসমান হাদিকে প্রতিপক্ষ ভাবতে পারে। আবার যারা তার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরকে ভয় পায়, তারাও এতে জড়িত থাকতে পারে।’
সরকারের দায়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যে সরকার হাদিকে রক্ষা করতে পারে না, সে দেশকে কীভাবে রক্ষা করবে। আল্লাহ না করুক, তার কিছু হলে অন্তর্বর্তী সরকারকে দায় নিতে হবে।’

