ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আসন্ন ত্রয়োদশ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জামায়াতে ইসলামীর সাথে আসন সমঝোতার আলোচনা করছে এনসিপি। এর মধ্যেই ‘দল ও বড় অংশের নেতারা ভুল পথে আছে’ উল্লেখ করে এনসিপি থেকে পদত্যাগ করেছেন দলটির একজন কেন্দ্রীয় নেতা।
জামায়াতের সাথে নির্বাচনি সমঝোতায় গেলে দলটির কেন্দ্রীয় পর্যায়ের আরও কেউ কেউ পদত্যাগ করতে পারেন বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে, সমঝোতার বিষয়ে দলের মধ্যে ঐকমত্য না থাকলেও এনসিপি কেন জামায়াতের দিকে ঝুঁকছে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, রাজনীতিতে ‘নতুন বন্দোবস্ত’ আনার প্রতিশ্রুতি, ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার পরিকল্পনা, নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠনের মতো আত্মবিশ্বাস দেখানোর পরও শেষ পর্যন্ত কয়েকটি আসনের জন্য পুরোনো রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গেই জোট বাঁধার আলোচনা এনসিপিকে একটি প্রশ্নবিদ্ধ জায়গায় ফেলে দিচ্ছে।
যদিও এনসিপি নেতারা বলছেন, সমঝোতার বিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছু চূড়ান্ত হয়নি। কয়েকটি দলের সাথেই তারা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে সংস্কার প্রশ্নে জামায়াতের সাথে তাদের অবস্থানগত সামঞ্জস্য থাকার কারণে দলটির সাথে আসন সমঝোতার দিকে ঝুঁকছে এনসিপি।
তবে বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় আসন সমঝোতা না হওয়াও দলটির জামায়াতের কাছে ঘেঁষার একটা কারণ বলে মনে করছেন অনেকে।
এদিকে, গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবর্তনের যে প্রতিশ্রুতি এনসিপি দিয়েছিল, তার সঙ্গে দলটির কর্মকাণ্ডের কোনো মিল পাওয়া যাচ্ছে না বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। ফলে গতানুগতিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণেও সমালোচনার মুখে পড়ছে দলটি।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, নির্বাচনী সমীকরণ থেকে ক্ষমতার রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করতেই এনসিপি জামায়াতের দিকে ঝুঁকছে। তবে এই সিদ্ধান্ত দলটির জন্য কতটা হিতকর হবে সে সন্দেহও প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।
জামায়াতের সাথে সমঝোতার প্রশ্নে যা বলছে এনসিপি
গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত বছর সরকার পতনের পর মাঠে সোচ্চার থাকা জুলাই আন্দোলনের পরিচিত মুখদের নিয়ে গঠন হয় নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি, যেখানে যোগ দিতে উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগও করেন দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দল গঠন ও পরিচালনা হচ্ছে–– প্রথম থেকেই এমন অভিযোগের মুখে পড়েছে এনসিপি। একইসাথে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের নানা কর্মকাণ্ডের কারণে বিভিন্ন সময় একে ‘জামায়াতের বি টিম’ বলেও অভিযোগ উঠে।

তবে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও পিআর পদ্ধতিতে সংসদ নির্বাচনসহ সংস্কার পদ্ধতি নিয়ে জামায়াতের কিছু দাবির সাথে মতপার্থক্য থাকায় দলটির নেতৃত্ব ইসলামপন্থি আট দলের যুগপৎ আন্দোলনে যায়নি এনসিপি।
তবে এনসিপি, এবি পার্টি ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ে ‘গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট’- এরও ঘোষণা আসে। এর দুই সপ্তাহ পরই জামায়াতের সাথে নির্বাচনি আসন সমঝোতার আলোচনা সামনে এলো।
এ নিয়ে প্রশ্ন করলে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই একক, যৌথ বা আসন সমঝোতার মধ্য দিয়ে নির্বাচনের বিষয়ে ওপেন ছিলাম। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিএনপি, জামায়াত এবং আরও রাজনৈতিক দলের সাথে আমাদের জোট গঠন বা আসন সমঝোতার বিষয়ে এবং রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতি মূল্যায়নের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলমান রয়েছে।’
তবে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সংস্কার প্রশ্নে কারা বেশি আগ্রহী এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সে বিষয়টিকেই এনসিপি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানান তিনি।
‘ঐকমত্য কমিশনে সংস্কার প্রশ্নে বিএনপির সাথেই অন্য দলগুলোর মতভিন্নতা পরিলক্ষিত হতো। সেখানে সংস্কারের পয়েন্টগুলোতে ন্যাচারালি (স্বাভাবিকভাবেই) এনসিপি, জামায়াত এবং অন্য দলগুলো একমত হয়েছে।’
‘সেক্ষেত্রে সংস্কারের বিষয়, দেশটাকে নতুন করে গড়া, নতুনভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোকে গড়ে তোলার জন্য যে রাজনীতি, সে রাজনীতির প্রতি যে কমিটমেন্ট সেটাকেই নির্বাচনী রাজনীতিতে জোটের বা সমঝোতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রধানতম বিবেচ্য বিষয় হিসেবে এটাকে মূল্যায়ন করছি’, বলেন তিনি।
খবরে এসেছে, এর আগে বিএনপির সাথেও আসন সমঝোতার বিষয়ে এনসিপি আলোচনায় বসেছিল। তবে সেখানে কোনো সুরাহা না হওয়ায় জামায়াতের দিকে দলটি ঝুঁকছে বলে মনে করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।
‘বিভিন্ন জায়গা থেকে শুনে যেটা বোঝা যাচ্ছে যে তারা ভোটের হিসাব করছেন। আসন বেশি পাওয়া যাবে জামায়াতের কাছ থেকে সেই হিসাবটা করছেন’, বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ সাহান।
তার মতে, অন্য দলগুলোর সাথে আলাপ করে বেশি আসনের প্রতিশ্রুতি না পাওয়া এবং জামায়াতের সাথে গেলে সেই সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে ‘তারা মনে করছেন এর মাধ্যমে তারা পার্লামেন্টে যেতে পারবেন’ এবং সংসদে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে পারবেন।
যদিও গত ১০ই ডিসেম্বর ১২৫ আসনে নিজেদের দলীয় প্রার্থী ঘোষণার পর এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছিলেন, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না।
‘সিট কয়টা পাবো কি পাবো না, সেটা বিবেচনায় রেখে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছি না। সিট নিশ্চিত করতে হলে আমরা কোনো না কোনো জোটের সাথে চলে যেতাম’, বলেন তিনি।
সমাজ বিশ্লেষকদের বক্তব্য অনুযায়ী, আন্দোলনের মধ্যে থেকে গড়ে ওঠা দল এনসিপি, যাকে বলা হয় ‘মুভমেন্ট পার্টি’। ফলে শুরু থেকেই দলটি ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের’ যে বয়ান উৎপাদন করেছে, তার সাথে দলটির বর্তমান অবস্থানের কোনো মিল নেই।

বরং দলটির বিরুদ্ধে ‘জামায়াতের বি টিম’ হওয়ার যে অভিযোগ উঠেছিল, দলটি যদি আসন সমঝোতায় যায় তাহলে সেই দাবিকেই সত্যি প্রমাণ করবে এবং ‘একটি আলাদা স্বতন্ত্র আইডেন্টি নিয়ে একটা মুভমেন্ট পার্টি হিসেবে এনসিপির বেড়ে ওঠার যে সম্ভাবনা ছিল সেটাকে তারা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করবে’ বলে মনে করেন অধ্যাপক সাহান।
তবে বিষয়টিকে কিছুটা ভিন্নভাবে দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ। তার মতে, এনসিপি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বলতে কী বুঝিয়েছে, সেটা কখনো স্পষ্ট করতে পারেনি এবং দলটি ক্ষমতার রাজনীতিতে ঢুকে গেছে।
‘পাওয়ার পলিটিক্সে সবই চলে আর এনসিপি যেহেতু পাওয়ার পলিটিক্সের অংশ হয়ে গেছে, সো এখানে অন্যায় কিছু নাই’, বলেন তিনি।
এনসিপি নেতারা দল ছাড়ছেন কেন?
জামায়াতের সাথে আসন সমঝোতার বিষয়ে চলমান আলোচনার মধ্যেই দলের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে পদত্যাগের ঘোষণা দেন এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব মীর আরশাদুল হক।
এর আগে, দলটির আরও তিনজন কেন্দ্রীয় নেতা অনিক রায়, তুহিন খান এবং অলিক মৃ দলটি থেকে পদত্যাগ করেছেন।
জামায়াতের সাথে আলোচনা চূড়ান্ত হয়ে গেলেও এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে আভাস পাওয়া গেছে।
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে এনসিপির কাছে নিজেদের ভোটব্যাংক তৈরির সুযোগ ছিল। কিন্তু সে পথে না গিয়ে গতানুগতিক ক্ষমতার রাজনীতির দিকেই ঝুঁকেছে দলটি।
তাদের মতে, বিভিন্ন জরিপে এনসিপির সমর্থকদের যে হার সামনে এসেছে, জামায়াতের সাথে জোটে গেলে সেই সংখ্যা আরও কমে আসতে পারে। সেক্ষেত্রে দলটি পুরোপুরি জামায়াতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে পারে।
আর এর সঙ্গে যে অংশটি একমত নন, তারাই পদত্যাগ করে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করছে বলে মনে করছেন অনেকে।
অধ্যাপক সাব্বির আহমেদের মতে, কিছু লোক ‘নিজেদের স্বার্থ আদায় করার জন্য, নিজেদের আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য’ এনসিপির ফোরামটাকে ব্যবহার করছে।
বহু মত-পথের মানুষ এখানে এসে এসে জড়ো হয়েছিল; এখন যাদের মত-পথ মিলছে না তারা দল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন বলে মনে করেন তিনি।
